মধ্যরাতের নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙ্গেচুড়ে দিয়ে অনেক দূরের ব্রিজটা ঢং ঢং শব্দ করে ওঠে। দূর থেকে ড্রাইভারের অযথা হর্ণ কি জানি কোন শ্রমিকের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয় পুরোনো লক্কড়-ঝক্কড় ট্রাক অথবা ল্যান্ড রোভার। আর আমার চলছে ঘুমের সাথে প্রতিরাতের যুদ্ধ। ভুল বলে ফেললাম, যুদ্ধ নয়, রাতের সাথে বন্ধুত্ত্ব। মায়াময়ী বন্ধুত্ত্ব। সঙ্গী পাশে রসায়ন আর গান, নয়তো বীজগণিতের সূত্র আর গান। পুরো খোলা উঠোন জুড়ে আকাশের সামিয়ানা টানানো আর তারাদের আলো-আঁধারি আমাকে বলে দেয়, চাইনা এ জীবনে মোমের আলোয় কেউ আমাকে দেখুক। এমন সুন্দরী রাত্রি কি মোমের আলো সাজিয়ে দিতে পারে?
টুপটুপ করে ঝরে পড়ে শিশির টিনের চালে। চৌকিদারের গোপন ঘুমের বারোটা বাজিয়ে আমি নিশ্চিন্তে পায়চারী করি, আহারে বেচারা! ওদিকে আমার বিছানার চাদর টানটান, গুছিয়ে রাখা লেপের ওম, একজন রবীন্দ্রনাথ দেয়ালে ঝুলে দেখছে ঘরের সাজ। আমি দেখছি আকাশ, রাত্রি, নীরবতা মাখছি। এ নীরবতা আমি জানি হাহাকার করবে জমানো আনন্দের মধ্যে দিয়ে। নাহ, এক মুঠো হাসি রেখে দেবো আজীবন। সে যদি না-পাওয়া হয় তাও, যদি যন্ত্রণায় পুড়ে যায় ভেতরের অলি-গলি, তাও। কারণ নিঃশ্বাসে যে জমে থাকবে চায়ের ফ্যাক্টরী থেকে ভেসে আসা চায়ের ঘ্রাণে, সাথে বুক ফাঁটানো আর্তনাদ মেশিনের। সে নিঃস্তব্ধতাকে ঘিরে তো থাকবেই।
যেমন আমার থাকবে রবীন্দ্রনাথ এবং হাসি।
শমশেরনগর চা’ বাগান, মৌলভীবাজার
১৯ নভেম্বর , ১৯৮৯ ইং।
৩৫টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
খুব ভাল লাগলো। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂
শুন্য শুন্যালয়
যাদের চাএর ফ্যাক্টরির শৈশব নেই, সুঘ্রান নেই চাএর, তাদের জন্য রইবে ময়েজ স্যারের লম্বা নাক আর হাতের লাঠি, হাসি সেতো ভয়েই গায়েব।
বন্ধুত্ব বেশি গাঢ় হলে সারাদিন ঝিমুতে হবে, তবে এমন লেখার জন্য আমরা সব ভুলে যেতে রাজি। আপু সত্যি কথন অনেক সুন্দর, এখন থেকে সবসময় সত্যি বলবেন। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
ওটাই তো কথা! রাত জেগে কাটিয়েছি কতো, দিনেও ঘুম আসতো না। ঘুম আর খাওয়ায় কে সময় নষ্ট করে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা হবে কি করে তবে? এই চিন্তাটাই কাজ করতো তখন।
আচ্ছা আমি ময়েজ স্যারের গল্প শুনতে চাইইইইইইইইই। -{@
শুন্য শুন্যালয়
কোথায় শমসেরনগরের চা এর সুঘ্রান আর কোথায় ময়েজ স্যার? তার লম্বা নাক ভোতা করে দেব এই সুঘ্রানে নাক গলালে।
নীলাঞ্জনা নীলা
এ দেশে এসে আজকাল চায়ের ঘ্রাণ পাই। ঘাস কাটার পর একধরণের গন্ধ নাকে আসে, একেবারে চা’ পাতার গন্ধ। 🙂
জিসান শা ইকরাম
হাঁসি বজায় রাখুন
স্বপ্নকে বাস্তব করুন……
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা হাসির উপরে চন্দ্রবিন্দু কেন? তুমি দেখি নাঁকি সুরে কথা বলা শুরু করেছো ভূতের গল্প লিখতে লিখতে।
স্বপ্ন তো বাস্তব। আমার বুড়া(রবীন্দ্রনাথ) আর হাসি দুটোই আছে। থাকবেও। 😀 সেনসোডাইন টুথপেষ্ট এবং ওরাল-বি টুথব্রাশ ব্যবহার করি যে! :D)
অনিকেত নন্দিনী
শৈশব আর কৈশোরে বাঁচিয়ে রাখা এক মুঠো হাসিতে সারা জীবন পার করা জানলে আমিও এক মুঠো হাসি বাঁচিয়ে রাখতাম। 🙂
নীলাদির লেখায় সবসময়েই মুগ্ধতা খুঁজে পাই। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি তো ভাবতেই থাকি কিভাবে লেখেন আপনি? (3
আর হাসিতে হাসি পাওয়া যায় যে। মুখ ভার করে রাখলে আহারে-উহারে এসব সবাই দেয়। তাই সবসময় সেনসোডাইন বিজ্ঞাপন। 😀
সিকদার
প্রকৃতির এমন রূপ আপন আঁখিতে দেখে সুখ । তাইত আপনার লেখনীতে সেজেছে অনন্য অপরূপ ।
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ!
আহ!
এমন দারুণ ছন্দ
সারা মনে ছড়িয়ে গেলো সুগন্ধ। -{@
প্রজন্ম ৭১
ভালো লেগেছে আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
অনেক অনেক ধন্যবাদ। -{@
অরণ্য
“আমি দেখছি আকাশ, রাত্রি, নীরবতা মাখছি।” 🙂
একটা গান মনে পড়ল।
কোন এক সুন্দরী রাতে…
https://www.youtube.com/watch?v=oOsVArE-f-U
আমার খুব পছন্দের ছিল গানটি, আছে এখনও। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার তো এখনও। সেলফোনে গানটা আছে। সামিনা নবীর গান।
সবুজ অরণ্য গান ছড়িয়ে দিচ্ছে, আমি ধন্য। -{@
খেয়ালী মেয়ে
রবীন্দ্রনাথ এবং হাসি এদুটো যার আছে তার আর কি চাই ;?
নীলাঞ্জনা নীলা
সেটাই তো। আর সাথে যদি থাকে খেয়ালী মেয়ে, সোনায় সোহাগা। -{@
স্বদেশী যোদ্ধা
” রসায়ন ” শব্দটা শুনলে আমার মোটাতাজা কতগুলো বই চোখের সামনে ভেসে ওঠে! আর চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার কি যে প্রিয় বিষয় ছিলো। আসলে বিষয়টা প্রিয় হয়ে উঠেছিলো আমার ভাই শোভনদা আর বিশ্বজিৎ স্যারের জন্যে।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে। 🙂
সীমান্ত উন্মাদ
জীবনের গতি পথে জন্ম নেওয়া সপ্ন বাস্তবায়নের জন্য হাঁসি ধরে রেখেই এগোতে হয় আমাদের। আমার কাছে জীবন মানে হাসির কান্নার এক যৌথ মিলন মাত্র।
আপু আপনার লিখায় স্মৃতি কথনের মুগ্ধতার সাথে সাথে প্রকৃতির একটা সঙ্গ পাই। তাই উন্মাদেরও বেশ ভালো লাগে আপনার লিখা। শুভকামনা জানিবেন নিরন্তর।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রকৃতির সাথে আমার বন্ধুত্ত্ব জন্ম থেকেই। চা’ বাগানে জন্মেছি, বড়ো হয়েছি। স্কুল-কলেজ ওখানেই। ইট-কাঠ-পাথর ওই পথেই ভালো লাগে।
আর ভালোবাসা এতো সুন্দর একটা মন্তব্যের জন্যে। -{@
আশা জাগানিয়া
পড়তে পড়তে একদিন আপনার মত এত ভালো লিখতে পারবো 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
এ কি কথা! 😮
বোকা বনে গেলাম, এটা কি হলো? :p
ছাইরাছ হেলাল
নিঃসঙ্গতার যে চিত্র তুলে ধরলেন তাতে ভয় পেতে পারে যে কেউ।
অবশ্য নিস্তব্ধ ভালোবাসাও আছে প্রকারন্তরে।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভয়!!!
কেন?
আমি অবশ্য শাকচুণ্ণী, তবে সবাইকে ভয় দেখাইনা। 😀
“ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি!” -{@
ছাইরাছ হেলাল
ধুর, আপনি শাঁকচুন্নি হতে পারেন্না, কিছুতেই।
“ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কি!” একদম খাঁটি কথা।
নীলাঞ্জনা নীলা
আঁরেঁ এঁটাঁ কিঁ বঁললেঁন?
খাঁটিঁ শাঁকচুঁণ্ণী। হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ… 😀
লীলাবতী
ভালো লেগেছে নীলাদি।আমাদের নীলাদি কি ব্যাস্ত হয়ে পরেছেন?কম দেখা যায় আজকাল।
নীলাঞ্জনা নীলা
আসলেই খুব ব্যস্ত। আর বাসে বসে পড়তে পারি, কিন্তু ব্লগে কমেন্ট করা যায়না। আমি কিন্তু সকলের পোষ্টই বাসে বসে পড়ি। আর ল্যাপু খুললে মন্তব্য করি। ভালো বুদ্ধি না?
লীলাবতী দিদির জন্যে -{@
অরুনি মায়া
নির্ঘুম রাতের বর্ণনা। সারা রাত জেগে জেগে এইভাবে ভূতের মত ঘুরে বেড়াতে বুঝি তোমার বুড়োরে ঘরে একা ফেলে। নাহ ইডেনের মেয়েদের মনে মায়াদয়া কিচ্ছু নেই।
কিন্তু তারা আবার লিখতে পারে ভাল। আমিতো ভেবেই পাইনা এই ক্যাডার গুলো মারামারি করত কখন আর লিখতই বা কখনো ;?
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু গো এই লেখা বিয়ের অনেক আগের। নীচের তারিখ দেখোনি? ১৯৮৯ সালের, যখন আমি এস.এস.সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি পরের বছরের জন্যে।
হুম আমি রাত-জাগা পাখী ছিলাম গো আপু। আর চা’ বাগানের রাতের কথা কি বলবো তোমায়। জীবনের সেরা দিনগুলো ওখানে বাস করে স্মৃতি হয়ে।
নীলাঞ্জনা নীলা
আর হ্যা আপু এই পোষ্টটা কিন্তু আমার ডায়েরী থেকে নেয়া।
প্রহেলিকা
অদ্ভুত সুন্দর একটি লেখা, না এ লেখা নয়। বরফের মতো জমাট বাঁধা স্বচ্ছপ্রেম। রাতের সাথে প্রেম। আপনি আরো বেশ গুছিয়ে বলেছেন। প্রশংসা আপনার প্রাপ্য।
ওদিকে আমার বিছানার চাদর টানটান, গুছিয়ে রাখা লেপের ওম, একজন রবীন্দ্রনাথ দেয়ালে ঝুলে দেখছে ঘরের সাজ।
ভাবছি লাইনগুলো কিভাবে লিখলেন এতো চমৎকার করে!! আমি অভিভূত! মেদহীন শব্দ, শব্দের বাহুল্যতা নেই অথচ যা বলতে চেয়েছেন তা কাচের মতো স্বচ্ছ। সবটুকুই যেন বলে ফেলেছেন। লেখাটিকে নিজেরই মনে হয়েছে।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি এই লেখাটিকে আপনার লেখার মন্তব্য হিসেবে দিলাম। আর আপনি কিনা এতো সুন্দর একটা মন্তব্য দিয়ে ফেললেন?
এখন আমি কি করবো? কি লিখবো? উফ ভেবে পাচ্ছিনা।
ওটা কিন্তু আমার রোজনামচার খাতার পাতা থেকে নেয়া। সম্পূর্ণ বর্ণনা সব একেবারে জীবন্ত, একটা শব্দও কল্পনা থেকে নেয়া নয়। ভাবছি রোজনামচার পাতাগুলোকে আবার পড়বো।
এতো সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। 🙂