বৃষ্টিটা হঠাৎ করেই এলো । অথচ শরতের কি সুন্দর আকাশটা ছিলো এই কিছুক্ষণ আগেই । চারদিকে পুজো পুজো গন্ধ । সবুজ পাতাগুলোকে ঢেকে দিয়েছে সাদা সাদা শিউলী ফুলগুলো । বৃষ্টির তোড়ে সতেজ ফুলগুলো নিষ্প্রাণ এখন ।
–“ইস মা ফুলগুলো গেলো !” পিউলী বলে উঠলো ।
ওদিকে রিনীতা গজগজ করছিলো রাগে । বৃষ্টি আসায় কাজ আরোও বাড়লো । একটা মোটে ছুটির দিন , তাও নিস্তার নেই একটু যে বসবে । কাপড়গুলো প্রায় শুকিয়ে এসেছিলো , এখন এই ভেঁজা কাপড় কোথায় যে মেলে দেবে ! ঘরের ভেতর নিয়ে গেলে ঋভু রেগে যায় । ভেঁজা কাপড়ের গন্ধ নিতে পারেনা । এতো সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে ছেলেটা , আর অন্যদিকে পৌষালীর রুমে গেলে মনে হয় এটা কোনো ছেলের ঘর । একমাত্র পিউলীটাই যা একটু আলাদা । অন্যরকম । কেমন জানি শান্ত , কিন্তু উচ্ছ্বল । তবে কথা ফুঁটলে আর কিছুতেই থামানো যায়না । ওর জগতটা বড়োই সাজানো । এই সাজানো জগতে যত্ন করে রাখে মায়ের অভিমান , বাবার আদর , ভাই ঋভুর থেকে পাওয়া স্নেহ আর পৌষালীর শাসন । একমাত্র ও-ই বোঝে মায়ের রাগ নয় এসব , নীরব অভিমান । আসলেই রিনীতার সমস্ত অভিমান নিজের উপরেই । কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখে কিছুই নেই আদতে । রাতে যখন মাথা রাখে বালিশে , ঘুম আসতেই চায়না । অথচ একটি মুহূর্ত তো দাঁড়ানোর অবকাশ নেই । অফিসেই একটু জিরোনোর সময়টুকু পায় , তাও ব্রেকের সময় । যখন এই কষ্টটুকু বুঝতে পারেনা নিজের সন্তানেরা , তখনই একটা যন্ত্রণা হয় বুকে । এটাই তো হয় , রিনীতা বোঝে । একেকটি ছেলে-মেয়ে একেক রকম যদি না হয় , তাহলে ভিন্ন সত্ত্বা গড়ে উঠবে কি করে ? নিজের কোনো ভাই-বোন ছিলোনা রিনীতার , তাই হয়তো মাকে এমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি ।
–“মা কি ভাবছো এখানে দাঁড়িয়ে ?” পিউলীর কথায় ঘোর ভাঙ্গলো রিনীতার ।
–“আর কি করবো ? তোমাদের একেকজনের মেজাজের কথা ভাবছি । ভেঁজা কাপড়ের শ্রাদ্ধ করবো কি করে !”
–“ধ্যৎ মেয়েটার উপর কেন রাগ দেখাচ্ছি ?” মনে মনে বললো রিনীতা । সেদিন পৌষালী বললো , “মা তুমি না জানি কেমন হয়ে যাচ্ছো আজকাল । কিছুই বলা যায়না তোমায় ।” রিনীতা রেগে গিয়ে বললো , “বলিস কেন ? না বললেই হয় ! নিজেরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াস । একজন হয়েছে ভাবুক , আর একজন বিদ্বান , আর তোদের ভাই তো দার্শনিক ।” পৌষালী কিছু না বলেই সরে গেলো । নিজের মেজাজ দেখানোর জায়গাই নেই রিনীতার । মৌণব্রতকে বলবে ? ও তো শুনেই যাবে । নামের সাথে কারো চরিত্রের যে মিল হতে পারে , তা মৌণব্রতর মাঝেই দেখেছে রিনীতা ।
–“মা আমার ঘরে মেলে দিচ্ছি । ফ্যান ছেড়ে দিলে শুকিয়ে যাবে । দাও আমায় ।”
পিউলীর কথাটা শুনে মনটা ভরে গেলো । কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না । একটা মেয়েকে রেখেছে প্রতি ছুটির দিনে এসে কাপড়গুলো ধুয়ে দিয়ে যায় ।
–“এখন বৃষ্টি না এলেই কি হতোনা ? কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো ?”
–“মা , এই নাও মাথায় দিলেই সব ঠান্ডা ।” হাতে কিছু বরফ নিয়ে এসেছে পিউলী । এসব দেখে হেসে ফেললো রিনীতা । “বেশ ফাজলেমী শিখেছিস , না ?” মা-মেয়ের হাসির মধ্যেই ঋভু ফিরে এলো একেবারে কাক ভেঁজা হয়ে ।
–“কি ব্যাপার এতো হাসি যে !”
–“দাদা হাসির কোনো কারণ থাকেনা । এই যে তুই হাসলি , কারণ কি জেনে হেসেছিস ? হাসির জন্যে শুধু হাসি-ই লাগে ।”
–“মা , আমাদের পিউটা দেখছি অর্থনীতি পড়ে দার্শনিক কথা বলছে ! তা Thomas Attwood থেকে সক্রেটিস-প্লেটো-কান্ট যে হয়ে গেলি ! এখন কি হবে ?”
রিনীতা ছেলে-মেয়ের এই খুনসুটি দেখছে ।
–“আর ক্ষ্যাপাস না । এখন যা তো কাপড় বদলে আয় । চা করছি ।” –“মা এখন না । পৌষী আসুক । বাবা তো ঘরেই আছে , তাই না ? আজ সবাই মিলেই চা টা খাই বরং ।”
কি ব্যাপার আজ কি বিশেষ কিছু ? রিনীতা ভাবতে লাগলো । ঘটনা কি ? ঋভুর ঠোঁটের কোণায় হাসি । প্রেম করছে নাকি ? ছেলে-মেয়ে বড়ো হয়ে গেলে ওদের যে জগত গড়ে ওঠে , ওখানে বাবা-মাকে অনেক সাবধানে প্রবেশ করতে হয় । তাদেরকে যেমন নীচু করাতে হয়না , তেমনি একেবারে মাথার উপরেও বসানো ঠিক না । সব সমস্যার সমাধান তাদের কাছে চাইতে নেই । কিংবা যে কোনো কিছু করতে গেলেই সন্তানের কাছে জানতে চাওয়া , সেও একজন স্বার্থক মায়ের কর্ম নয় । এমন করে গড়ে তুললেই বাবা-মা বন্ধু হয়ে যায় । কথাটা রিনীতার মা বলেছিলো যখন ঋভু কলেজে পা রাখলো । কি যে ভাবছে তখন থেকে ! ঋভু প্রেম করলে প্রথমে এসেই মাকে বলবে ।
–“মা কাপড়গুলো আমার রুমে মেলে দিতে পারো । বারান্দায় দিলে আবার ভিঁজবে ।” এবার ঠিক বুঝে নিলো রিনীতা কিছু তো একটা ঘটেছে আজ । ঋভুর মুখে এ কথা ! আবেগ একেবারে উছলে পড়ছে । কারণ ছাড়া ঋভু বা পৌষালী কখনোই তাদের চরিত্রকে বদলে দেয়না । একমাত্র পিউলীটাই কারণ ছাড়া হাসতে পারে । আনন্দ করতে পারে । কষ্টকে পাশ কাটিয়ে , মনের ভেতর সেসবকে যত্ন করে সাজিয়ে রাখতে পারে । এজন্যই ওকে নিয়ে রিনীতার অনেক চিন্তা । এ সমাজ বড্ড জটিল । কাছের মানুষের উপর নির্ভর করা সবথেকে ভুল । ওরাই কষ্ট দেয় বেশী । বুঝেও বুঝতে চায়না । তাই রিনীতা নিজের মধ্যেই গুটিয়ে রাখে সবকিছু । এখন সময়টাই এমন যার যার , তার তার । অনুভূতি-আবেগ সেল ফোন আর ইন্টারনেটের ভেতর নৃত্য করে । তবুও কি করে জানি পিউলীর মতো মেয়েদের জন্ম হয় । আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে মাটির বুকে বাসা বাঁধে । পাখীদের মতোই হয় ওদের নীড় । ঝড়ে-তুফানে ভেঙ্গে পড়ে , আবার নিশ্চুপে গড়ে নেয় । তাই হয়তো এখনও কারণে-অকারণে হাসি-আনন্দ থেকে গেছে পৃথিবীতে । তবে এখন যা যুগ তার জন্যে পৌষালী একেবারে পারফেক্ট । যেমন রিজার্ভ , তেমনি বুদ্ধি রাখে । আর ঋভু তো কারণ ছাড়া একটা সিদ্ধান্তও নেয়না । কিসে কি হতে পারে , সব ভেবে-চিন্তে-দেখে তবেই সিদ্ধান্ত নেয় । একই গর্ভ থেকে তিনটি সন্তানের জন্ম , অথচ কতো আলাদা ! ঈশ্বরের যে কি খেলা , কে জানে !
এতোকিছু ভাবতে ভাবতেই ছুটির দিনটা গড়িয়ে গেলো ।
চলতে থাকুক!! গল্পের চরিত্রগুলো মাঝে মাঝে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল আমার কাছে, গুলিয়ে ফেলছিলাম অনেকটা তাই বার কয়েক পড়তে হল। পিউলীর বরফ নিয়ে আসাটা মৌন গল্পের মাঝে প্রাণ দিল কিছুটা হাসতে হল। সব মিলিয়ে ভাল লাগা রইল। আর হ্যাঁ গল্প পড়ি না অনেক দিন হয়ে গেল কারণ কিছুটা বিরক্তি চলে এসেছিল তবে আশ্চর্য হলাম আপনার এই গল্প পড়ার পর পরের পর্ব পড়ার ইচ্ছা জাগল তাই অপেক্ষায় রইলাম। ভাল থাকুন শুভ কামনা।
২০টি মন্তব্য
সাইদ মিলটন
চিরন্তন গল্প ভালো লাগছে , বেশ ভালো লাগছে 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
ভালো লাগাতে পেরে ধন্য হলাম…….. সাঈদ মিলটন
কৃষ্ণমানব
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় অপেক্ষিত ।।
নীলাঞ্জনা নীলা
লেখা চলছে ……… কৃষ্ণমানব।
বন্য
চলতে থাকুক!! গল্পের চরিত্রগুলো মাঝে মাঝে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল আমার কাছে, গুলিয়ে ফেলছিলাম অনেকটা তাই বার কয়েক পড়তে হল। পিউলীর বরফ নিয়ে আসাটা মৌন গল্পের মাঝে প্রাণ দিল কিছুটা হাসতে হল। সব মিলিয়ে ভাল লাগা রইল। আর হ্যাঁ গল্প পড়ি না অনেক দিন হয়ে গেল কারণ কিছুটা বিরক্তি চলে এসেছিল তবে আশ্চর্য হলাম আপনার এই গল্প পড়ার পর পরের পর্ব পড়ার ইচ্ছা জাগল তাই অপেক্ষায় রইলাম। ভাল থাকুন শুভ কামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
ধন্যবাদ এমন সুন্দর মন্তব্যের জন্য ……… বন্য
নাটোর শূন্য কিলোমিটার
চলুক …………………… আমরা আছি 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
আসবো আবার লেখা নিয়ে…
নুসরাত মৌরিন
নীলাদি ভাল লাগলো…বিশেষ করে রিনীতা চরিত্রটা।মায়েদের আমরা প্রায় সময় বুঝি না, মায়েরা আমাদের বোঝেন না।
লেখা চলুক। সাথে আছি…। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
আমিও যেমন মা হবার পর বুঝেছি মায়ের মন…
জিসান শা ইকরাম
অনেক ভালো লিখেছেন।
লেখার মাঝে ফিরেছেন এজন্য অত্যন্ত খুশী।
পরের পর্বের অপেক্ষায় ।
নীলাঞ্জনা নীলা
পরের পর্ব জমা রেখেছি…শিঘ্রী আসবে…
ব্লগার সজীব
আলাদা আলাদা মনের ছেলে মেয়েদের গড়ে তুলতে মা কে আসলেই অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ভালো লেগেছে নীলাদি ।
নীলাঞ্জনা নীলা
মাকে আমরা ভুল বুঝি সব সময়…কিন্তু মা-ই আলো জ্বালায় মনে আমাদের…
মিজভী বাপ্পা
লেখা পড়ে ভালো লাগল 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
অসংখ্য ধন্যবাদ মিজভী বাপ্পা…
কৃন্তনিকা
প্রতিটি পরিবারেই অনেক ছোট ছোট গল্প থাকে…
ভালো লেগেছে…
নীলাঞ্জনা নীলা
“ছোট প্রাণ , ছোট ব্যথা
ছোট ছোট দুঃখ-কথা…” (রবীন্দ্রনাথ)
ছাইরাছ হেলাল
আপনার লেখা পড়ার আলাদা আনন্দ।
অপেক্ষা।
নীলাঞ্জনা নীলা
তাড়াতাড়ি নিয়ে আসছি…আসলে অনেক ব্যস্ততা…