১৪-ই ডিসেম্বর, ২০২৩
আইডিয়াল স্কুলের ব্যাচ-১৪ এর রি-ইউনিয়নে যোগ দিতে এসেছে মেজর রাশেদ। সেনাবাহিনীর হলেও বর্তমানে তার পোস্টিং র্যাব-৩ এ। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও কেবল মাত্র স্কুল জীবনের বন্ধুরগুলোর সাথে দেখা হবে ভেবেই এই অনুষ্ঠানে আসার সময়টা অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছে রাশেদ। তাও কাজ শেষ করে বের হতে হতে একটু দেরীই হয়ে গেলো তার। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। তার জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি গাড়িটা অনবরত সাইরেন বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নির্ধারিত অনুষ্ঠানস্থলের দিকে।
অন্য সবাই সাধারণত এই পরিস্থিতিতে উসখুস করে তবে মেজর রাশেদ তাদের থেকে একটু ভিন্ন। রাস্তার জ্যামে বসেও সে অনবরত কাজ করে যায়। তবে আজকে এখন সে কাজ করছে না ভাবছে ………
ভাবছে তার স্কুল জীবনের সেই স্বৃতির কথাগুলো। ভাবছে তার সেই ছোট্ট বেলার বন্ধুগুলোর কথা। ভাবছে তাদের কথা এক সময় যাদের সাথে নিয়মিত একসাথে উঠাবসা করা হতো কিন্তু এখন দেখাও হয় না, তাদের কথা। ভাবছে তার জীবনের প্রথম ও এই পর্যন্ত একমাত্র ভালোবাসার কথা …
**********************
২৯-শে মার্চ, ২০১২
রাত ১২টায় ফেসবুকে একটা নোটিফিকেশন পেল রাশেদ। তিথির জন্মদিন !! মেয়েটাকে চিনে ও। আনোয়ার স্যারের কাছে ওরা দুইজনে একই ব্যাচে পড়ে। তিথির টাইমলাইনে পোস্ট করা যায় না প্রাইভেসির জন্য তাই ইনবক্সেই উইশ করলো রাশেদ কিছু না ভেবেই। ” শুভ জন্মদিন ” খুব ছোট্ট একটা মেসেজ …
মাত্র এক মাস হয়েছে ফেসবুকে আইডি খুলেছে নবম শ্রেণির ছাত্রী তিথি। ফ্রেন্ড তাই খুব কমই বলা যায়। আর যথেষ্ট প্রাইভেসি কনসার্ন একজন মেয়ে। অপরিচিত কাউকে ভুলেও অ্যাড করেনা। রাশেদের রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেছিল একই কোচিং-এ পড়ে দেখেই !! এইসব কারণেই তিথির ফ্রেন্ড সংখ্যা খুব বেশি নয়। ক্লোজ ফ্রেন্ড কেউই এত রাতে অনলাইনে থাকে না। সেইজন্য প্রথম উইশটা রাশেদেরই।
পরদিন সকালে মেসেজ চেক করতে গিয়ে এত রাতে রাশেদের উইশ দেখে অবাক হয় তিথি। ধন্যবাদ জানিয়ে রিপ্লাই দেয় সে। কিন্তু মেসেজটা সিন হয়না। বিকালে কোচিং-এ দেখা হয় তাদের। রাশেদকে আবারো ধন্যবাদ দেয় সে। আর এইটাও জানাতে ভুল করেনা যে সেই প্রথম উইশার।
ওই রাতেই তিথিকে অনলাইনে দেখে মেসেজ দেয় রাশেদ …
– হাই
– হ্যালো
– কি খবর ??
– ভালোই। তোমার ??
– ভালো। আচ্ছা আজকে স্যার যে ম্যাথ করালো ওগুলো সব বুঝেছ ??
– হ্যা। পুরা চাপ্টার করা শেষ।
– তাই নাকি ?? আচ্ছা ২১ নাম্বার অংকটা কিভাবে করেছ বলো তো। আমি পারছি না করতে।
– ও ওটা প্রথমে ……………………
এইভাবে তাদের মধ্যে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। সময় ধীরে ধীরে চলে যায়। তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ফেসবুকে তাদের মধ্যে চ্যাটিং চলতে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে একধরণের ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
এভাবে চলতে চলতে একদিন তারা ” ইন এ রিলেশনশিপ ” স্ট্যাটাস ঝুলিয়ে দেয়। সেটা ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। নবম শ্রেনির বার্ষিক পরীক্ষা মাত্র শেষ হয়েছে সে সময়। রাশেদের মত হাসিখুশি আর চঞ্চল ছেলে আর তিথির মত চুপচাপ শান্তশিষ্ট মেয়ে !! স্বভাবের দিক দিয়ে দুই জন দুই মেরুর বলেই তাদের রিলেশন নিয়ে ফ্রেন্ড সার্কেলে তৈরি হয়েছিল ব্যাপক কৌতূহল।
স্বৃতির পাতা হাতড়ে ওই দিনটার কথা মনে করতে পারলো রাশেদ। দিনটা ছিল ১৪-ই ডিসেম্বর। মনে আছে কারণ সেই দিন যে বুদ্ধিজীবি দিবস !! হটাত একটু অবাক হলো সে যখন মনে পড়লো আজও ঐ একই দিন।
আচ্ছা আজ কি তাহলে আবার তিথির সাথে দেখা হবে তার ?? তিথি কি আসবে ওই অনুষ্ঠানে ?? কি জানি !! আসার তো কথা। আচ্ছা ও এখনও কি দেখতে আগের মত আছে ?? নাকি বদলিয়েছে !!
নিজেই নিজেকে প্রশ্নগুলো করতে থাকে রাশেদ।
রিলেশন হওয়ার পরে দুই বছরেরও বেশি সময় ভালোই ভালোই কেটে গিয়েছিল তাদের। স্বভাবে দুই মেরুর হলেও তাদের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। যে কারণেই কোন সমস্যা ছিল না তাদের মধ্যে। এই সময়ের মধ্যেই তারা দুইজনেই এসএসসিতে গোল্ডেন পেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে দুইজনের ব্যাস্ততার কারণে যোগাযোগের মাত্রা কমে যায়। তারপরেও কোন সমস্যা ছিল না।
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসের কথা। সবে মাত্র উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে তারা …
হটাতই একদিন তিথি রাশেদের সাথে রিকশায় করে ঘুরার সময় চোখে পড়ে যায় তার মামীর। মামী গিয়ে সরাসরি মাকে জানিয়ে দেয়। আর মা জানা মাত্রই মেয়ের মোবাইল আর তিথির ভাইকে দিয়ে ফেসবুক চেক করায়।
জেনে যায় তাদের রিলেশনের কথা। তিথির মায়ের মাথায় যেন বাজ করে। কয়েকদিন বাদে মেয়ে ইন্টার দিবে এরপরে শুরু হবে ভর্তিযুদ্ধ আর মেয়ে এই সময় কি করছে !! সরাসরি ফোন দেন রাশেদের বাসায়। জানাজানি হওয়ার পরে সেইখানেও সৃষ্টি হয় আরেক কঠিন অবস্থার। সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা-পরিচালক বন্ধুবৎসল রাশেদের বাবা অবশ্য খুব বেশি কিছু বলেননি। বরং রাশেদের সাথে তিনি এই ব্যাপারে মজাও করেছেন।
কিন্তু গোল পাকায় রাশেদের মা। এই সময়ে ছেলের এই কাজ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননা তিনি। তবে সব কিছু এড়িয়ে গিয়ে রাশেদ চেয়েছিল তিথির সাথে তার রিলেশন রাখতে !! কিন্তু লাজুক তিথি তার বাবা-মা-ভাইয়ের অমতে গিয়ে কিছুতেই পেরে উঠেনি !! তাদের মধ্যকার শেষ কথাগুলো ছিল ……
– আমাকে ভুলে যাও, রাশেদ।
– কোন ভাবেই সম্ভব না। শুনো তুমি চিন্তা করো না। এই কয়েকদিন পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন আবার আমরা নিয়মিত কথা বলবো, দেখা করবো।
– কেউ কিছুই ভুলবে না। আর আমি এখন আমার ক্যারিয়ারের দিকে মনযোগ দিবো। সুতরাং এখন আমার এইসব ব্যাপারে মাথা ঘামালে হবে না।
– দেখ বুঝার চেষ্টা করো। ক্যারিয়ার শুধু তোমার একার না আমারো আছে।
– অত কিছু বুঝি না। খালি একটা কথাই আছে আমার, আমি এই রিলেশন টিকিয়ে রাখতে পারবো না।
– নিজের ক্যারিয়ারের জন্য তুমি তোমার ভালোবাসাকে বিসর্জন দিচ্ছ ?? এই তোমার ভালোবাসা !!
– হু। এইটা কেবল একটা মোহ ছিল। আর কিছুই না। এখন সেটা কেটে গেছে। সো প্লিজ আমার থেকে দূরে থাকো তুমি।
– তাহলে আগে কেন বলোনি ?? কেন আমার সাথে এতদিন এই মিথ্যা ছলনা করে গেলে ?? কি লাভ হয়েছে তোমার ??
– আমি আর কোন কথা শুনে চাই না, বলতেও চাই না।
– আর তুমি এটাকে মোহ বলেছ ?? এত সুন্দর মূহুর্তগুলোকে তুমি মোহ বলে চালিয়ে দিচ্ছ !!
– আমি রাখলাম। আর কথা হবে না।
……………
ফোনটা কেটে যায়। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে রাশেদ। মনটা ভেঙ্গে দুই টুকরা হয়ে গেছে তার। চুপচাপ বসে থাকে সে বিছানাতে। আর ভাবতে থাকে সেই সুন্দর মূহুর্তগুলোর কথা। ছেলের এই অবস্থা দেখে তার বাবা এসে বলেন,
– কিরে কি কথা হলো তিথির সাথে ??
– কিছুই না, বাবা।
– বাবাকেও বলবি না রে !! ঠিক আছে বলিস না।
এই বলে কপট অভিমান দেখিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। হটাত তাকে ডাক দেয় রাশেদ।
– বাবা বসো।
– হুম বসলাম। এইবার বল কি কথা হলো।
হটাতই বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে রাশেদ। তার বাবাও তাকে এভাবে কাঁদতে দেখেননি। আসলে কখনো সে এইভাবে কাঁদেনি। প্রচন্ড কষ্টতা তার কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে বের হচ্ছে !!
কাঁদতে কাঁদতেই বাবাকে সব খুলে বলে রাশেদ। শুনে একটু থেমে বাবা তাকে সান্ত্বনা দেয়,
– হয়তো যেটা ও ফোনে বলেছে সেটা ওর মনের কথা নয়। পারিপ্বার্শিক চাপেই হয়তো এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে। তুই মন খারাপ করিস না। জীবনে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে তোকে। সুতরাং তোকে শক্ত হতে হবে। এই সামান্য আঘাতে তোকে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না রে।
– বাবা এইটা সামান্য আঘাত ছিল না।
– বোকা ছেলে। তুই না আর্মিতে যাবি !!
– হ্যা বাবা।
– তাহলে এই মন নিয়ে তুই কখনোই হতে পারবিনা। তোকে আরো কঠিন হতে হবে রে। ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট সব ভুলে তোকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। সুতরাং মন শক্ত কর। আর চিন্তা করিস না। কিছুদিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন এই কান্না, এই কষ্ট সব ভাবলে হাসি পাবে তোর !! যা এখন ঘুমিয়ে পড়।
**********************
” স্যার, এসে পড়েছি আমরা। ” ড্রাইভারের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে এলো রাশেদ। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখের কোণে জমা হয়েছে !!
– তুমি গাড়ি পার্কিং করে রাখো। অনুষ্ঠান শেষ হলে আমি ফোন দিলে গাড়ি নিয়ে আসবে। আর হ্যা অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় ১১টা বাজবে। তুমি এর মধ্যে খেয়ে নিয়ো।
– জ্বি স্যার।
কিছুটা দ্বিধা কিছুটা গর্ব কিছুটা … আসলে একধরণের অব্যক্ত অনুভূতি নিয়ে অনুষ্ঠান হলে প্রবেশ করলো মেজর রাশেদ।
সবার শেষে অনেক দেরী করে এসেছে সে। প্রবেশ করা মাত্রই তাকে দেখে মূহুর্তেই জটলা বেধে গেলো ছেলেদের। স্কুল জীবনে জনপ্রিয় ছিল সে পাশাপাশি বর্তমানে সেনা কর্মকর্তা। ফলাফল তাকে নিয়ে সবার আগ্রহ বেশি। পরিচিত সবার সাথেই হালকা কথাবার্তা হলো তার। ছেলেদের সাথে কথা শেষ হলে এগিয়ে গেলো মেয়েদের দিকে। কয়েকজন পরিচিত ফ্রেন্ডদের সাথে কুশল বিনিময় করা শেষ করলো সে।
হটাতই চোখ পড়লো তার খুব পরিচিত একটা মুখের দিকে। লাল জামা পরিহিত ওই মেয়েটা এক সময়ে ছিল তার খুবই আপন কেউ। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে আজ অনেক দূরে !!
তিথি !!!!!
আগের চেয়ে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি তার !!
” কেমন আছো, তুমি ?? ” রাশেদকে দেখে প্রশ্ন করে তিথি। দীর্ঘ সময় প্রায় আট বছর পরে তাদের প্রথম কথা হলো।
একটু অবাক হয় রাশেদ। তাও চটজলদি উত্তর দেয়, ” আছি কোনরকম। তোমার কি খবর ?? ”
– এইতো। সারাদিন রোগী নিয়ে বিজি থাকি।
তিথি যে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিল এটার খবর আগেই পেয়েছিল রাশেদ।
*************
তাদের ব্রেকাপের পরে তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিল না। দুইজনে এইচএসসি গোল্ডেন পেয়ে পাশ করে যে যে চলে যায় যার যার গন্তব্যে। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সফল ভাবে ট্রেনিং শেষ করে রাশেদ সরাসরি ক্যাপ্টেন ও পরে প্রমোশন পেয়ে এখন মেজর। আর মেজর হয়েই তার পোস্টিং হয় র্যাবে।
আর তিথি সলিমুল্লাহ মেডিকেল থেকে পাস করে বের হয়েছে গতবছর। এখন সে চাকুরী করে বারডেম হাসপাতালে আর এফসিপিএস পড়ছে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
**************
– ও খুব ভালো, অনেক মহৎ প্রফেশনে আছো তুমি।
– হুম। তুমিও তো। আর্মির মেজর। বাপরে !! কয়েকদিন পর তো জেনারেল হয়ে যাবা।
– হাহাহা !! জেনারেল !! অনেক দেরী আছে। ওইদিন আসতে আসতে বউ-বাচ্চা নাতি-নাতনি সব হয়ে যাবে।
– তাই বুঝি !! তা তোমার বউটা কে ??
– এখনো বিয়ে করিনি আমি। তুমি করেছ ??
– নাহ।
– আল্লাহ কি বলো !! এখনো তুমি বিয়ে করোনি ??
– নাহ করিনি। অবাক হওয়ার কি আছে এতে ??
– আমাদের সমাজের মেয়েরা বিয়ের জন্য এত বছর অপেক্ষা করে না। একটু তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় তাদের।
– সমাজ আগের চেয়ে বদলেছে অনেক।
– তা বটে !! তবে এতটাও বদলায়নি। আর তোমার ফ্যামিলিও ওইরকম না যে তোমার বয়সী একজন মেয়েকে এই বয়সে অবিবাহিত রাখবে।
– সেটা সত্য। অনেক চেষ্টা করেছে আমার বিয়ে দেওয়ার। কিন্তু পারেনি।
– কেন ??
– আমি রাজি ছিলাম না।
– কেন ?? পছন্দ হয়নি কাউকে ??
– না সেটা না।
– তাহলে ??
– আসলে আমি এফসিপিএস শেষ করে বিয়ে করতে চাই।
– ও কেন আগে করলে কি হবে ??
– নাহ। আমি যেই ক্যারিয়ারের কারণে প্রথম ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়েছিলাম চাইনা সেই ভালোবাসাকে অপমান করতে !!
কথাটাতে ভীষণ অবাক হলো রাশেদ।
– কিন্তু ………
” আরে তোরা এখানে কি শুরু করলি ?? আয় আয় কন্সার্ট শুরু হচ্ছে তো !! ” ফ্রেন্ডের কথায় বাধা পড়াতে আর কথা হলো না তাদের মধ্যে !!
এরপরে অনুষ্ঠানে আর সময় হলো না কথা বলার।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা ১১টায় থাকলেও শেষ হতে হতে প্রায় ১২টা বেজে যায়। এত দীর্ঘদিন পরে পুরনো বন্ধুদের পেয়ে কারো যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু বাস্তবতার কাছে হার মেনে নিতে হয় সবাইকেই। ফলে ফলে একে একে সবাই বিদায় নিতে শুরু করে।
বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায় রাশেদও। ফোন দিতেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির। অনুষ্ঠানস্থল থেকে বের হতেই চোখে পড়লো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন মেয়ের উপর !! ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো রাশেদ।
মেয়ে দুইজনের একজন তিথি আরেকজন আফরিন। আফরিন তাদের দুইজনেরই ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ড ছিল। গাড়ি থেকে নেমে আফরিনকে জিজ্ঞেস করে রাশেদ, ” কিরে কই যাবি তুই ?? ”
– আমার বাসা এখন মৌচাকে। তাই ওখানেই যাবো।
– চল তাহলে তোদের নামিয়ে দিবোনে।
– কিন্তু তিথি !!
– তিথির কি হয়েছে ??
– ওর বাসা তো মুগদায়।
– সমস্যা নেই ওকে ওর বাসাতে নামিয়ে দিয়েই আমি যাবো।
– তুই যাবি কই ??
– আমি তো ইস্কাটন অফিসার্স কোয়ার্টারে থাকি। ওখানেই যাবো।
– আংকেল এখনো সরকারি চাকরিতে ??
– হ্যা। এই তো আগামী ডিসেম্বরে এলপিআরে যাবে গিয়ে।
” কিন্তু ও এত ঘুরবে আমাদের জন্য !! কি দরকার !! ” তিথি একটু বাধা দিলো।
– সমস্যা কই ?? এখন তো রাস্তা ফাকাই আছে। কয়েক মিনিটই বা লাগবে !! আর এখন সহজে অন্য কোন যানবাহনও পাবে না তাছাড়া মেয়েদের জন্য একা একা এত রাতে চলাফেরা নিরাপদও না।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
অনিচ্ছাসত্বেও রাশেদের গাড়িটাতে উঠে তিথি।
” আচ্ছা রাশেদ তুই আর্মিতে গেলি কিভাবে ?? আর মেজরই বা হয়ে গেলি এত তাড়াতাড়ি !! কাহিনী বল না তোর একটু !! ”
আফরিনের অনুরোধে রাশেদ বলে, ” এইচএসসির পরে সরাসরি বিএমএর লং কোর্সে যোগ দেই। এরপরে ট্রেনিং শেষ করে ক্যাপ্টেন হয়ে যাই। তারপরে যাই শান্তি মিশনে। সেখানে বেশ সুনাম অর্জন করি আমরা। জাতিসংঘ থেকে বিশেষ সার্টিফিকেটও দেওয়া হয় আমাদের ইউনিটকে। ওই ইউনিটের কমান্ডার ছিলাম আমি। তারপরে দেশে এসে মেজর পদের প্রোমশনের জন্য একটা পরীক্ষাতে অংশ নেই। ওই পরীক্ষাতে দ্বিতীয় হওয়াতে মেজর পদ পেয়ে যাই। এরপরেই র্যাবে ট্রান্সফার করা হয় আমাকে। ”
– অনেক রোমাঞ্চকর লাইফ তোদের তাই না ??
– হ্যা। তবে অনেক সময় বিরক্তও লাগে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করতে কারই বা ভালো লাগে বল !!
রাস্তায় তাদের মধ্যে আর তেমন কথা হয় না। একটু পরেই মৌচাকে নেমে যায় আফরিন। গাড়ি ঘুরিয়ে যেতে থাকে মুগদার দিকে।
পুরো রাস্তায় একটা কথাও হয়নি তিথি আর রাশেদের মাঝে। মুগদা পৌঁছে যাওয়ার পরে গাড়ি থেকে নেমে যায় তিথি। সাথে নামে রাশেদও।
” বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। অনেক কষ্ট করলে !! ” বললো তিথি।
– নাহ কষ্ট কই !! ভালো কথা তুমি ওই সময় বলছিলে যে …
” হ্যা আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসতাম, রাশেদ। ” রাশেদের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো তিথি। ” কিন্তু আমার ফ্যামিলি আর ক্যারিয়ারের জন্য তোমাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। আর তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেই ক্যারিয়ারের জন্য তোমাকে ছেড়েছি সেই ক্যারিয়ার পরিপূর্ণ না করে আমি কোন সম্পর্কে জড়াবো না। ”
” তোমার এফসিপিএস শেষ হতে কতদিন লাগবে ?? ”
– সামনের জুলাইতে ফাইনাল দিবো। পাশ করতে পারলেই শেষ হয়ে যাবে।
– এরপরে বিয়ে করবে তাহলে ??
– হ্যা।
– আমাকে বিয়ে করবে ??
অকস্মাৎ প্রস্তাবে অবাকে নিস্তব্ধ হয়ে যায় তিথি। রাত সাড়ে ১২টার নিস্তব্ধ পরিবেশের সাথে যেন কিছুক্ষণ সামাঞ্জস্য রেখে চলে সে। হটাতই বলে উঠে …
” কি বললে, তুমি ?? তোমার সাথে এত নির্মম ব্যবহারের পরেও আমাকে বিয়ে করবে তুমি ?? ”
– হ্যা করবো যদি তুমি রাজি থাকো।
” কেন করবে তুমি আমায় বিয়ে ?? আমি তার যোগ্য নই। ” কাঁদতে কাঁদতে বলে তিথি।
– সেটা আমি বুঝি না। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি কি রাজি ??
এক মূহুর্ত নীরবতা। বড় বড় চোখ মেলে রাশেদকে দেখে তিথি। দীর্ঘ এক মূহুর্ত পরে এক হাত রাশেদের সবল বাহুতে রেখে বলে উঠে …
” প্রকৃত ভালবাসা জীবনে কমই পাওয়া যায়। একবার আমি হারিয়েছি, বারবার হারাতে চাই না। ”
এক মুহুর্ত তিথিকে দেখে রাশেদ। এরপরে ওর হাতটা নিজের হাতে রাখে।
দুইজনের মুখেই ফুটে উঠেছে একধরণের তৃপ্তির হাসি যার উজ্জ্বলতার ম্লান করে দেয় পূর্ণিমার চাঁদের আলোকেও !!
৭টি মন্তব্য
সাইদ মিলটন
১৪ ব্যাচ থিকা মেজর :D)
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এখনো এতো দুর্দিন আসে নাই
মেহেরী তাজ
ভালো লেগেছে। খুব বড় গল্প, একে ২-৩ পার্টে দিলে ভালো হতো ভাইয়া।
ওয়াহিদ আব্দুল্লাহ
ধন্যবাদ। পরবর্তী থেকে সেটাই করবো
মামুন
খুব ভালো লাগল গল্পটি।
শুভ সকাল। -{@
ওয়াহিদ আব্দুল্লাহ
ধন্যবাদ। শুভ রাত্রি -{@ 🙂
জিসান শা ইকরাম
প্রকৃত ভালোবাসা এমনই হয়
তবে বাস্তবতা একটু ভিন্ন থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
ভালো লিখেছেন।
গল্পটি ২ পর্বের হলে ভালো হতো–
আমরা আসলে সবাই ব্যাস্ত, আপনিও।
৩০ মিনিটের জন্য হয়ত নেটে আসি সবাই–
একটি লেখা এত বড় হলে, সময় এখানেই শেষ।
ভাগ করে দিলে পাঠকরা পড়তো বেশি।
শুভ কামনা।
ওয়াহিদ আব্দুল্লাহ
ধন্যবাদ। আসলে এই গল্পে কোন পার্ট করার মত সিচুয়েশন আমি খুঁজে পাইনি। তারপরেও পরবর্তী থেকে ব্যাপারটা মাথায় রাখবো। আপনার জন্যও শুভকামনা। 🙂