
কেউ কাউকে এতোকরে মনে রাখার কোন কারণ ছিলো না। কিন্ত লীলাবতী আমায় মনে রেখেছে। সকালের কফির সাথে একটা মোর(সিগারেট) ধরানো আমার এ কবছরে অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। সারাক্ষন খিটমিটে মেজাজ দমন না হলে আয়েশী মেজাজে সারাদিনের কলেজ, স্টুডেন্ট এসব করতে পারি না।
টুকটুক করে দরজায় শব্দ হচ্ছে। কে, এতোসকালে একটু কনফিউজড হয়ে দরজা খুলতেই চোখ আকাশে। লীলাবতী এতোসকালে আমার দরজায়। আমি সিগারেট ফেলে দিয়ে তাকে ভেতরে নিলাম। আমার সাথেই সে পাউরুটি, ডিম খেলো। ভীষন খুশি; এতো খুশি কেন সে?
কোন এক বিকেলে বাসায় ফিরে দরজা খুলবো দেখি চাবি নেই। আমার সবসময়ের বদ অভ্যাস চাবি ভেতরে রেখে দরজা লক করা। অগত্যা পাশের লাগোয়া ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে আমাকে নিজের বাসায় ঢোকার ব্যবস্থা করতে হলো। সেদিনই লীলাবতীর সাথে আমার প্রথম দেখা, পরিচয়, চোখাচোখি।
দ্বিতীয়বার আমি একই ভুল করলাম হয়তো লীলাবতীর জন্যই। সেদিন লীলাবতী এসে পাশ ঘেঁসে দাঁড়ালো, আমি পুরোনো গন্ধ পেলাম সাথে আজন্ম টান। কোথা থেকে এলো বুঝলাম না। আমি অনায়াসেই ওর নাম রাখলাম ‘লীলাবতী’।
আমার মতোই শ্যামলা সে, একটু হেলদি নাদুস- নুদুস, শুধু চোখগুলো ডাগর কাজল। আমি মুচকি হেসেছিলাম, সামান্য ইশারা ইঙ্গিত হয়েছিলো দুজনের। একফাঁকে ওর মাকে ফাঁকি দিয়ে চুমুও দিলাম। তাতেই সে এতকরে মনে রেখেছে; আমি অবাক।
এরপর অনেকদিন তারা ছিলো না। আমি ব্যস্ততায় ভুলে গেছি। আজ তাকে সাতসকালে দেখে আমি আপ্লুত। খুব করে বুকে চেপে ধরে চুমু দিলাম। লীলাবতী কথা বলতে পারে না। কিন্তু বোঝা গেল সেও অনেক খুশি। আমাকেও সে খুব করে জড়িয়ে, বুকে লুকিয়ে পড়লো।
এভাবে সময়ে- অসময়ে লীলাবতী আমার বাসায় আসতে লাগলো। কখনো সকালের কফিতে, কখনো আমার বিষন্ন বিকেলে। কিংবা কলেজ থেকে ফিরেছি এমন সময়েও। জীবন বদলে যেতে শুরু করলো। কবছর ধরেই আমি দিনে দিনে যে অমানুষ হয়ে উঠছিলাম তা বদলে যেতে থাকলো। পরিবারের মানুষজন সিগারেট ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেও পারেনি। ডাক্তার বলে দিয়েছে আমার হার্টের অবস্থা ভালো না আমাকে খুব তারাতারি ছাড়তে হবে আমি তবুও পারিনি। কারন বিষাদময়, অপূর্নজীবনে আমি কেন যেন বাঁচতেই চাই না।
আমার লীলাবতী চাই এটা কেউ বুঝতেই চাইতে না।কলেজে জেনে গেছে, স্টুডেন্টরাও মাঝে মধ্যে সিগারেট কিনতে দেখে। আমার মোটেও লজ্জা হয় না। অথচ আমার এমন বদঅভ্যাস লীলাবতীর জন্য নিমিষেই ছেড়ে দিলাম। ওকে চুমু দেই, গন্ধে ওর ক্ষতি হতে পারে। রাতে তারাতারী ঘুমোতে যাই কারন সকালেই লীলাবতী চলে আসে।
আজও কলেজে যাবার জন্য শাড়ি গুজবো এমন সময় সে হাজির। আমি শাড়ি ছেড়ে লীলাবতীর খাবার বানাতে ব্যস্ত হলাম। কলেজ থেকে ম্যাসেজ দিচ্ছে- সামায়রা ম্যাম, আপনার সকালে ক্লাস আছে ভুলে গেছেন? স্টুডেন্টরাও ফোন দিচ্ছে?
-ধুর; ক্লাস, আমি লীলাবতীর সাথে ভীষন রকম ব্যস্ত।
আমরা খাচ্ছিলাম এমন সময় লীলাবতীর মা এলো। একটু রাগান্বিত ও বিরক্ত। লীলাবতীর মুখের খাবার শেষ না হতেই হাত ধরে নিয়ে গেলো। লীলাবতী কথা বলতে পারে না। আজ হঠাৎই সে মা বলে কেঁদে দিলো। আমার বুকে এক আকাশ মেঘের গর্জন হলো। ইচ্ছে হলো লীলাবতীকে তার মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেই। কিন্তু পারলাম আর কই? এতো অধিকার তো আর আমার হয়নি। কারন আমি তো তার মা না। আমি নি:সন্তান, আটকুঁডে এক মহিলা। যার মুখ দেখাও পাপ, দেখলে সারাদিন ভালো কাটেনা, কোন কাজ সফলতার সাথে হয় না। এরপর লীলাবতীকে অনেক মারলো। চোখে চোখে রাখে যেন বের হতে না পারে। লীলাবতীকে দেখতে না পেয়ে আমার গলা শুকায়!
তবুও চুপচাপ আমি বিকেলের বারান্দায় লীলাবতীর অপেক্ষায় বসে থাকি। ওর মা খেলতে নিয়ে যায় তখন একটু দেখি। লীলাবতীও বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে, মায়ের হাত ছাড়াতে চায়, কিন্তু পারেনা।
শুনলাম আমার জন্যই লীলাবতীরা চলে যাবে অন্য বাসায়। আমার কুদৃষ্টিতে লীলাবতী শুকিয়ে যাচ্ছে তার মা এ কথা বলাবলি করেছে। আমি অবাক হই! একটা অমুসলিম বছর দেড়েকের বাচ্চার জন্য আমার এতো টান কেন? এ কি মায়ের মন; মায়ের ভালোবাসা? আমিও তো তাকে মায়ের মতোই ভালোবেসেছি; ভালোবাসায় আবার নজর কিসের? হোক আমি নি:সন্তান, তাই বলে মা কি হতে পারিনা?
কদিন থেকে লীলাবতীকে না দেখে ঘুম একেবারেই নেই। ওর একটা জামা আছে। মাঝে মাঝে নাকে লাগিয়ে গন্ধ শুঁকি। কেমন মাটির মতো একটা মিষ্টি গন্ধ।জানিনা আর কতোদিন তাতে গন্ধ পাবো। তারপর কি তাকে ভুলে যাবো? কিংবা কোন একদিন লীলাবতী ফিরে আসবে এই মায়ের বুকে!
রাতের স্তব্ধতা আর লম্বু গাছের দীর্ঘ ছায়ায় মা কুকুরটা কুউউ-কুউউ করে কাঁদছে আর আমি বারান্দায় বসে সিগারেটের প্যাকেট শেষ করছি।
লীলাবতী আমার মতোই দেখতে হয়েছে। চলনে- কথায় প্রতিবাদী, অকপট, বিধ্বংসী। কলেজ শেষ করে ফিরে বলছে, মা জানো তোমার জন্যই আমাকে এতোদুরে ভর্তি হতে হয়েছে। পরিবারে বোঝাতে হয়েছে ভালোবাসা ভাগ হয় না বরং বাড়ে।
চোখে লীলাবতীর জন্য অপেক্ষার পানি। লীলাবতী যেখানেই থাকুক; অনেক ভালো থাকুক। মায়ের দোয়া রইলো!!!
ছবি- আমার
২১টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
সুন্দর লেখেছেন রুকু আপু অনেক শুভেচ্ছা রইল
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ লিটন ভাই।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
নিঃসন্তান মা’দের নিয়ে হৃদয় নিংড়ানো অপূর্ব লেখা — “আমরা খাচ্ছিলাম এমন সময় লীলাবতীর মা এলো। একটু রাগান্বিত ও বিরক্ত। লীলাবতীর মুখের খাবার শেষ না হতেই হাত ধরে নিয়ে গেলো। লীলাবতী কথা বলতে পারে না। আজ হঠাৎই সে মা বলে কেঁদে দিলো। আমার বুকে এক আকাশ মেঘের গর্জন হলো। ইচ্ছে হলো লীলাবতীকে তার মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেই। কিন্তু পারলাম আর কই? এতো অধিকার তো আর আমার হয়নি। কারন আমি তো তার মা না। আমি নি:সন্তান, আটকুঁডে এক মহিলা। যার মুখ দেখাও পাপ, দেখলে সারাদিন ভালো কাটেনা, কোন কাজ সফলতার সাথে হয় না। এরপর লীলাবতীকে অনেক মারলো। চোখে চোখে রাখে যেন বের হতে না পারে। লীলাবতীকে দেখতে না পেয়ে আমার গলা শুকায়’!
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো আপু।
হালিমা আক্তার
হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার গল্প। সত্যিই তো ভালবাসার ভাগ হয় না। তবু কোন এক অদৃশ্য শক্তি ভালোবাসাকে ভাগ করে দেয়। অধিকার হীন মা লীলাবতীর জন্য অপেক্ষা করছে। ভালো থাকুক লীলাবতী। খুব ভালো লাগলো। শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার জন্যও শুভকামনা রইলো। ভালো থাকুন।
রেজওয়ানা কবির
লেখার থিম অসাধারণ। এরকম অনেক নিঃ সন্তান মাকে এভাবে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ হেয় করে। যতদুরেই যাক লীলাবতিতো মনেই রয়ে গেল, ভালোবাসা এরকমই। তাই লীলাবতীর মায়েরা কেন বোঝে না তাদের সন্তানকে এভাবে অন্য আরেক মা বা বাবা ভালোবাসলে দোষের কি? বরং ভালো লাগার কথা। শুভকামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
কেউ কি আর ভাগ দিতে চায়। থিম পছন্দ হয়েছে জেনে ভালো লাগলো। শুভ কামনা অবিরাম।
আরজু মুক্তা
মায়ের ভালোবাসা এমনি।
এমন ভালোবাসা অটুট থাক।
শুভ কামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
অটুট হোক ভালোবাসার বন্ধন। ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
ছাইরাছ হেলাল
মা মা-ই, সে যেখানে যেমন থাকুন, সন্তান কে চোখে রাখে। জন্মে জনমে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
জী জনাব অনেক অনেক ধন্যবাদ মূল্যবান মন্তব্যে। শুভ সকাল।
সৌবর্ণ বাঁধন
লেখার ভঙ্গী অসধারণ। গল্পের প্লটের বিন্যাসে মুগ্ধতা রইল।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ প্রিয় কবি অনন্যসুন্দর মন্তব্যের জন্য। শুভ কামনা সবসময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
নিজ সন্তানকে কেউ আদর ভালোবাসা দিলে সেই স্নেহ আদর মায়ের হৃদয়ে যেমন স্পর্শ করে, তেমনই সন্তান যদি মায়ের মতো করে অন্যকারো সাথে নিজের ঘনিষ্ঠতা বেশি রাখুক এটা মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে নিঃসন্তান কারো সাথে। মায়ের মনের বিশালতা এখানেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
স্নেহ, মমতা ভালোবাসা বুঝতে পারা যায়, এর জন্য কোন বিশেষ ভাষা জানার প্রয়োজন হয় না। মনের সাথে মনের ছোয়া-ছুঁয়ির থাকতে হয়। লীলাবতী এক ছোট্ট শিশু, কিন্তু জড় পদার্থ নয়।
শুভ কামনা 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভালোবাসা ছোট্ট শিশুও বোঝে। পাশে থাকতে চায়। পারে না হয়তো। শুভ কামনা রইলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এই প্রথম আপনার লেখা পড়ে কান্না আসলো। আপনি সত্যিই অসাধারণ লিখেন। দারুন দক্ষতায় গল্পটি সাজালেন। অফুরন্ত শুভকামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
প্রশংসায় আপ্লুত হলাম দিভাই। অনেক ভালো থাকুন।।
তৌহিদুল ইসলাম
একেবারে পারফেক্ট ছোট গল্প। লেখা প্রতিটি প্যারায় যেন আবেগ উপচে পড়ছে। এমন লীলাবতী পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়, থাকুকনা দুরে তবুও যেন অনেক কাছে। লীলাবতীর জন্য এমন হাজারোবার আমি ধূমপান ছেড়ে দিতে পারি। চমৎকার লিখেছেন আপু। ভালো থাকো লীলাবতী।
শুভকামনা আপনার জন্যও।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাই। পাশে থাকবেন সবসময়।