নাহার আমার এদেশে পরিচয় হওয়া বন্ধু। যে কোন উপলক্ষকে অজুহাত করে দামী গহনা কিংবা শাড়ি কেনে সে। আমাকে দেখায় খুব উৎসাহ আর উচ্ছ্বাস নিয়েই। আমি আগ্রহ পাই না। দাম দিয়ে কেনা পোশাক কিংবা গহনা কেন যেন আমায় টানে না। মনে মনে হিসাব করি। ডলারকে টাকায় রূপান্তর করি ! কেউ কেউ ছোটলোক ভাবে। কিন্তু আমি ভাবি, এই টাকা দেশে ময়নার মা’কে দিলে ডাক্তার দেখাতে পারবে, ওষুধ কিনতে পারবে। গতবার বলেছিল, কাশতে কাশতে নাকি বুক ব্যথা হয়ে যায়। ঘুমাতে পারেনা। কখনো মনে হয় রহমতের বাপকে দিলে সে হয়তো হাঁপানি নিয়ে আর রিক্সা চালাতে হবে না। একটা রিক্সা কিনে ভাড়া দিয়েও সংসার চালাতে পারবে। আবার কখনো পাড়ার সেই চাচার কথা মনে হয়। বাবার কাছে শুনেছিলাম স্ট্রোক করে মারা যাবার দুইদিন আগে খুব বিষণ্ণ ছিল, মেয়ের এস এস সি পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে পারেনি বলে।
একদিন বলেই ফেলি, “এভাবে অপচয় করো না, নাহার”। চোখে মুখে ক্ষোভ ফুটে উঠলো। বলল, দেশে তাঁর শ্বশুরবাড়ির সবাই সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও স্বামী লুকিয়ে টাকা পাঠায়। সে টাকায় স্বামী’র অন্য ভাইয়ের স্ত্রী’রা, পরিবারের মানুষজনরা দামী পোশাক, এটা সেটা কিনে। আনন্দ ফুর্তি করে। তবে আমি কেন বঞ্চিত হবো ? জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাঁর। আমি বুঝি, এটা জেদ। কখনো কখনো জেদের কাছে হার মানে নাহারের স্বামী। আবার কখনো হার মানতে চায় না। এতে নাহারের জেদ আরও বাড়ে। স্বামীর কাছে টাকা চাইতে যেন না হয়, তাই চাকুরী নেয়। সকাল সন্ধ্যা জব করে। এদিকে বাধ্য হয়ে স্বামী রাতভর কাজ শেষে বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেয়া করে। মাঝে একটু ঘুমিয়ে নেয়। বিকেলে আবার কাজে যায়। সন্ধ্যায় নাহারকে ফোন করলে বাচ্চাদের সাথে চেঁচামেচির শব্দ শুনি। কথা হয়না আর আগের মত……
ব্যস্ততার মাঝে বেশ ক’বছর আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। একদিন ছেলেকে নিয়ে কোচিং এ গেলে নাহারের সাথে দেখা। ভীষণ দিশেহারা। বাচ্চা দুটি স্কুলে খুব খারাপ করছে। কোচিং এ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। কিছুই নাকি বুঝে না। কোচিং সেন্টারগুলো তো আর একেবারে হাতে ধরে শেখায় না। এক কোচিং থেকে অন্য কোচিং সেন্টার বদল করেও কাজ হচ্ছে না। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারি, যে সময়ে যা শেখার কথা ছিল বাচ্চা দুটি তা শিখেনি। মাঝে অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে, বিধায় এতোটা সময় পেরিয়ে তা আর কভার করতে পারছে না। যতটুকু ক্ষতি হবার হয়ে গেছে।
জানিনা, বাবা-মা’য়ের বেহিসাবি জেদাজেদি’র স্বীকার বাচ্চা দু’টির ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তাঁদের জন্যে শুভকামনা।
আরেকজন রেহানা ভাবী বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়েছেন জেনে অবাক হলাম। কেননা এই সময়ে নিউইয়র্কের স্কুলগুলোতে পুরো দমে ক্লাস চলছে। তিনি তো অসময়ে দেশে যাবার কথা নয়। অজানা আশংকা ভেতরে। ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোন করি দেশে। ফোনের ওই প্রান্তে কাঁদছেন রেহানা ভাবী। তাঁদের একমাত্র ছেলেটি ড্রাগ এডিক্টেড জানার পর উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে গেছেন দেশে। তাঁদের ধারনা, বন্ধুদের সঙ্গ থেকে কিছুদিন দূরে রাখা গেলে হয়তো ছেলেটি ভাল হয়ে উঠবে। বাবা-মা’য়ের ডলারের পিছনে নিরন্তর ছুটে চলার সময়টুকুতে একাকি ছেলেটি একটু একটু করে ভুল পথে গিয়েছে, ভুল বন্ধুদের সাথে মিশেছে।
সময় থাকতে আমাদের সন্তানদের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত নয় কি ?
একজন ঐশী আমাদের সকলের জন্যে সতর্কবার্তা।
২০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
সতর্কবার্তা আমাদের কাছে পৌছুচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
আপনার দেখার চোখ ও উপস্থাপন বরাবরের মতই অসাধারণ।
রিমি রুম্মান
সতর্কবার্তা পৌঁছাক ঘরে ঘরে প্রতিটি অবিভাবকের কর্ণকুহরে।
ভাল থাকুন সবসময়। শুভকামনা। -{@
আবু খায়ের আনিছ
ঐশী যখন তার বাবা-মাকে হত্যা করে তখন বলেছিলাম, সন্তান জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায় না যার বাস্তব প্রমাণ এই ঘটনা। সন্তানের প্রতি দ্বায়ীত্বশীল না হলে সন্তান খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক।
একটা কথা শিখেছিলাম তখন, যে সন্তান তুমি গর্ভে ধারণ করেছ সে তোমার সন্তান নয়, সে প্রকৃতির সন্তান তোমার মাধ্যমে এই পৃথিবীতে এসেছে। তোমার দ্বায়ীত্ব হল তাকে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে তার বাবা-মা হওয়া।
রিমি রুম্মান
খুব সুন্দর করে সঠিক কথাটি বলেছেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকুন। নিরাপদ থাকুন।
আবু খায়ের আনিছ
-{@ -{@ (y) (y)
নীতেশ বড়ুয়া
আপনার এই পোস্টটি পড়তে পড়তে একবারো ভাবিনি আপনি শেষে এসে ঐশীর কথা বলবেন!
প্রথমেই বলে নেই ঠাকুমার ঝুলি নেই হয়েছে অনেক আগেই কিন্তু ‘রিমির ঝুলি’ এখন জায়গা পাচ্ছে আমাদের কাছে। আপনার প্রতিটি পোস্ট মানেই এমন কিছু…
ঐশী পরিণতির জন্য বাবা মা যেমন তেমন সে নিজে দায়ী… কথায় আছে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’-এই আপন প্রাণ যে নিজে থেকে চিনতে পারে না সে কখনো ঐশী, কখনো ঐশীদেরকে মাদকের জগতে নিয়ে যাওয়া বন্ধু তো কখনো কিছুই না, আবার কখনো ঐশীদের বাবা মা হয়ে যান। ঐশীর বাবা মা খারাপ হতে পারেন, ঐশীর দেখা শোনা যেভাবে করা উচিত ছিলো তা নাও করতে পারেন কিন্তু মানুষ হিসেবে ঐশী যখন অন্য দুজন মানুষকে খুন করছিলো তখন তার কি একবারো মনে হয়নি সে নিজেও মানুষ! কে জানে!
তবে এইটুক জানি মাদক বড় ভয়ানক, বড্ড বেশী গোলেমেলে করে দেয় জীবনের মানে এই মাদক।
রিমি রুম্মান
বিত্তশালীদের যেমন অঢেল টাকা থাকে, তেমনি তাঁদের সামনে দু’টো রাস্তা খোলা থাকে। একটি আলো অন্যটি অন্ধকার। সিদ্ধান্ত তাঁদের তাঁরা কোন পথে হাঁটবেন। আলোর পথে, নাকি অন্ধকারের পথে ? যেখানে রাতের চেয়েও অন্ধকার…
তানজির খান
আপু আপনার লেখা বরাবরই গঠন মূলক। মানবতা বেচে থাক, জেদ নিপাত যাক, সন্তান মানুষ হোক। আমরা পরস্পর আরো সহনশীল হই, ভালবাসা পৃথিবীকে বাচিয়ে রাখুক। ধন্যবাদ সুন্দর লেখার জন্য।
রিমি রুম্মান
আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। ভাল থাকুক আমাদের সন্তানরা। ভাল থাকুক সব বাবা-মা।
শুভকামনা নিরন্তর। ভাল থাকুন সবাইকে নিয়ে। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
একজন ঐশী আমাদের সকলের জন্যে সতর্কবার্তা।
প্রথম গাঁথুনিটা মা-বাবা থেকেই পায় সন্তানরা। আর যদি আপনি এই গাঁথুনিটা দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে আপনার সন্তান অকালেই ঝরে যেতে পারে। এমনকি তার হাতে আপনিও ঝরে যেতে পারেন।
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
যথার্থ বলিয়াছেন আপুমনি।
রিমি রুম্মান
আপনার সাথে শতভাগ একমত। সন্তানের প্রতি অমনোযোগিতাই তাঁদের বিপথে যাবার পথ সহজতর করে তোলে। আমরা যেন আমাদের সন্তানদের প্রতি আরও মনযোগী হই, তাঁদের বন্ধু হই, তাঁদের নিঃসঙ্গ থাকতে না দেই…
অপার্থিব
সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষ দিন কে দিন আত্নকেন্দ্রীক হয়ে পড়ছে । এর ক্ষতিকারক প্রভাব হিসেবে পারিবারিক মুল্যবোধ এবং সামাজিক বন্ধন দুটোই দিন কে দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। বর্তমান সমাজের অনেক সন্তানই তার বাবা মাকে যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখে না । তবে ঐশীর ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে সেটা একেবারেই এক্সট্রিম কেস তবে এই কেসটা থেকে সবারই উপযুক্ত শিক্ষা নেওয়া জরুরী।
রিমি রুম্মান
সন্তান কেন তাঁর জন্মদাতা বাবা-মা’কে সন্মানের চোখে দেখবে না, একটু ভাবলেই এর উত্তর বেরিয়ে আসবে। সন্মান পেতে হলে আগে সন্মান দিতে হবে। তাঁদের বুঝতে হবে, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হবে। পরিবারের আদর ভালোবাসা আর গভীর অনুশাসনের মধ্যে থাকা সন্তানরা বিপথে যাবে না… আমার বিশ্বাস।
ভাল থাকুন। শুভকামনা রইলো। -{@
জিসান শা ইকরাম
সমাজের বাস্তবতাকে সহজভাবে তুলে এনেছেন লেখায়
ঐশী আমাদের একটি জোরে সোরে ধাক্কা দিয়েছে।
রিমি রুম্মান
ঐশী ঘটনা ঘুমিয়ে থাকা আমাদের চোখ কান খুলে দিয়েছে। এ বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার উপায় নেই।
নীলাঞ্জনা নীলা
এখানে হ্যামিল্টনে ড্রাগ যে কি ভয়ানক আকারে চলছে, ভাবাই যায়না। শুধু তাই নয়। যে কয়টা শ্যুটিং হয়, খুণ হয় সব ওসব ড্রাগের কারণে। এতো চিন্তা হয়। যদিও বিশ্বাস তীর্থ ড্রাগ নেবে না। কিন্তু তারপরেও ভয় করে। “সঙ্গদোষে লোহা ভাসে” কথাই আছে।
রিমি আপু সময়াণুযোগী পোষ্ট, সব বাবা-মায়েরই কাজে আসবে। -{@ (3
রিমি রুম্মান
এখানে, নিউইয়র্ক শহরের হাইস্কুলগুলোতেও একই সমস্যা। এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠা কিংবা পাশ কাটিয়ে আসা বহু বাংলাদেশী পরিবারের সন্তানরা ভাল মানুষ হয়ে উঠছে। সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে অনেকেই। প্রয়োজন শুধু সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হওয়া। তাঁদের সময় দেয়া, ভালোবাসা ।
ভাল থাকো আপু। (3 -{@
অরুনি মায়া
আসলেই আপু সন্তান মানুষ করা অনেক কঠিন কাজ | আমরা সবাই সন্তান জন্ম তো দিয়েই থাকি কিন্তু সবাই তার সঠিক প্রতিপালন করতে পারিনা | তাই প্রত্যেক অপরাধ আর অপরাধীর পিছনে লুকিয়ে থাকে এক একটি ইতিহাস,,,
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছ আপু। সেইসব পিছনের গল্পগুলো গল্পই থেকে যায়।
ভাল থেকো সবসময়। -{@