অবশেষে রাঙিয়ে দিয়ে চলেই গেলো ঋতুরাজ। উত্তাল হাওয়ার সাথে শীতের তীব্রতাকে কমিয়ে দিতে গ্রীষ্মঋতুর আগমন হলো আজ। বাংলা বছর শুরু। কানাডায় বেশ বড়ো করেই নববর্ষ পালিত হয়। টরেন্টোতে এবার যাওয়া হয়নি, আর আমাদের হ্যামিল্টনে সামনের শনিবার হবে অনুষ্ঠান। তাই অপেক্ষা।
তবে এক সময় ছিলো এমন যে কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেতো রিহার্সাল। সেই দিনগুলো জীবনে এসেছিলো বলেই হয়তো এখন আর কোনো আফসোস নেই। এ জীবনের সাথে অনেক সুন্দর দিন যে যুক্ত। আমার সব থেকে সুন্দর বৈশাখ কেটেছে শমশেরনগর চা’ বাগানে। ওখানে রমনা বটমূল ছিলোনা। কিন্তু ছিলো বিশাল বিশাল বৃক্ষ ক্লাবঘরকে ঘিরে। সাংস্কৃতিক কোনো সংগঠন ছিলোনা, কিন্তু ছিলো সাধারণ মানুষের অসাধারণ উপস্থাপনা। বাগানের প্রতিটি মানুষ অপেক্ষায় থাকতো এই দিনটির জন্যে। দেশের যে প্রান্তেই থাকতাম না কেন, এখানে না এসে পারতাম না। চুম্বকের মতো যেনো টানতো। ১৪০০ বাংলায় সিলেট ছিলাম, যদিও বেড়িয়েছি-ঘুরেছি। তাও বিকেলবেলায় বড়ো অসহায় লেগেছিলো।
কি উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হতো পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান। এই একটা অনুষ্ঠান সময়ের ঠিক আগেই শুরু হয়ে যেতো। এই অনুষ্ঠানটার জন্মের পেছনে আমার মামনির অবদান সবথেকে বেশী। তখন পহেলা বৈশাখ এলে শুধু বাগানের ষ্টাফেরাই আলোচনামূলক অনুষ্ঠান করেই শেষ করে দিতো। মামনি একদিন বললো বাপিকে, এটা কেমন? শুধু ষ্টাফেরাই কেন, তাদের পরিবারও তো পারে অংশ নিতে? মনে পড়ে ১৯৮৬ সালে প্রথম শুরু হয় বৈশাখী অনুষ্ঠান। তাও ছোট্ট করে। দিনে দিনে এর পরিধি আরোও বাড়তে থাকে। ক্লাবঘরে জায়গা হতোনা দাঁড়িয়ে থাকার। একসময় বাসার সামনের মাঠেও। সিকদার আঙ্কেলের বাসার সামনে অনুষ্ঠানটি হলো ২০০২ সালে। তখন আমরা পুরাতনের পথে। নতূনদের এই উৎসাহ দেখে মনটা ভরে গিয়েছিলো। স্বার্থক হলো।
অনুষ্ঠান শুরু হতো শঙ্করদার উদার কন্ঠের উপস্থাপনায়। প্রথমেই ছোট্ট করে আলোচনা অনুষ্ঠান। ভয় বা বিরক্তি পাবার কোনো অবকাশ নেই। আসলেই ওটা খুবই ছোট করেই থাকতো। কাউকে বলে দিতে হতোনা, নিজেরাই বিরক্তিকর হওয়া থেকে সরিয়ে নিতেন। আর এটাই ছিলো আমাদের বাগানের অনুষ্ঠানগুলোর বিশেষত্ব। যাক আমাদের সময়ে গান হতো অবশ্যই রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া এবং আধুনিক গান। যদিও এসব ছাড়া আমাদের বাংগালীর অস্তিত্বই তো নেই। তবুও বলছি কারণ নজরুল গীতিতে রুবিনা নামের মেয়েটির অসাধারণ পরিবেশনা। এতো দারুণ গাইতো যেমন নজরুল গীতি, তেমনি ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া। অনেকের গানই এ জীবনে শুনেছি কিন্তু ওর মতো কেউই গাইতে পারেনি, “পদ্মার ঢেউরে মোর শূণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা রে…।” আর রবীন্দ্রকে উপস্থাপন করতাম আমি-মামনি আর ছিলো কুমকুম আপু। ছোটদের ছড়া থাকতো। উফ কি কিউট কিউট পিচ্চিগুলোর আধো আধো উচ্চারণ। এখনও কানে আসে যেনো। মাইকের নাগাল পেতোনা, তাই হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো। কেউ কেউ আবার ভয়ে চুপ। আর আমি যেতাম, পিঠে হাত বুলিয়ে দিতাম। জানিনা কেন বাগানের সবগুলো বাচ্চা আমায় খুউব ভালোবাসতো। আসলে ওদের সাথে গল্প-লুকোচুরী খেলার সঙ্গী হতাম যে! যাক নাচও হতো। ওহ বলতে ভুলে গেছি, অনুষ্ঠানের শুরুতে বৈশাখের আগমনী গান “এসো হে বৈশাখ এসো এসো…” এটা তো হতোই। যারা অনেকেই জানতো না, তারাও জেনে গেছিলো। সবথেকে আকর্ষণীয় ছিলো বাপি আর সিকদার আঙ্কেলের বিখ্যাত গান “সোহাগ চাঁদবদনীধনি নাচোতো দেখি…” তার সাথে দুজনের নাচ। অনেক গান গাইতো দুজনে মিলে। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হতো এই গানটির মাধ্যমেই। এদের জুটিটা সবথেকে সুপারহিট জুটি। ওহ শেষের আগে আরোও কিছু কথা বলার আছে। আমাদের একটা সমিতি ছিলো, নাম “আমরা ক’জন মহিলা সমিতি।” সমিতির পক্ষ থেকে আমরা চারজন রীতা-শম্পা-কুমু আপু-আমি ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। প্রথমে অবশ্য বাগানের ষ্টাফের সন্তান হিসেবে, তারপর সমিতি। যাক নাচ থেকে শুরু করে মডেলিং পর্যন্ত হতো। মৌ-রোজিনা নাচ এবং মডেলিং-এ, অভিনয়ে পারভেজ-মানিক-সুমন-জনি-কাজল। তবে মানিক-সুমন জুটি অসাধারণ। ওদের কৌতুক ভাবতে গেলে এখনও পেটে খিল ধরে যায়। জনি-কাজলের জুটিটাও কৌতুকের কোনো অংশেই কম ছিলোনা।
আজ এর মধ্যে মানিক আছে একুশে টিভিতে, দেশজুড়ে অনুষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে। রোজিনা টিভি নাটকে অভিনয়ও করেছে। তবে সুমনই চলে গেছে অন্যপথে। ও আছে চা’ বাগানের ম্যানেজার পদে। রুবিনা-রোজিনা কে জানে কোথায়! জনি ডাক্তার হয়েছে, আর কাজল সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছে। শান্ত-শিষ্ট ছেলেটা যে আমাদের বাসায় এসে চুপ করে বসে থাকতো। কেমন আছো জানতে চাইলে বলতো, “দিদিভাই ভালো আছি।” ওটুকুই কথা। তাও কেন যে আসতো, কি পেতো কে জানে! সবশেষ অনুষ্ঠান হয় ২০০৩ সালে। এরপর আর হয়েছে কিনা জানিনা, কারণ এরপরের প্রজন্মকে দেখা হয়নি। শুধু শুনেছি বাগানে এখন আর সেই আনন্দ নেই। যার যার নিজস্ব আনন্দ নিয়েই ব্যস্ত। এবার দেশে দশ মিনিটের জন্য গিয়ে যা দেখেছি, তাতেই বুঝে গেছি আমাদের সেদিনকার আলো-হাওয়া আর আমাদের নেই। কষ্ট একটাই শুরু করে যাওয়া সার্বজনীন ওই অনুষ্ঠানটি কেউই ধরে রাখতে কেন পারলো না?
যাক সেসব কথা। অনুষ্ঠানের সবশেষে হতো লটারি। আমার ভাগ্য সবথেকে খারাপ ছিলো(এখনও আছে) একটা সুতোও(অবশ্য লটারিতে সুতো থাকেনি, থাকলে হয়তো পেতাম)পাইনি কখনো। স্বান্তনা পুরষ্কার হিসেবে সকলের আদর আর ভালোবাসা এটা পেতাম। এখনও সেটা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। কতো বছর পর বাগানে গিয়ে বাইরে থেকে ডেকে উঠেছি “আন্টি—“। ভেতর থেকে কন্ঠ ভেসে এলো, তাও না দেখেই, “এই পাগলী এলো কোথা থেকে?” এই সকালে কানাডায় বসে আনন্দে একফোঁটা জল ছলকে উঠলো। এটুকুই বা কম কি! শুভ নববর্ষ সবাইকে।
**আরোও কিছু নাম না বললেই নয়। অনুষ্ঠানটির পেছনে অনেকেই নেপথ্যে সাহায্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে বাবুল কাকু, জীবন ভাই, শোয়েব ভাই আর শঙ্করদা। দর্শক হিসেবে উৎসাহ দিয়েছেন বাগানের সকল ষ্টাফদের পরিবার। উনারা না থাকলে পাশে কিছুতেই কিছু হতোনা।
***যে কথাটি খুবই প্রয়োজন বলার, সেটি হলো বাগানের পহেলা বৈশাখ এখনও বাদশাহ আকবরের আমলের পঞ্জিকা মতেই পালিত হয়। আজও বদলায়নি। সেই হিসেবে আমার কাছে আজই পহেলা বৈশাখ।
হ্যামিল্টন, কানাডা
১৫ এপ্রিল, ২০১৫ ইং।
১৬টি মন্তব্য
স্বপ্ন নীলা
আপুরে !! নতুন বছর, নতুন আমেজ — মনটা বড়ই উথাল পাথাল ঢেউ, আর এ সময় আপনার লেখার স্পর্স পেয়ে আরো ভালো লাগলো
শুভহোক পথ চলা
নীলাঞ্জনা নীলা
নতুন বছরের শুভেচ্ছা নিন …………নীলা
হিলিয়াম এইচ ই
শুভ নববর্ষ
নীলাঞ্জনা নীলা
শুভ নববর্ষ
শুন্য শুন্যালয়
সেই দিনগুলো জীবনে এসেছিলো বলেই হয়তো এখন আর কোনো আফসোস নেই। এ জীবনের সাথে অনেক সুন্দর দিন যে যুক্ত।
খুব সুন্দর বলেছেন আপু। সবকিছু হারিয়ে ফেলার আফসোসে ভুলেই যাই, কম তো পাইনি জীবনে। এক জীবনে এর চাইতে আর কি চাওয়ার আছে?
সব স্মৃতিগুলোর কেমন তরতাজা বর্ণনা দিলেন আপু। চা বাগান কখনো না দেখলেও উৎসব টা দেখতে পাচ্ছি।
ভালো থাকুন পুরো বছর জুড়ে। শুভ নববর্ষ।
নীলাঞ্জনা নীলা
এক জীবনে এর চেয়ে আসলে বেশী কিছু চাওয়ার নেই।দেশে এলে অবশ্যই একবার চা বাগান দেখবেন।ভালো লাগবে ঘন সবুজকে।
আপনিও ভালো থাকুন সারা বছর।শুভ নববর্ষ।
ছাইরাছ হেলাল
দিনগুলো কেন যে সোনার খাঁচায় থাকে না তাই ভাবছি।
নীলাঞ্জনা নীলা
এরপরেও সেই সব সোনালি দিনই সম্পদ আমাদের।
সঞ্জয় কুমার
নববর্ষের শুভেচ্ছা
নীলাঞ্জনা নীলা
শুভ নববর্ষ।
মরুভূমির জলদস্যু
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনাকেও শুভেচ্ছা।
জিসান শা ইকরাম
সেই সোনালী দিন আর নেই। আর আসবে কিনা জানিনা।
আপনি সব সময়ই ভাল লেখেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
সেই সব দিনই সম্পদ নানা।
খেয়ালী মেয়ে
স্মৃতিচারণ ভালো লাগলো…
শুভ হোক নববর্ষ আপু..
নীলাঞ্জনা নীলা
শুভ নববর্ষ খেয়ালী মেয়ে।