জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...
জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক…

রায়হান স্যারের সাথে অনেক বেশী ঘনিষ্ট হয়ে গেলাম ভাষার কারণে। সিলেটি ভাষা স্যার বুঝতেন না। আর আমার সাথে সাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারতেন। কলেজে ভর্তি হবার আট/দশদিনের মধ্যে স্যার আমাদের বাসায় এলেন। আমাদের বাসাটা ছিলো ভরপুর আনন্দের একটা জায়গা। গানের আসর থেকে কাবাডি কিছুই বাদ পড়তো না। স্যারের কন্ঠ দারুণ। আর মামনি প্রথম দিনেই কন্ঠ শুনে স্যারকে বললো, “আপনি গান করেন। একটা গান শোনান।” স্যার অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এতো সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেন স্যার, তেমনি আবৃত্তিও। প্রথম গানটি ছিলো, “আকাশ ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ”, তারপর গাইলেন “এমনি করে যায় যদি দিন যাকনা” এবং  “তুমি কি কেবলই ছবি!” স্যার আরেকটি গণসঙ্গীতও গেয়েছিলেন। যদিও মনে করতে পারছিনা। মামনি-বাপির মন জয় করে নিলেন স্যার সেদিনই। তারপর তো স্যার প্রায়ই আসতেন মামনির সাথে গল্প করতে। আর ওই গল্পের ছলে স্যারের থেকে অনেক কিছু শিখে ফেলেছিলাম। যেমন ছন্দ-মাত্রা-স্বর-উচ্চারণ নিয়ে আমি সেই ইন্টার প্রথম বর্ষেই জেনেছিলাম। এতো মজা পেতাম তখন একেকটি কবিতা আবৃত্তি করতে। যা-ই হোক স্যার হঠাৎ করে বাড়ী গেলেন। রাতে ট্রেন, আমাদের বাসায় সন্ধ্যায় এলেন কমলগঞ্জ থেকে। তো স্যারের ক্লাশ মিস করবো, কি মন খারাপ! মামনিরও মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আসলে স্যার এলে সাহিত্য নিয়ে অনেক আলোচনা হতো মামনির সাথে। আর আমি বসে বসে শুনতাম। ভাষাতত্ত্ব যে বোরিং না, এ ব্যাপারটা তখনই বুঝি।

বইমেলা আসলেই স্যার ঢাকা যেতেন। আমার তখন বইয়ের কালেকশনে অনেক বই-ই ছিলোনা। স্যার বইমেলা থেকে আমার জন্য পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন নিয়ে এলেন। সেই প্রথম এমন কথোপকথনধর্মী আধুনিক কবিতা পড়া। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বিদায়-অভিশাপ” কবিতায় কচ ও দেবযানীর কথোপকথন পড়েছি। এই কবিতাটি দারুণ আবৃত্তি করতো আমার বড়ো মাসী আর মেশো। স্যার উনাদের সেই আবৃত্তি শুনেছিলেন। যাক এভাবেই আমার পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেলেন স্যার। আসলে মামনির সাথে স্যারের অনেক ব্যাপারে মিল। স্যার ছোট মাছ পছন্দ করতেন, তাই রান্না হলেই মামনি আমায় বলে দিতো স্যারকে যেনো আসতে বলি। স্যারের প্রতি মামনির মাতৃস্নেহ খুব বেশী রকমেই ছিলো এটুকু বুঝে গিয়েছি। এমনও হতো শুক্রবার ছুটির দিন স্যার চলে আসতেন আমাদের বাসায়, আর জুম্মার নামাজও পড়তেন। মাঝে-মধ্যে মসজিদে গিয়ে, কখনো আমাদের বাসাতেই। স্যারের মতো উদার আবার খুবই ধর্মভীরু মানুষ এ জীবনে কমই দেখেছি।

স্যারকে নিয়ে অনেক গল্প। যে কথাগুলো না বললেই নয়, সেসবই বলি। দ্বিতীয় বর্ষের পিকনিকে মাধবকুন্ড গেলাম। সব ছেলেরা একেবারে চূড়ায় উঠলো। এদিকে আমার তো মন টানছে। পল্লব স্যার, বিশ্বজিৎ স্যার, সুনীল স্যার, রায়হান স্যার, বাসিত স্যার দঁড়ানো। এসে বললাম আমি উপরে যেতে চাই স্যার। বাসিত স্যার মেয়েদের যেতে দিতে রাজি না। কিন্তু বিশ্বজিৎ স্যার বললেন বাসিত স্যারকে, “ওদের এ বছরই কলেজের শেষ পিকনিক, যাক না বাসিত ভাই। আর মেয়ের আগে নীলাঞ্জনা একজন মানুষ।” আর রায়হান স্যার সেই কথায় সায় দিয়ে বললেন, ” “কঠিন পাথর ভেঙ্গে ভেঙ্গে নগর তৈরী হয়েছে মানুষের জন্য। শুধু পুরুষ কিংবা শুধু নারীর জন্য না।” অন্যান্য স্যাররাও আমায় ফিরিয়ে দিতে না করলেন বাসিত স্যারকে। আমি রওয়ানা দিতেই অন্যান্য মেয়েরাও আমার সাথে উপরের পথে হাঁটা ধরলো। হঠাৎ দেখি স্যার একটা লাঠি ধরে উপরে উঠছেন। স্যারের পায়ে সমস্যা, অনেক বড়ো অপারেশন হয়েছিলো। আর তারপর থেকে উনাকে একটা পায়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয়। সহজে যদিও বোঝা যায়না। কিন্তু উনাকে এভাবে উঠতে দেখে আরোও উৎসাহিত হলাম আমরা সবাই। ওদিকে রায়হান স্যার আমার কবিতার পেছনে লেগেই আছেন। “এই কবিতা পাঠাও, ওটা পাঠাও”  রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে লেখা একটা প্রবন্ধ বেশ সুনাম অর্জন করেছিলো। বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলাম, স্যারের যন্ত্রণায় আর্টিক্যালও লিখলাম পরজীবি, অভিস্রবণ এমনই আরো কতো কি নিয়ে। এসবের সবই প্রকাশিত হয়েছে স্যারের উৎসাহে। এভাবেই দ্বিতীয় কবিতা প্রকাশিত হলো সংবাদ পত্রিকায় ১৯৯১ সালে।

যেন নদী
বাঁধ না মানা
জোয়ারে ভাসাই
পংক্তিমালা —
আপন পৃথিবী ।

কন্ঠ নিঃসৃত সুরে ,
দু’কূল প্লাবি ,
উচ্ছ্বলতা বারংবার
অথচ কখনো বুঝিনা
ভালোবাসার দারুণ খরায়
হৃদয়ের মূল্য একটু বেশী ।
(মূল্য, ১৯৯১ ইং।)

একবার ক্যারম বোর্ড খেলছি চারজন মিলে। আমি, বাপি, স্যার, বড়ো মামা। আমি আর স্যার একদিকে, অন্যদিকে বাপি আর মামা। পুরো হেরে যাচ্ছি। স্যারকে বলছি আমি কিছুতেই হারবো না। স্যার কিছু তো একটা করুন। মনে আছে স্যার বলেছিলেন, “আমরা হারছি কোথায়? খেলা তো শেষ হয়নি। আগেই যদি এতো অস্থির হয়ে পড়ো, ফলাফল তোমার অনুকূলে কখনোই আসবে না।” খেলা শেষ হবার পর বললেন “হেরে গেলেই জীবন শেষ কখনোও এমন ভেবোনা। বরং নতূন করে শুরু হলো আরেক নতূন কোনোকিছুর। আর তখন ভুলগুলো শুধরে নেয়া যাবে। একবারে জয়ী হলেই যে কেউ শ্রেষ্ঠ, এ কথাটি ভুল মনে রেখো নীলা।” সেদিন কিন্তু আমরা ক্যারমে জয়ী হয়েছিলাম।

ইন্টার শেষ হবার পর কি নিয়ে পড়বো, একেকজন একেকটা বলে যাচ্ছে। স্যারকে জিজ্ঞাসা করা হলো, বাপিকে স্যার বললেন, “নীলা কোনটায় স্বাচ্ছন্দ্য?” বলে বসলাম বাংলা নিয়ে পড়তে চাই। কেউ তো রাজি না। স্যার সবার সামনে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কি স্যারের জন্য বাংলা নিয়ে পড়তে আগ্রহী? বললাম না স্যার। আপনার জন্য না। আসলেই কিন্তু তাই স্যারের জন্য বাংলা নিয়ে পড়িনি। বরং বাংলা আমায় সবসময় টানতো। অনার্সে ভর্তি হলাম, স্যারের সাথে অনেক মাস পর পর দেখা হতো। যদিও স্যার এমনিতেই আসতেন মামনির সাথে গল্প করতে। আর আমি বাসায় এলেই স্যার আসতেন, কতো যে গল্প। স্যার জানেন আমি না চর্যাপদের অভিধান কিনেছি? আপনার কি ছিলো? স্যার আমার এসব পাগলামো, আহ্লাদীপনা নিয়ে খুব হাসতেন। মজা পেতেন। মামনি বলতো, “নীলা তোর স্যার বাংলা নিয়ে পড়েছেন।” এখনও মনে আছে কথাটি স্যারের, “শিশুতোষ মনকে যত্নে রেখো, সবাইকে বুঝতে দিওনা।”

স্যারের সাথে এখনও আমার যোগাযোগ হয়। কথা হয়। প্রায়ই ফোন দেই, স্যারও মামনি-বাপির সাথে যোগাযোগ রাখেন। আমার জীবনে স্যারের অবদান সবচেয়ে বেশী। আমি কৃতজ্ঞ আজ এই যে লিখছি, উনারই দান। একটা কথা না বললেই নয়, আমার প্রথম বই স্যারকে উৎসর্গ করেছিলাম। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছি এরপর যদি আর বই বের করি স্যার ও আমি দুজনে একসাথে। এ আমার স্বপ্ন। দুই পর্বে স্যারকে নিয়ে লেখা কি শেষ হতে পারে? ১৯৯০ সালে পরিচয়, আর আজ ২০১৬ সাল। ছাব্বিশটি বছর, সে কি কম? পৃথিবীর যেখানেই গেছি, স্যারের সাথে আমার হার্দিক বন্ধন কখনোই কমেনি। স্যারের লেখা শরতের আগমনীর কবিতা দিয়েই শেষ করি।

মাধুকরী
…………………. রায়হান সেলিম

ইউফ্রেটিস নদীটাকে পাখায় নিয়েছিল
ন্যাল্ডেনিয়া –
ইকুয়েডরের ঘন লালচে সবুজ অরণ্যে
নামিয়েছিলো তাকে
শ্রাবণসখা জলের কি মনোরম অতল
দীর্ঘতর বোয়া যেন
কেবলি ধাবমান –

যমুনাও গৃহসুখ চায় কখনোবা
তাই চাঁদ পেরিয়ে মাঝরাতে উঁকি দেয়
ফরাজ আলীর ঘরের পৈঠায়
ফেনাময় জল বুঝি চতুর্দশীর মায়াবী যৌবন
ভাঙা জোড়া কলাগাছ উপড়ে ফেলে
ঢুকে পরে ফরাজের নিকোনো উঠোনে –

নিশ্ছিদ্র নীরবতায় বাঁধা পড়ে পাথরবন্দী সময়
নলখাগড়ার ছায়ায় বুনো শুয়োরের মতো ঘোঁৎঘোঁৎ করে রাত
সারসের দেহের মতো আবছায়ায়
মানকচু খোঁজে কি !

ভাদ্রের বিপন্ন তাপদাহে
জেগে থাকে শিউলীর ছায়াতল

ভোরের কাজল-বেদোনা চোখে
আকুল পলকে মৌ- গুঞ্জন
ভাবতে ভালো লাগে
শরৎ এসেছে

ইকুয়েডরের ঘন লালচে সবুজ অরণ্য পেরিয়ে
ফরাজ আলীর ঘর ছাড়িয়ে
শরৎ এসেছে
আ্যতো জ্যোৎস্নার ঢল
অলস মাটির টানে
অধরে সুবর্ণরেখা
ধাঁধাঁ লাগে – বাঁধা পরে সব
কাশবনে মাতাল হাওয়া ….
মাদুর পেতেছে মাধুকরী ………. !!

 

ক্রমশ

হ্যামিল্টন, কানাডা
২২ আগষ্ট, ২০১৬ ইং।

রায়হান সেলিম স্যার (এক) – যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন : অষ্টম ভাগ

৭৩৪জন ৭৩৪জন

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ