
” ২২ শে ফেব্রুয়ারি ”
দিনটি ছিল শনিবার। সকাল থেকেই সুপ্রিয় নিজের অফিসে যাওয়ার পায়তারা করছে।কিন্তু সে যে অসুস্থ সেদিকে তার একদম ই খেয়াল নেই। যেতে হবেই,এবং সে যাবেই। যেন পণ করে বসে আছে। মাত্র একদিন আগেই হাসপাতাল থেকে জোড় করে বাসায় এসেছে।মনে হয় শান্তির নীড়ে ফিরে এসেছে। টানা ১৮ দিন দুই হাসপাতালে থেকে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাসায় প্রচুর লোকজন আসা যাওয়ার মাঝে আছে। ছোট বোনের গাড়ীতে করে সুপ্রিয় অফিসে চলে গেল। একমাত্র ছেলে তনু সেও কোচিং করারজন্য বের হবে,ঠিক তখন কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে “আম্মু আমি কাকে নিয়ে বই মেলায় যাব”? ষোড়শীর হাতের মোবাইল টি বেজে উঠলো।রিসিভ করতেই অপর প্রান্তে সুপ্রিয় এর ছোট বোনের কন্ঠ, ভাবী আমরা পৌঁছে গিয়েছি। ডাক্তার ঠিক আছে। নো টেনশন।এরমাঝে কানের কাছে অনবরত তনুর প্রশ্ন করেই চলেছে।ওকে রাঙা মনির সাথে যেও বলে ছেলেকে কোচিং এ পাঠিয়ে ষোড়শী সুপ্রিয় এর বন্ধু প্রফেসর মাকসুমুল হক তার কাছে ফোনে আপডেট জানিয়ে রাখলো।এবং জরুরী ভিত্তিতে কি করনীয় তার কিছুটা নির্দেশ নিল।
খুব তাড়াতাড়ি মসলা ছাড়া সুপ্রিয় এর জন্য রান্না শেষ করে। যত কাজ ই করুক না কেন অজানা কেমন একটি ভাব জাগে মনে ষোড়শীর। বুকের মাঝে কেমন শূন্যতা বিরাজ করছে। মেজো ননাসকে দিদি বলে ডাকে ষোড়শী। তাকে ফোন করে কথাটি জানিয়ে দেয়। তিনি বললেন আল্লাহ কে ডাকো। সব ঠিক হয়ে যাবে। যথারীতি যাবতীয় কাজ শেষ করতেই অফিস থেকে সুপ্রিয় বাসার ফিরে হাত মুখ নিজেই ধোয়ার চেষ্টা করে। কিছুটা সাপোর্ট দেয় ষোড়শী। সোজা ডাইনিং টেবিলে আসে। নাম মাত্র তেল ও মসলা ছাড়া রান্না খেতে কষ্টই হতো। কিন্তু কোন উপায় ছিল না। এমন পর্যায়ে শারীরিক অবস্থা প্রোটিন একদম ই খাওয়া যাবেনা। ষোড়শী প্রশ্ন করেছিল খুব কষ্ট হচ্ছে খেতে? হ্যা সূচক মাথা নেড়ে বলেছিল সাময়িক ক্ষিদে মিটানো, মুখে তো কোন স্বাদ নেই। দুজনার দুজোড়া চোখ যেন জল নূপুর। খাওয়া শেষ হওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে দিতেই হঠাৎ ষোড়শীর মনে পড়ে দীর্ঘ ছয় মাস পর্যন্ত তো সুপ্রিয় শুয়ে ঘুমাতেই পারতোনা। বালিশ ও সোফার সব কূষন চারি পাশে দিয়ে আধা শোয়া অবস্থায় থাকতো। কত বেলা যে না খেয়ে ষোড়শী পার করেছে হিসেব নেই। সময় পেতো না। আবার ক্ষিধেও লাগতো না। সারাক্ষন চোখ দুটো ঘুম ঘুম ভাব থাকতো কখনো ঘুমিয়েই পড়তো ষোড়শী। গুরুজনেরা বলতেন। এই ঘুম ই কাল ঘুম না হয়। বুঝেনি ষোড়শী এসব কথার মানে। যতবার বিছানায় শুয়ে দিয়ে আসতো সুপ্রিয়কে ষোড়শী,ততবার ই একা উঠে রান্না ঘরের সামনে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো সুপ্রিয়। শেষে দুই চেয়ার এক সাথে করে কূষন দিয়ে বসিয়ে দিত।শুধু বলতো “তুমি এতো কি কাজ করো,? আমি তোমার পাশে থাকি একটু ”
হাসি দিয়ে বলতো ষোড়শী ঘরের কাজ করি। এইতো এখন ই শেষ হয়ে যাবে। তনু ফিরে এলো সে ছোট ফুপীর সাথে বই মেলায় যাবে তার টাকা চাই। তনুকে এক হাজার টাকা দিল তার বাবা,টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছুই বলেনা। বাবা জিজ্ঞাসা করলো,আরো টাকা চাই তোমার আব্বু?” হ্যা একটু চাই। আরো এক হাজার টাকা বের করে দিয়ে বললো আমি তো এবার নিয়ে যেতে পারলাম না, আগামীতে নিয়ে যাব। তোমার যে বই পছন্দ সেটাই কিনবে। রাঙা মনি সাথে আছে প্রয়োজনে তাকে বলবে কেমন! আচ্ছা বলে বাবাকেজড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ থেকে ফুপীর সাথে বই মেলায় চলে গেল তনু । এই শেষবারের মত তনু বাবাকে দেখা। আর জীবিত অবস্থায় বাবাকে পায়নি তনু। মাঝে ফোনে কথা হয়েছিল। বাসায় ডাক্তারের ভীর, অন্য স্বজন লোকে লোকারণ্য। পা ফেলার জায়গা নেই এমন অবস্থা। বাসার সামনে র রাস্তায় শুধু গাড়ীর লাইন।জন সাধারনের কষ্ট হওয়ার পালা। সবাই বুঝে নিয়েছিল এই সবার সাথে সুপ্রিয় এর শেষ দেখা। শুধু ষোড়শী বুঝেনি। সে ভেবেছিল এতো দিন পরে বাসায় ফিরেছে তাই সবায় দেখতে আসছে। এক সময় সুপ্রিয় প্রশ্ন করে বসলো “আচ্ছা আমি কি মরেই যাব? তাই সবাই এতো বারে বারে দেখতে আসছে? ষোড়শীর বুকের ভীতর মনে হলো ভারী কোন পাথর চাপা পড়েছে । উত্তরে বল্লো আরে নাহ কি যে বলো তুমি? তোমাকে তো কেউ কাছে পায়না বিজি থাকো এখন একটু অসুস্থ বলে বাসায় আছো, তাই সহজে তোমার সাথে দেখা পাবে সেজন্যই সবাই আসছে। ওসব চিন্তা করতে নেই ডাক্তার সাহেব। মন খুব খারাপ করে বই পড়ার চেষ্টা করে সুপ্রিয়। এক ফাঁকে বলে উঠলো “কোথায় তুমি? শোনো আমি সন্ধ্যায় চেম্বারে যাব। ষোড়শীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বলে কি? যে মানুষের সিঁড়ি ভাঙা নিষেধ সে কিনা সকালে একবার হাসপাতালে গিয়ে ডায়ালোসিস করে এসেছে। আবার অফিসে গিয়েছে এখন আবার চেম্বারে যাবে? চারতলা বাসা। খুব নিষেধ করা হলো। কিন্তু তিনি চেম্বারে যাবেন ই। ষোড়শীর হাতের চা না খেয়ে কখনো ই চেম্বারে যেতনা সুপ্রিয়। কিছুই খেতে পারেনা বলে বিকালে সুপ বানানো হলো। খুব মজা করে সুপ খেয়ে নিল সুপ্রিয়। চা খাবে এখন? না আজ চা খাব না। সুপ টা বেশ মজা হয়েছে।সারা দুপুর এই সব করেছো? হ্যা তোমার পছন্দ তাই বানানো হলো।আচ্ছা চা যখন খাবেনা, আর অল্প সুপ আছে দিব? হ্যা দিতে পারো মন ভরে খুব তৃপ্তির সাথে সুপ টুকু শেষ করলো সেই শেষ খাওয়া । সুপ্রিয় এর সাথে চা খাওয়ার সেই সোনালী সময় ষোড়শীর জীবনে আর আসেনি। টানা তিন বছর চা কি জিনিস ষোড়শী চোখে দেখেনি। সময়ের সাথে বাস্তবতার কাছে শোক তাপ নিভৃতে রয়ে যায়। তনুর ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে যাবে আগেই বলে গিয়েছিল। সুপ খাওয়ার আগে সুপ্রিয়কে কুসুম গরম পানি দিয়ে সারা শরীর মুছে দেয়া ও মাথায় পানি দিয়েছিল ষোড়শী। বেশ আরাম লাগছিল নাকি। দুষ্টুমি করে ষোড়শী বলেছিল পতি পরম গুরু। দেখো তোমার সেবা করছি। সুপ্রিয় এর মন ভাল করার জন্য আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যেত ষোড়শী । কিন্তু অবাক করে দিয়ে ষোড়শীর মাথায় হাত রেখে বলে “আমায় মাফ করে দিও তুমি। আমি দোয়া করিআল্লাহ তোমায় বেহেশত নসিব করবেন। তুমি আমার জন্য, আমার বাবা ও মায়ের জন্য যা করেছো আমি বেঁচে থাকলে উপন্যাস রচনা করবো। তুমি তো ইতিহাস সৃষ্টিকারী” একের পরে এক লোকজন আসতে থাকায় দরজার সিটকিনি লাগিয়ে রাখা হতো না। ভেজানো থাকতো। কখন যে মেজো ননাস এসে দাড়িয়েছে। দুজনার একজন ও টের পায়নি। তিনি অঝোরে কেঁদে চলেছেন। প্রশ্ন করা হয় কেন কাঁদছেন? উত্তরে তিনি বলেন পাগলী তুমি এই কথাগুলোর মানে বুঝেছো? ষোড়শী বল্লো নাহ। তিনি বলেন একজন হাজবেন্ড এর কাছে থেকে এই দোয়া পাওয়া অনেক পরম পাওয়া। আল্লাহ তোমার মংগল করবেন। ষোড়শী আজ ও ভেবে পায়না মংগল কি জিনিস। এই টা তার জন্য নয়। যাই হোক ছয়টা বাজতে এখনো বাকী তার আগেই একদম রেডি সুপ্রিয় চেম্বারে যাওয়ার জন্য। গাড়ীর চাবি নিয়ে বের হতে গিয়ে ষোড়শীকে বলে “আমি এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবো”তুমি তাড়াতাড়ি কাজ গুলো গুছিয়ে নাও। এর মাঝে তনুও ফিরবে। কিছু গাইড লাইন দিব তোমাদের”
ষোড়শীর মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না । বল্লো আমি তোমার সাথে যাই। না না তুমি কেন যাবে?
তোমার সাথে থাকবো,যদি অসুস্থ হয়ে পড় তাহলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে পারবো। আরে নাহ, আমার কিছু ই হবেনা। আমি এক ঘন্টার মধ্যেই এসে যাব। হাত দিয়ে টেনে নিয়ে গালের সাথে তার গাল লাগিয়ে বল্লো আমার কিচ্ছু হবেনা এতো চিন্তা করোনা তো! । বাচ্চাদের মত করে বাই বাই বাই বলে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় যখন অপলক দৃষ্টিতে আনমনে দাঁড়িয়ে ষোড়শী। নেমে যায়, আবার দুই তিন সিঁড়ি উপরে উঠে আর হাত নেড়ে বা ই বাই বাই এভাবে বেশ কয়েকবার করার পরে ষোড়শী বললো আজ চেম্বার যাওয়ার দরকার নেই বাদ দাওনা। তুমি এরকম তো কখনোই করোনা। উত্তরে হাত নাড়া অবস্থায় সুপ্রিয় বলেছিল ” তোমায় কেন জানি বার বার দেখতে ইচ্ছে করছে ” ষোড়শী আলতো হেসে বলে এসো তো! ঘরে চলে এসো চেম্বারে যেওনা। মন প্রান ভরে আমায় দেখো। ”
নাহ একটু ঘুরেই আসি। কত রুগি আমার জন্য অপেক্ষা করছে চলেই আসবো তো।সেই ষোড়শীর সাথে শেষ দেখা ও কথা। সুপ্রিয় চেম্বারে অনেক দিন পরে যাওয়াতে যেমন রুগির ভীর, তেমন আশে পাশের ডাক্তার, এলাকার লোকজন সব ঘিরে ধরে রেখেছে প্রায় আধা ঘন্টার বেশী।অনেক সাহসিতার মানুষ ছিলেন। নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করে গিয়েছেন। চেম্বারে পৌছানোর আধা ঘন্টা শুধু জন সাধারনের সাথে হাত মিলানো আর সালামের উত্তর নেয়া।তারপরে চেম্বারে ইন করে রুগি দেখা শুরু করে । তিনজন দেখার পরেই শরীর খারাপ লাগে । সেই অবস্থায় চার নম্বর রুগি দেখতে দেখতেই অক্সিজেন এর সমস্যা দেখা দেয়। সিস্টারকে ডেকে বলে দেয়া হলো স্যার আজ রুগি আর দেখবেন না। স্যার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেজো বোনকে দিদি বলে ডাকতো সুপ্রিয়। তাকে ফোন করে বলেছিল নাকি দিদি তোর ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দে। তোর গাড়ী পাঠাতে হবেনা। আমি গাড়ী নিয়ে এসেছি চেম্বারে। খুব খারাপ লাগছে ড্রাইভ করতে পারবো না। যে সময় দিয়েছিল, দিদি তার আগেই ড্রাইভার জাকিরকে পাঠিয়ে দেন। সুপ্রিয় এর সংগী তখন জাকির। যখন সে পৌঁছায় , তখন সুপ্রিয় এর অক্সিজেন এর অভাবে প্রচুর শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। গাড়ীর ফুল এসি দিয়েও কাজ হচ্ছে না। চেম্বার থেকে সোজা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে র ওনা দিল। যাওয়ার পথে যত ফার্মেসি র দোকান পড়েছে সব জায়গায় গাড়ী থামিয়ে অক্সিজেন আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়। কপালে না থাকলে কি হবে। কোথাও যখন পাওয়া গেল না সুপ্রিয় হয়তো বুঝেছিল আর ফিরবে না। নিজেই সব শেষে রুগিকে বাচানোর জন্য স্টারয়েড ইনজেকশন দেয়া হয় সেটা জাকির কে দিয়ে এনে নিজেই পুশ করেন। এবং বলে জাকির বাসায় সবাইকে খবর দাও। আর যত তাড়াতাড়ি পারো আমার হাসপাতালে নিয়ে চলো। ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে সুপ্রিয়। এতো কাছে থেকে একা জাকির ভয় সংশয় কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এর মাঝে দিদি আবার পার্টি তে যাবেন তাই জাকিরকে তাড়া দেয়ার জন্যই ফোন করেছেন। ফোন ধরেই জাকির সব বলা শুরু করেছে। দিদি আর ফোন কাটেন নি। জাকিরকে বলেছেন ফোন স্পীকারে দিয়ে ওকে খেয়াল করো আমরা আসছি। কিন্তু কোথায় যাবে সবাই? জ্যাম থাকাতে অন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়াতে জাকির স্থানের নাম ও বলতে পারছে না। ষোড়শীকে দিদি ফোন করে মোটামুটি জানিয়ে বললেন তুমি হাসপাতালে গিয়ে কেবিন রেডি করো আমরা আসছি। কিসে যাবে কিছুই পাছেনা। ষোড়শীর বড় ভাশুর ও বড় জা এসে বলে হাটা শুরু করো। সেই শুরু হলো ষোড়শীর পথ চলা ।কিছু দূর যেতেই ষোড়শীর ছোট বোনের হাজবেন্ড হুন্ডায় ফিরছিল। পথে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে আপু এখন হেটে কোথায় যান? দুলাভাই কোথায়? তাকে বাসায় রেখে আপনি বের হয়েছেন কেন? একটি ফোন দিতেন। এতো প্রশ্নের উত্তর তো জানা নেই। ষোড়শী নিজেই জানেনা সুপ্রিয় কোথায় কোন অবস্থায় আছে।। ছোট বোনের হাজবেন্ড এর নাম সাজ্জাদ। বলে আপু হুন্ডায় উঠেন। আমিও যাব আপনার সাথে । এক হুন্ডা মানুষ চার জন।পরে ষোড়শীর বড় জা বলে তোমরা তিন জন যাও। আমি পরে আসতেছি। এখন ভাশুর ছোট বোনের হাজবন্ড তাদের সাথে যেতেই হবে। জা বলে ভাশুর বড় ভাই বা বাবার মত তুমি ওঠো এক সাথে কিছুই হবে না। তা ছাড়া তুমি ছোট। যেই কথা সেই কাজ। ষোড়শী যে হাসপাতালে গিয়েছে সুপ্রিয় সেখানে আসেনি। খুব দুরবিসহ সময় পার হচ্ছে, এতো লম্বা সময় যেন শেষ হতেই চায়না।তবুও কেবিন রেডি করা হলো।
কিছুক্ষন পরে দিদি ফোন দিলেন কাগজ পত্র নিয়ে পাশের হাসপাতালে এসো।দিদিরা খুঁজতে খুঁজতে যখন গাড়ী পেল। সুপ্রিয় তখন অল রেডি চলে গিয়েছে। শেষবারের মত বলেছিল বাসায় াএকটি ফোন দাও জাকির। সাথে সাথে জাকির ফোন দেয়। তনু বই মেলা থেকে ফিরেছে ফোন টা তনুই ধরে। তার বাবা ফোনের অপর প্রান্তে হাপাচ্ছে মনে হয়। “আব্বু তুমি কি অসুস্থ হয়ে পড়েছো? হ্যা একটু, আম্মুকে চিন্তা করতে না করবে। এই তো আমি একটু পরেই চলে আসছি। এই কথা ই ছেলের সাথে বাবার শেষ কথা। ষোড়শী হেঁটেই পাশের হাসপাতালে ঢুকতেই দেখে সুপ্রিয় এর গাড়ীটা দাঁড়িয়ে আছে ভেতরে কেউ নেই। ফোনে ফোনে সব কাছের মানুষের ঢল নেমে এলো। সবাই যাচ্ছে। ফিরেও আসছে কিন্তু কেউ কিছুই ষোড়শীকে বলে না। জরুরী বিভাগ এর আগে থেকেই লাল ফিতা দিয়ে বেরিগেট তৈরী করে রেখেছিল। কারন সবাই জরুরী বিভাগে ঢুকে পড়ছিল। ষোড়শী তার বোনদের নিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। খুব চিৎকার করায় শুধু খবর দেয়া হলো ডাক্তার গন দেখছেন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
তখন হাসপাতালের কিছু ফর্মালিটি স থাকে সেই সব রেডি করছিল। কিছুতেই ষোড়শীকে জরুরী বিভাগে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কখনো মনে হতে লাগলো নৌকায় দুলছে। আবার সব শরীর ঘাম দিচ্ছে। আবার মনে হয় পুরা শরীর শোলার মত। কোন স্থিরতা নেই। এক ফাঁকেদৌড় দিল ষোড়শী। পিছনে সবাই ছুটেও ধরতে পারেনি, ততক্ষনে লাল ফিতা পেরিয়ে জরুরী বিভাগ এর দরজায়। সাথে সাথে ভেতর থেকে সিটকিনি আটকে দেয়া হয়। পাগলের মত একবার জানালার কাঁচ দিয়ে দেখার চেষ্টা। আবার দরজায় কড়া নাড়া। বেশ কয়েকবার করার পরে দরজা খুলে দেয়া হয়। ভেতরে ঢুকে ষোড়শী দেখে জরুরী টেবিলে সুপ্রিয় এর নিথর দেহ পড়ে আছে। ধবধবে সাদা মানুষ গায়ে ছিল। নীল শার্ট আর চকলেট রঙের প্যান্ট। ” তনুর আব্বু” বলে ষোড়শী গলা জড়িয়ে ধরে গালের সাথেগাল মিলিয়ে অঝোরে কেঁদে ই চলেছে। তখনো গাল গরম ছিল। কিন্তু শরীরের বাকী অংশ বরফ এর মত ঠান্ডা ছিল। ফুলে গিয়েছিল। অক্সিজেন এর অভাব, ব্রেন হ্যামারেজ অনেক রোগের সাথেই তার বসবাস ছিল। সব গুলো এক্টির সাথে আর একটি রিলেটেড। নিভে গেল একজন ভাল মানুষের জীবন প্রদ্বীপ। সুপ্রিয় যে সময়ে বাসায় ফেরার কথা ছিল, সেই সময় ই সে ফিরেছে। তবে জীবিত নয় মৃত। তনু বাকরুদ্ধ এর মত হয়ে গেল। ষোড়শী অসুস্থ হয়ে গেল। যে ষোড়শী ঘুমিয়ে পড়ে যেত, সে টানা ১৭ দিন , দিনে ও রাতে ঘুমাইনি। ডাক্তার আর শ্বশুর বাড়ির সবাই ডিসিশন নিল ঘুমের মেডিসিন দিয়ে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৮ ঘন্টাই ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে ষোড়শী কে। এবং এটা চলবে তিন মাস। কথাটি কানে আসার সাথে সাথে ষোড়শী যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। ডাক্তারের সাথে সরা সরি কথা বলে সিদ্ধান্ত নিল যে “না ” তাদের চিন্তা ধারায় নয়। ষোড়শীর চিন্তা ধারায় চলতে হবে। টানা তিন মাস ১৮ ঘন্টা করে ঘুমিয়ে কাটালে মেমোরিতে তো কিছুই থাকবেনা। তনুকেও চিনবো না। সেজন্য ডাক্তারের মতামত কে কেয়ার করা হলো না। অন্য ট্রিটমেন্ট নিয়েছে কিন্তু ঘুমের কোন মেডিসিন নেয়নি।
চোখের পলকে কাছের মানুষ গুলো একে একে পর হতে লাগলো।বাস্তবতা কি জিনিস কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা ষোড়শী। বোনেরা সাপোর্ট দিয়েছে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে।
সপ্তাহে শনিবার এলে বিজি থাকার চেষ্টা করে। তেমনি প্রতি মাসের ২২ তারিখেও বিজি থেকে সময় পার করে দেয় ষোড়শী। তনু প্রতি মাসের ২২ তারিখ এলেই এখন মনে করিয়ে দেয় “আম্মু আজ ২২ তারিখ কিন্তু ” সব মাসের থেকেও ২২ শে ফেব্রুয়ারি এক অনন্য দৃষ্টান্তরূপে দেখে ষোড়শী। জীবনের কঠিন বাস্তবতার অধ্যায় শুরু হলো। চলেছে তো চলেছে। কষ্টের পাহাড় গুলো পেরুতে অনেক বেগ পেতে হয়। সময় চলে তার গতিতেই। যুগে যুগে ষোড়শীরা এভাবেই বাস্তবতার সাথে তাল মিলাতে কখনো বেসামাল হয়ে পড়ে, আবার ভাবনার বিকাশ ঘটলে জেগে ওঠে, সাহস নিয়ে এগিয়ে চলে। সাথে থাকে আত্ববিশ্বাস,অদম্য ইচ্ছা শক্তি,কঠোর পরিশ্রম। আর থাকে ফেলে আসা সোনালী সময়,
শত কষ্টের মাঝেও মনে রয়।
২২ শে ফেব্রুয়ারী।
৩২টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
কঠিন আর কষ্টকর সময়ের উপস্থাপন সুন্দর হয়েছে। আপনার ভল্প লেখার হাত ভালই।
সময়ের প্রবাহে কিছু স্মৃতি অমলিন থেকেই যায়।
উর্বশী
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অফুরান শুভ কামনা।
শুভময় হোক সারাবেল।
মোঃ মজিবর রহমান
দারুন বাস্তবময় একটি গল্প লিখেছেন। যা জিবনে প্রতিনিয়ত ঘটে কিন্তু সুন্দর উপমায় তুলেছেন প্রতিচ্ছবি।
উর্বশী
মোঃ মজিবর রহমান ভাই,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অফুরান শুভ কামনা।শুভময় হোক সারাবেলা।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনিও ভাল থাকুন
উর্বশী
মোঃ মজিবর রহমান,
আমীন।
উর্বশী
মোঃ মজিবর রহমান ভাইয়া,
শুকরিয়া।ভাল থাকুন। শুভময় হোক সারাবেলা।
আলমগীর সরকার লিটন
অনেক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রইল ভাল লাগল——————
উর্বশী
আলমগীর সরকার লিটন ভাই,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অফুরান শুভ কামনা, শুভময় হোক সারাবেলা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
যুগে যুগে ষোড়শীরা এভাবেই বাস্তবতার সাথে তাল মিলাতে কখনো বেসামাল হয়ে পড়ে, আবার ভাবনার বিকাশ ঘটলে জেগে ওঠে, সাহস নিয়ে এগিয়ে চলে। সাথে থাকে আত্ববিশ্বাস,অদম্য ইচ্ছা শক্তি,কঠোর পরিশ্রম। আর থাকে ফেলে আসা সোনালী সময়,
শত কষ্টের মাঝেও মনে রয়। এই কথাগুলো প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই সত্য। কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরলেন সুন্দর লেখনীতে। বেঁচে থাকার তাগিদেই নিজেকে ভাঙতে হয় , গড়তে হয়, সামনে এগিয়ে যেতে হয় । যারা খুব আপন থাকে তারাই একসময় দূরে সরে যায় সময়ের স্রোতে। শুভ কামনা রইলো
উর্বশী
সুপর্না৷ ফাল্গুনী আপু,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অফুরান শুভ কামনা ও ভালোবাসা। শুভময় হোক সারাবেলা ।
ইঞ্জা
এ বড়ই কঠিন এবং বাস্তব লেখা, ষোড়শীরা এভাবেই তাল মেলাতে গিয়ে বেসামাল হয়ে যায়, হৃদয় ছোঁয়া এক লেখা দিলেন আপু।
উর্বশী
ইঞ্জা ভাইয়া,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা । অফুরান শুভ কামনা’,শুভময় হোক সারাবেলা ।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা আপু
উর্বশী
ইঞ্জা ভাইয়া,
শুকরিয়া। খুব ভাল থাকুন, শুভ কামন।
উর্বশী
ইঞ্জা ভাইয়া,
শুকরিয়া। ভাল থাকুন।শুভময় হোক সারাবেলা।
ফয়জুল মহী
বুদ্ধিদীপ্ত কলমে সৃষ্টিশীল লেখনী ।
উর্বশী
ফয়জুল মহী,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অফুরান শুভ কামনা, শুভময় হোক সারাবেলা৷।
উর্বশী
ফয়জুল মহী,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অফুরান শুভ কামনা সারাবেলা৷।
নিতাই বাবু
গল্পটা সত্যি দারুণ উপভোগ্য। লেখার হাত-ও আছে বেশ! ভালো লাগলো। চলুক এভাবে। সাথে আছি। শুভকামনা থাকলো।
উর্বশী
নিতাই বাবু দাদা
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অফুরান শুভ কামনা সব সময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
কিছু তারিখ শুধু স্বরণীয় হয় না। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। একটা তারিখ কিভাবে মানুষের জীবন যাপন, বর্তমান বাস্তবতা সব পাল্টে দেয় সেটাই গল্পে তুলে ধরেছেন। লেখাটা পড়ে কেন জানি কান্না পাচ্ছে। পতির হৃদয় নিংড়ানো দোয়া আর ভালোবাসায় যার জীবনটা হতে পারতো স্বর্গ-সুখের, সেই পতিকেই হারাতে হলো ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে। স্বামী হারানো নারীদের কঠিন বাস্তবতার সাথে লড়াই করে একটা একটা দিন কেমন করে কেটে যায় কেউ জানতেও পারে না। যে নারী হয়ে থাকে মায়া-ভালোবাসার প্রতীক হয়ে, কালের আবর্তে সেই হয়ে উঠে জীবন যুদ্ধের সৈনিক। খুব, খুব সুন্দর একটা গল্প উপহার দিলেন। ধন্যবাদ আপনাকে। আরও লিখুন। শুভ কামনা নিরন্তর 🌹🌹
উর্বশী
সাবিনা ইয়াসমিন আপ,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা৷। আপনার চিন্তাধারার সাথে সহমত পোষণ করছি। অফুরান শুভ ক
উর্বশী
সাবিনা ইয়াসমিন আপ,
অফুরান শুভ কামনা। ভাল থাকুন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
এটাই জীবন — চোখের পলকে কাছের মানুষ গুলো একে একে পর হতে লাগলো।বাস্তবতা কি জিনিস কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা ষোড়শী। বোনেরা সাপোর্ট দিয়েছে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে।
ধন্যবাদ।
উর্বশী
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী ভাইয়া,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অফুরান শুভ কামনা।
তৌহিদ
এতসুন্দর করে ঘটনার বর্ননা দিয়ে লেখাটি লিখেছেন, পড়ে আবেগতাড়িত হলাম আপু। কিছু স্মৃতি সারাজীবন বুকে কাঁটা হয়ে বিধে থাকে। নারীর জীবনে তার ভালোবাসার জীবনসঙ্গী হাড়ানোর মত বেদনা আর কিছুতেই নেই।
লেখাটি প্যারা করে দিলে পড়তে আরো সুবিধে হতো কিন্তু। ভালো থাকুন সবসময়!
উর্বশী
তৌহিদ ভাইয়া,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
আপনার উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করবো। খুব ভাল থাকুন,শুভ কামনা।
তৌহিদ
উপদেশ নয় আপু! সহব্লগারকে সাহায্য করা এটি। আপনাকে উপদেশ দেয়া আমার সাজেনা ☺
উর্বশী
তৌহিদ ভাইয়া,
অবশ্যই সহযোগিতা করবেন।আমার ভুল গুলো শুধরে নিতে পারবো। আপনি এবং আপনারা গুনীজন। অনেক কিছুই জানা ও শেখার আছে ভাইয়া। আমি চাই সঠিক পথ অবল্মবন করতে।সঠিক জিনিস শেখা, তাকে মূল্যায়ন করা।অনেক ভাল থাকবেন। অফুরান শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
লেখাটি আলোড়িত করলো।
ভালো থাকবেন। শুভ কামনা
উর্বশী
আরজু মুক্তা আপু,
আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
খুব ভাল থাকুন, অফুরান ভালোবাসা।