সামাজিক অবক্ষয়রোধের এখনই সময়

তৌহিদুল ইসলাম ১ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১০:৫১:২৩পূর্বাহ্ন সমসাময়িক ৪৫ মন্তব্য

সামাজিক অবক্ষয় কথাটি এখন বহুল আলোচিত একটি বাক্য। সোস্যাল মিডিয়া, অনলাইন ও প্রিন্ট সংবাদ মাধ্যম, টিভিতে নিত্যদিন খুন, ধর্ষন, রাহাজানি, শ্লীলতাহানি প্রভৃতি খবরে একদিকে সমাজের নারীরা যেমন শংকিত তেমনি সামাজিক দায়বদ্ধ ব্যক্তিবর্গরাও সামাজিক অবক্ষয়ের এমন খবরে নিঃসন্দেহে ভীত ও দিশেহারাবোধ করছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমরা লজ্জিত হচ্ছি, অপরাধী আইনের আওতায় আসছে, সাজা হচ্ছে কিন্তু অপরাধ কমছে না। প্রশ্ন হলো সামাজিক অবক্ষয়ের কারন কি এবং সমাজে এমন নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটছে কেন?

সম্প্রতি (গত ৩০ সেপ্টেম্বর) বরগুনায় দিনেদুপুরে রিফাতকে বর্বরোচিতভাবে কুপিয়ে হত্যার বহুল আলোচিত সেই মামলার রায়ে বিজ্ঞ আদালত রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন। রিফাত হত্যার অন্যতম প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুর্বেই ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। স্বামীর হত্যাকান্ডে মিন্নির জড়িত থাকার প্রমান ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি এবং বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত ও প্রমাণক আদালতে প্রতীয়মান হয় যে মিন্নির বিবাহবহির্ভূত প্রেমের বলীর শিকার হয়েছেন তার স্বামী রিফাত। অথচ মিন্নি রিফাত দু’জনেই ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। মিডিয়ার কল্যানে এখন সকলেরই এসব তথ্য জানা।

বর্তমান সময়ে মানুষের সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় যে হারে ঘটে চলেছে, তা একটি জাতির জন্য খুবই উদ্বেগজনক। প্রকাশ্য দিনের আলোয় রিফাত হত্যাকান্ডের মত এমন ঘটনা ঘটলো, ভিডিও করা হলো, ঘটনস্থলে লোকজন দাঁড়িয়ে থাকলো, অথচ কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। এটাও সমাজের অবক্ষয়েরই চিত্র। সমাজে দুর্নীতি, বিচারহীনতা, অন্যায় করেও পার পেয়ে যাওয়া, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার এবং মাদকাসক্তি ইত্যাদিই হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারন। সামাজিক অবক্ষয়ের এই চিত্র যদি অব্যাহতভাবে চলতে থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এ দেশের আপামর জনসাধারণের নৈতিক স্খলন রোধকরা দুষ্কর হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে সুস্থ্য বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম পার্কগুলির পরিবেশ এমনই নেতিবাচক যে সাধারণ মানুষ চলাফেরায় ইতস্ততবোধ করতে বাধ্য হয়। সংস্কৃতির ছোঁয়ার অপসংস্কৃতির আগ্রাসী ভূমিকার কারনেও সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে আকাশ সংস্কৃতির কিছু কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠানের (হিন্দি ও বাংলা সিরিয়াল) যা কিছু সম্প্রচার করা হয় তা থেকে সমাজের মানুষের তেমন কিছুই শেখার নেই।

বিনোদনের নামে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক, অসম প্রেম, পরিবারের সদস্যদের নিজের স্বার্থসিদ্ধতা, অনৈতিক, অমানবিক কার্যক্রম, নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকাণ্ড ইত্যাদি শিক্ষাই মানুষ বেশী শিখছে। ইউটিউবে অসামাজিক কুরুচিপূর্ণ দেশীয় নাটক, গান কিংবা অসুস্থ বিনোদন আমাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এর ফলে তা সমাজের মাঝে কুৎসিত আকারে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে।

হাতের নাগালে মোবাইল যা প্রযুক্তির কল্যানের চেয়ে সামাজিক অকল্যানের জন্য অনেকাংশেই দায়ী। আমরা আমাদের সন্তানকে এসবের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে কতটুকু শিক্ষা দেই তা কি কেউ একবারও ভেবেছি? স্কুল, কলেজের পাঠ্যবিষয়ে নামমাত্র কিছু পরিচ্ছেদ সামাজিক বিজ্ঞান পড়ানো হলেও অবক্ষয় থেকে উত্তরণের শিক্ষা ঠিক কতটুকু দেয়া হয় বা আদৌ সঠিকভাবে দেয়া হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করাটাও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক মুহূর্তেই সাজানো-গোছানো সোনার সংসারকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রীর প্রেমিক কর্তৃক স্বামী খুন বা স্বামীর প্রেমিকা কর্তৃক স্ত্রী খুনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। রিফাত, মিন্নি, নয়নের ত্রিভুজ প্রেমের কারনেই কিন্তু রিফাত হত্যাকান্ড ঘটেছে। যার চরম মুল্য দিতে হচ্ছে এই দুই পরিবারকে।

মানুষের চোখে প্রেম নামক বস্তুটি এখন ভোগ্যপণ্যে পরিনত হয়েছে। অবৈধ সম্পর্কের জেরে প্রায়ই পারিবারিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে। সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছেন আমাদের বাবা-মা, বোন, স্ত্রী-সন্তান সবাই।  তদন্তে এর পেছনে বের হয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর পরকীয়ার ঘটনা। পরকীয়ার কারণে স্ত্রী কর্তৃক স্বামী বা স্ত্রী খুন, মা-বাবা কর্তৃক সন্তান হত্যার মতো লোমহর্ষক ঘটনার খবর গোটা জাতির বিবেককে নাড়া দেয় প্রায়ই।

বর্তমান সময়ে সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়ঙ্কর আগ্রাসী এক কালো থাবার আগ্রাসনে নিপীড়িত হচ্ছি আমরা। এই বেড়াজাল থেকে বেরোনোর রাস্তা আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। এখনই সময় আমাদের শিশু কিশোরদের নৈতিকতা মুল্যবোধের শিক্ষা দেয়া। কাল আপনার শ্লীলতাহানি হবেনা এর দায়ভার কিন্তু কেউ দিতে পারে না।

সামাজিক অবক্ষয়ের এই ক্রমাগত অবনতির কারন খুঁজে বের করে রাষ্ট্রের, পরিবারের, সমাজের সকল দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সমাজের সর্বোস্তরের মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। নিজের মুল্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য সুস্থ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে হবে।

আমরা রিফাতের মত আর কোন দাম্পত্য হত্যাকান্ড দেখতে চাইনা। মুল্যবোধ অবক্ষয়ের শিকার হয়ে আর কোন মিন্নির ফাঁসির রায় হোক তাও চাইনা। চাইনা চোখের সামনে ধর্ষিত হোক আমাদেরই মা বোনদের কেউই। আমরা একটি সুস্থ সমাজ চাই যেখানে নারীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করবে। আমরা চাই মুল্যবোধ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের শিশু, কিশোর তরুণ, যুবকেরা নিজেদের নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করবে। সামাজিক অবক্ষয়রোধে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করার বিকল্প আর কিছুই নেই।

[ছবি – নেট থেকে নেয়া]

১১১১জন ৮৬১জন

৪৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ