
আয়নায় চোখ পড়তেই হকচকিয়ে উঠলো নীরা। বিধবা মধ্যবয়সী নারী নীরা অনেক দিন বাদে আয়নায় দেখছে নিজেকে। চিনতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ এই কি সেই নীরা। সুশ্রী সুন্দরী সিঁথি জোড়া সিঁদুর লেপ্টানো বালিকা বধূ এক মাঝবয়সী নারী। চোখে মুখে বয়সের ছাপ রুক্ষ খুস্কো চুলে দু একটাতে ধরেছে পাক। আসলে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বয়স্কা দেখাচ্ছে নীরাকে। নিজের প্রতি অযত্ন অবহেলায় কয়েকটা বছর পর করে এসেছে নীরা।
স্মৃতি পটে আস্তে আস্তে ভেসে উঠছে প্রায় দুই যুগ আগের অতীতে।
তখন নীরা ছিলো ১৭/১৮ বছরের বালিকা। ধন কুবের অশোক চ্যাটার্জীর একমাত্র কন্যা নীরা চ্যাটার্জী। নীরা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেনীর ছাত্রী। কলেজ পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রী হঠাৎ নিজে আবিষ্কার করলো প্রেয়সী রূপে। তারই সহপাঠী আদিত্য রায়ের। গরীব দুঃখীনি মায়ের একমাত্র অবলম্বন এই আদিত্য। পড়ালেখায় বেশ ভালো।
নীরা যখন আদিত্যকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় আদিত্য তখন না করে। নীরাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে এটা সম্ভব নয়। তোমার আর আমার মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। নীরাকে এও বলে কখনো দেখেছো তেল আর জলে মিশতে। পাগলমী করো না নীরা। এতে অশান্তি সৃষ্টি হবে। বদমেজাজি একরোখা নীরা কোনো অশান্তির ভয়ের তোয়াক্কা করে না। তার একটাই কথা আমি তোমাকে ভালোবাসি আর পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই আমাকে তোমার থেকে আলাদা করে। আমি তোমাকে চাই। আমি বাবাকে আজই বলবো তোমার কথা।
এমন ছেলেমানুষী করো না নীরা। এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। তোমার বড়লোক বাবা আমাকে তার একমাত্র মেয়ের জামাই করবে না। কোনো বাবাই তা করবে না। এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে কোনো বাবা তার মেয়েকে ঠেলে দেবে না।
প্লীজ বোঝার চেষ্টা করো।
নীরা আদিত্যের কোনো কথায় শুনলো না। নীরা তার বাবাকে সব বললো। আদিত্যের সম্পর্কে শোনার পর অশোক চ্যাটার্জী যেনো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। উঠারই কথা,,,
অশোক:এমন একটা কথা তুমি আমাকে বলতে পারো ভাবিনি কখনো। এতোটা উদ্ধত তোমার হয় কি করে সেটাই ভাবছি?
নীরা: কাউকে ভালোবাসা অন্যায় নয় বাবা। আমি ভালোবেসেছি পাপ করিনি। আমি আদিত্যের সঙ্গে ভালো থাকবো বাবা। তুমি মেনে নাও এ সম্পর্ক।
অশোক: আমি বড়জোর কোনো পথের ভিখারিকে ভিক্ষা দিয়ে সাহায্য করতে পারি কিন্তু সেই ভিখারিকে মেয়ে দিয়ে জামাই করতে পারিনি।সোসাইটিতে আমার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে সেটা নষ্ট করতে পারি না আমি। নীরা আমি তোমাকে জোর করে আটকাবো না কিন্তু তুমি যদি তোমার সিদ্ধান্তে অটল থাকো তাহলে আমি তোমাকে আমার সন্তান বলে পরিচয় দিতে পারবো না। আমি বাধ্য হবো তোমাকে ত্যাগ করতে। ভেবে দেখো তুমি কি করবে?
নীরা :এ আমি কোন বাবাকে দেখছি? যে মানুষকে মানুষ হিসেবে নয় ধনসম্পদ দিয়ে মূল্যায়ন করছে। ঐ কি সেই বাবা যে আমার আর্দশ ছিলো?
আমি যাচ্ছি বাবা বলেই নীরা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। নীরা আদিত্য কে নিয়ে চলে গেলো কাজী অফিসে। বিয়ে করে আদিত্যের বাড়িতে এলো। আদিত্যের মা অনেক খুশি। এতো মিষ্টি ছেলের বউ হয়েছে। কিন্তু আবার ভয়ও পেলো বড়লোকের মেয়ে ঝোঁকে পড়ে এমন কাজ করেছে। দুদিন পর আবার চলে যাবে না তো?
আজ ওদের কালরাত্রি। তাই কেউ কারো মুখ দেখবে না। নীরা শুয়ে পড়লো আদিত্যের মায়ের কাছে। শ্বাশুড়ি মা নীরাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে দিতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আজ কি নীরার ঘুম আসে? এই প্রথম বাবাকে ছেড়ে নীরা রাত্রি যাপন করছে। বাবার জন্য প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। বাবার কথা মনে করে চোখের পাতা ভিজে গেলো। আদিত্যের মা খেয়াল করলো ব্যাপারটা। জিজ্ঞেস করলো বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে। নীরা বললো না মা আমি ঠিক আছি। শ্বাশুড়ি আবার বললেন দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার বাবা তোমাদের মেনে নেবে।
পরের দিন আদিত্য তার সাধ্যমতো বৌভাতের আয়োজন করলো। নীরার জন্য লাল টুকটুকে একটা শাড়ি কিনেছে। এই শাড়ি পরে নীরা আসবে আদিত্যের ঘরে। আহ কতো সুন্দর লাগবে আমার নীরাকে! যদিও শাড়িটার দাম কম কিন্তু এমন সোনার অঙ্গে উঠে এ শাড়িও হবে স্বর্ণের মতো দামী।
নীরা লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে এলো আদিত্যের ঘরে। আদিত্য হতভম্ব হয়ে দেখছে নীরাকে। হায় ঈশ্বর এমন সুন্দর মেয়ে আমার বউ! নীরা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীরা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
আদিত্যের হঠাৎ মনে খারাপ হয়ে গেলো। এমন দেবী কোনো রাজপ্রাসাদে মানায় দরিদ্র কুটিরে নয়। এতো বড় ভুল করলাম কি করে? এই ফুলের মতো মেয়েটা দারিদ্র্যতার সাথে সংগ্ৰাম করবে কি করে? ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো আমার জন্য। তুমি আমাকে ক্ষমা করো ঈশ্বর।
হাতজোড় করে আদিত্য বললো দেবী আমাকে ক্ষমা করো তোমাকে এই জীর্ণ কুটিরে স্থাপন করার জন্য। অট্টালিকা ছেড়ে কোনো ভ্রমে এলে মোর এই জরাজীর্ণ ভাঙ্গাচুরা ঘরে। আদিত্য নীরার পায়ে হাত দিয়ে যাবে এমন সময় চেঁচিয়ে উঠলো নীরা। ছিঃ ছিঃ করছো কি! যা দুষ্টু কোথাকার। নীরা আদিত্যের বুকে মাথা রেখে বলে এখানেই আমার সমস্ত সুখ আদিত্য। এ বুকে মাথা রেখেই যেতো মরতে পারি। আমার ঐশ্বর্য নয় ভালোবাসা চাই আদিত্য, ভালোবাসা।
হঠাৎ আদিত্যের বুকে ব্যথা শুরু হলো। নীরা কিছু বুঝে উঠার আগেই আদিত্য পরলোকগমন করলো। নীরা চিৎকার দিয়ে উঠলো। আদিত্যের মা ঘরে এসে অজ্ঞান হয়ে গেলো। দেখতে দেখতে আদিত্যের দাহ শ্রাদ্ধ শেষ হলো।
কথায় বলে সুখের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তা বলে এতো দ্রুত? একটা রাতও পেলো না
নীরার বাবা এসেছিলো মেয়েকে নিতে। নীরা যায়নি
আদিত্যের মা চেয়েছিলো নীরা আবার বিয়ে করে সংসার করুক। নীরা তাতেও রাজি হয়নি। এক এক করে নীরার বাবা, শ্বাশুড়ি সবাই মারা গেলেন।
নীরা এখন একা সম্পূর্ণ একা। যদিও নীরা একটা মেয়ে রেখেছে তবুও সে একা।
২১টি মন্তব্য
আরজু মুক্তা
আমরা, নারীরা কি শুধু স্যাকরিফাইজ করার জন্য জন্ম গ্রহণ করেছি?
সুরাইয়া পারভিন
কিছু স্যাক্রিফাইস এ তো অনেক সুখ থাকে আপু।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন 💓
সাবিনা ইয়াসমিন
একদিনের সুখের স্মৃতি নিয়েই সারাজীবন পার করা যায়, যদি সুখটা কাউকে প্রকৃত সুখী করতে পারে। নীরারা একরাতের সুখ নিয়েই আজীবন একাকীত্বকে সঙ্গী করে নেয় এমন আদিত্যের ভালোবাসায়।
শুভ কামনা 🌹🌹
সুরাইয়া পারভিন
একদম তাই আপু
কৃতজ্ঞতা সহ আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন 💓💓
নুর হোসেন
নারীদের সাঁজহীন দেখতে ভালো লাগে-
বিয়ের সময় নারীদের সাঁজগোজ বন্ধ করার দরকার।
আমার মন্তব্যের সাথে লেখার কোন মিল নেই।
গল্পে++
সুরাইয়া পারভিন
হা হা হা হা হা
চাইলে অনশনে বসতে পারেন।আমি সাথে আছি ভাইয়া 😜😜
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
সুপায়ন বড়ুয়া
খুশী হতাম ভাই
যদি খুশীর সময়
আটকে রাখা যায়
তা যে দ্রুত পুড়ায় !
সুরাইয়া পারভিন
চমৎকার লিখেছেন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সুন্দর হয়েছে আপু। আরো লিখুন
সুরাইয়া পারভিন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন দিদি 💓
কামাল উদ্দিন
সময়ের প্রলেপে সব দুঃখ ব্যথা ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে আসে। প্রেম ভালোবাসার জন্য একটা জীবন নষ্ট করে দেওয়া বোকামীরই নামান্তর। এভাবে একটা জীবন পার করা সহজ কথা নয়। মনটা ভরাক্রান্ত হলো………….
সুরাইয়া পারভিন
হয়তো কারো কাছে এটাই সুখ
ভালোবাসার স্মৃতি আঁকড়ে বাঁচা
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
কামাল উদ্দিন
হুমম, হয়তো তাই
জিসান শা ইকরাম
সুখের সময় আসলেই খুব দ্রুত চলে যায়,
তবে এই গল্পে খুব বেশী দ্রুতই চলে গেলো।
আপনার গল্পের উপস্থাপনা বেশ ভালো,
একটানে কোনো বিরতি ছাড়াই পড়া হয়ে যায়।
” অশোক: এ আমি কোন বাবাকে দেখছি? যে মানুষকে মানুষ হিসেবে নয় ধনসম্পদ দিয়ে মূল্যায়ন করছে। ঐ কি সেই বাবা যে আমার আর্দশ ছিলো? ” – এখানে অশোক এর পরিবর্তে নীরা হবে। এডিট করে দিয়েন।
শুভ কামনা।
সুরাইয়া পারভিন
ঠিক করে নিয়েছি
কৃতজ্ঞতা অশেষ
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
তৌহিদ
নারী জীবনের কিছু তিক্ত সত্য গল্পে ফুটে তুলেছেন। নীরাদের জন্মই হয় বুঝি সব ত্যাগ করার জন্য। সমাজের নীরারা বেঁচে থাকে সামান্য ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে।
ভালো লিখেছেন আপু।
সুরাইয়া পারভিন
হুম অনেকেই থাকে
আবার অনেকেই না
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
ছাইরাছ হেলাল
এটি একটি বিরল ভালোবাসার গল্প।
সুরাইয়া পারভিন
জ্বী এমন ভালোবাসা সত্যিই বিরল
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
মনির হোসেন মমি
হঠাৎ মৃত্যু
অনেক সময় এমনি হয়
সূখের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেলে হৃদপিন্ডে ঝড় বয় সেই ঝড়ে কেউ টিকে যায় কেউ বা মরে যায়। চমৎকার গল্প।
সুরাইয়া পারভিন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
কৃতজ্ঞতা অশেষ