“ধর্ষণ”
শব্দটি এমনই অপমানজনক যে এ নিয়ে মজা করা মানেই আত্মসম্মানবোধের বিসর্জন দেওয়া।
এই শব্দ নিয়ে যারাই মজা করবেন- আমার বন্ধুতালিকায় যারা আছেন তাদেরকে আর কোন কিছু না বলেই মুছে দেবো। অনেক বলেছি, আর না!
আপনাদের এই মজা এখন আমাদের কলংক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জয় বাংলা
বাংলাওয়াশের ধাক্কা সামলা।
পুনশ্চ: নারী লাঞ্চনায় শুধু গায়ে হাত দেওয়াতেই হয় না, মানসিকতাতেও হয়, “ধর্ষণ” শব্দটি নিয়ে মজা সেই মানসিকতার বহি:প্রকাশ মাত্র।
——————————————————————————————————————-
খুব মনে আছে গত বছর দুয়েক ধরেই ‘ধর্ষণ’ শব্দটিকে মজাচ্ছলে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। ফুটবল খেলায় গোহারা হারলে ‘ধর্ষণ করে দিলোরে’, ক্রিকেটে শক্তিশালী দলকে হারালে ‘ধর্ষণ করা হলো’, কোন চরম সত্য প্রকাশের পর মজাচ্ছলে ‘ধর্ষণ থেকে যদি ভাল কিছু হয় তবে উপভোগ করাই ভাল’।
বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এই মজাতে মেতেছে খুব।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি প্রচন্ড ভীড়ের মাঝে কেউ কেউ মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে সটকে পড়েছে, বিশেষ করে মেলাতে… কেউ কেউ ধরা পড়ে উত্তম মধ্যম খেয়েছে জনতার হাতে। কিন্তু এতোটা উন্মত্ত বা দুঃসাহসী হয়নি কেউই যে দল পাকিয়ে এই কাজে নামবে।
গত ১৬ই ডিসেম্বরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা কনসার্টে প্রচুর ভীড় হয়, সেখানেও মেয়েদের এভাবে লাঞ্চনা করা হয় যা কোথাও প্রকাশ হয়নি। এরপরে এই বছরের বইমেলায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনের ভীড়ের সুযোগ নিয়ে প্রথমবার আত্মপ্রকাশ হয় এই রকম লাঞ্চনাকারীদের দলগত প্রচেষ্টার। তারপরে? তারপরে আমাদের আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মূল পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণের সমাগমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়। এই লাঞ্চনাকারীদের পরিচয় নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা, গ্রেফতার হয়নি কেউই, কেউ বলে সরকারের মদদে হচ্ছে বা ছত্রছায়ায়, কেউ কেউ এই কুঘটনাকে রাজনৈতিক মেরুকরণে নিয়ে ফায়দা লোটার কাজে নেমে পড়েছে।
এই লাঞ্চনাকারীরা এখনো ধরা পড়েনি ও উপযুক্ত শাস্তির আওতায়ও আসেনি। এদের ধরা পড়তেই হবে।
তবে আমার এই লেখার অবতাড়না তা কিন্তু না, এতো কথা বলার পিছনে অন্য কারণঃ
কেন এমন হচ্ছে, কি করে এরকম মানসিকতার বিকাশ হচ্ছে যা কিনা সংঘবদ্ধ হয়ে করার সাহস পাচ্ছে?
সামাজিক ও মানসিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে বোঝা যায় যে এদের সামাজিক পরিমন্ডলে ভয়াবহ রকমের সমস্যা আছে, এদের প্রত্যেকেরই মা/বোন আছে। কিন্তু তবুও তারা অন্য নারীদের গায়ে হাত দেওয়ার মতো কুপ্রবৃত্তির মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। কেন? সমাজ বিজ্ঞানীরা বলবেন-এদের সামাজিক পরিমন্ডল মেয়েদের সম্মান করা শেখায় নি বা সেই মানসিকতা দেয়নি বলেই এই অবস্থা। মনোবিদেরা আরো এক কাটি এগিয়ে বলবেন এদের মানসিকর পরিচর্যার অভাব বা ছোটবেলা হতেই মানসিক বিকাশই ঘটেছে এইরকম দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাই এরা নৈতিকভাবে বেড়ে ওঠেনি। এবং এই সমাজ বিজ্ঞানী ও মনবিজ্ঞানীরা একমত হবেন-এটা সামাজিক অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। আমিও সমর্থন করি এইরকম মতবাদের।
কিন্তু আমার প্রশ্ন সেখানেই ওঠে যখন দেখি শিক্ষিত প্রজন্ম অর্থাৎ যারা দারুণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেও ‘ধর্ষণ’ শব্দ নিয়ে মজা করেই যাচ্ছে। এই প্রজন্মের কাছ থেকে যা আশা করা যায় না মোটেও! এদের সামাজাইক অবস্থান খেয়াল করলে দেখা যায় এরা কিন্তু নৈতিকভাবে দারুণ অবস্থানে রয়েছেন, এদের সামাজিক পরিমন্ডল দারুণ-তবে কেন এরা এমন মজায় মেতেছেন? এরা কি বুঝে না যে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি কতোটা অসম্মানের আর কতোটা আত্মমর্যদাহানিকর?
এদের এই মজার বহিঃপ্রকাশ কিন্তু একদিনে বা সাধারণভাবে হয়নি। এদের মগজে বা বুদ্ধিবৃত্তিতে এই মজাটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে নীরবে। কি করে? উত্তর হচ্ছে আজকার এই প্রজন্মের কাছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কিছু পরিসংখ্যান খুবই জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয়ঃ লাইক, কমেন্ট, ফলোয়ার। অনেক মজার পেইজ আছে এইসব সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এবং এরাই নীরবে এইসব মজা করা প্রজন্মের মানসিকতায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে এমনভাবে যে প্রজন্ম মনে করে ‘মজা করেই তো বলেছি, ধর্ষণ তো আর করিনি’ অথচ এই শব্দটি উচ্চারণ মাত্রই সামাজিক, মানসিক অবক্ষয়ের নমুনা হিসেবে ‘ধর্ষণ’ শব্দের অবস্থানকে গ্রহণযোগ্য করিয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ, কেউ ধর্ষণ করুক আর না করুক মজাচ্ছলে এই শব্দ উচ্চারণ করা মাত্রই তা একজন মানবীকে অপমান করার সমান তা ভুলে যাচ্ছে।
এই যে বেখেয়ালে, অবচেতনে এদের মগজে ঢুকে যাওয়া- এমন করেই কিন্তু নারী লাঞ্চনাকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে সবার মাঝেই এমন করার দুঃসাহস পাচ্ছে। এই লাঞ্চনাকারীরা জানে আজকাল মেয়েদের গায়ে সবার সামনে হাত দিলে বাকিরা ‘মজাই নিবে’ ততোক্ষণ যতক্ষণ বাকিদের প্রত্যেকের মা বোন/বান্ধবীর গায়ে হাত দেয়া না হয়।
গত ক’দিন এই লাঞ্চনাকারীদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দারুণ উত্তপ্ত। অথচ যারা এই লাঞ্চনার প্রতিবাদ করছেন তারাই ‘ধর্ষণ’ শব্দটিকে নিয়ে আবারো মজা করেই যাচ্ছেন যার প্রকাশ ২২-০৪-২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাকিস্থানক ক্রিকেট দলকে বাংলাওয়াশ দেওয়ার পর শুরু হয়ে যায়। তারাই এই মজা করছে যারা কিনা নারী লাঞ্চনাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নিতে দারুণ উৎসাহিত!
হয়তো অনেকেই বলবেন ফাইক্কা/পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে এই শব্দ ব্যবহার করাই যায়! দুঃখিত, যে শব্দ আমাদের মা বোনদের ইজ্জতের অসম্মান করার জন্যে ব্যবহার হয় সেই শব্দ আমি পৃথিবীর অন্য কোন মা বোনদের জন্যেও ব্যবহার করতে দিতে ইচ্ছুক নই। পাকিস্থানের সকল কিছুই আমাদের কাছে ঘৃণ্য হোক এটা সবাই চাই কারণ এটা স্বাধীন বাংলার প্রতিটি নাগরিকের জন্মগত অধিকারবোধের ব্যাপার। তাই বলে পাকিস্থানীরা ১৯৭১ সালে আমাদের মা বোনেদের সাথে যা করেছে সেইসবকিছুকে সেই একই শব্দে অন্যকে অপমান করতে আমি রাজী নই, কারণ এতে আমাদের মা বোনেদেরকেই আবার অসম্মান করা হচ্ছে, তাদের লজ্জাকে আবারো কুৎসিতভাবে সেই দেশের জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে যারা এই অপরাধ করেছে ১৯৭১ সালেই।
আমি ভুলে যেতে রাজী আমার সেই সব বন্ধু/ভাই ও আত্মীয়কে যারা এই ‘ধর্ষণ’ শব্দ নিয়ে মজা করতে পারে।
আমরা প্রতিবাদ করছি নানান কিছুতে, আসুন আবারো প্রতিবাদ করি এই শব্দেরমজাচ্ছলে ব্যবহারে। মনে রাখবেন আপনার কাছের যে মানুষটি এই মজা করছে সে বা তার পরিমন্ডোলে থাকা অন্যেরা সেই মজাকে ব্যবহারিক প্রয়োগে পিছপা হবে না কারণ তখন তাদের কাছে এটাও মজাচ্ছলে করাই হয়ে ওঠে যেমন করছে আজকাল।
(সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান নিয়ে আমার পড়াশোনা কম বিধায় অনেক রেফারেন্স বা উদাহরণ ও যথাযথ যুক্তি উপস্থাপন করতে পারলাম না, শুধু আমার ভাসাভাসা জ্ঞান থেকে যা উপলব্দি হয়েছে তাই জানিয়ে গেলাম)
১২টি মন্তব্য
স্বপ্ন নীলা
ধর্ষণ মানসিকতার প্রভাব হতে আমাদের নারী, শিশু ও কিশোরীদেরকে উদ্ধার করতে হবে —- আর এরজন্য প্রয়োজন সমন্বিত একটি উদ্যোগ — নারী ও পুরুষের উদ্যোগ —
নারী গতিশীলতা আরো বৃদ্ধি পাক —-
নীতেশ বড়ুয়া
প্রথমে আমার আপনার সাথে ছেলেটি যে ‘ধর্ষণ’ শব্দ নিয়ে মজা করছে তা বন্ধ করুন, তার মানসিক অবস্থাকে শুধ করাটাই আসল। এটা সমন্বিত উদ্যোগের আগে ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করে দিতে হবে। আমি শুরু করে দিয়েছি।
নুসরাত মৌরিন
একমত। ভাষা প্রকাশে সংযত হওয়া উচিত সকলের।কারন শিক্ষার মূল পরিচয় হলো ভাষার ব্যবহার।ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নোংরা ভাষার ব্যবহারে অবাক হয়ে যাই।অনেক ফেসবুকীয় সেলিব্রিটি তাদের স্ট্যাটাসে এমন ভাষা ব্যবহার করে হাজার হাজার লাইকও পেয়ে যান-কি করে মানূষের এমন রুচি হয় জানি না
নীতেশ বড়ুয়া
ভাষা ব্যবহারে অবশ্যই সংযত হতে হবে, যদিও ২০১৩ সালের পর আজকে আমার ভাষার সনযম আমি হারিয়েছি এক পাকি পন্থীর সাথে তর্কে, দেড় বছর পর।
আমাদের উচিত হবে আমি আর আমার সাথে থাকা যে আছেন তাকে সংযত করা।
আর ফেবু লাইক, কমেন্ট দেখে এখন আর কিছু বলার নেই। এই আমি এইখানে এই পোস্ট দিয়ে আপনারা যতজন মন্তব্য করলেন সেই একই লেখা ফেবুতে দিয়ে কেউই কিছু বলে না। অথচ একই লেখা কোন ফেবু সেলেব দিতো? লাইক কমেন্ট আর সহযোদ্ধার বন্যায় ভেসে যেতো সব 🙂
সঞ্জয় কুমার
বাংলা ভাষার বানান এবং অর্থ বিকৃতি প্রতিহত করতে হবে । ।
নীতেশ বড়ুয়া
২০১০ সাল থেকে হঠাৎ করে কবিতার জোয়ার শুরু হয় ফেবুতে। তখন আমাদেরকে কবিতার লাইন গঠনে, বানান শুদ্ধ করতে সবাই এগিয়ে আসতো। এরপরে হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে যায়। এখন কেউ আর কাউকেই কিছু শেখাতে আসে না। এর জন্যে দায়ী আমরা নিজেরাই।
কৃন্তনিকা
আপনার সাথে সহমত…
নীতেশ বড়ুয়া
তাহলে শুরু করি আজ হতেই-আমার পাশে থাকা প্রতিটি ছেলে মেয়ে যদি এমন মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ করে উচ্চারণে (কথায়+লেখায়) তবে সাথে সাথে তাকে সতর্ক করবো।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সহমত।যত প্রচার তত প্রসার কিংবা পুরাতন পয়জন যত ঘাটবেন ততই এর দুগন্ধ বের হবে।প্রয়োজন এ সব ঘটনাকে যতটা নিরবে বাড়তে না দেয়া যায় ততই মঙ্গল।
নীতেশ বড়ুয়া
একেবারে নিজেকে শুধরেই এগুতে হবে। শোধরাতে হবে নিজের ভাই থেকেই… 🙂
ধন্যবাদ মনির ভাইয়া।
লীলাবতী
সহমত।এই প্রথম আপনার কাছে একটি ব্লগীয় লেখা পেলাম।লেখা ভালো হয়েছে।আরো লিখুন দাদা।
নীতেশ বড়ুয়া
আমার জ্ঞান কম ব্লগ লেখার 😛
ব্লগ লিখতে হলে প্রচুর জানা চাই আর রসবোধ চাই এবং এই দুটোই আমার মাত্রাতিরিক্ত রকমের কম আছে লীলাপু 😀