মৃত্যু, অনিবার্য এক সত্যি। পৃথিবীতে যে একবার এসেছে তাকে এই পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমাতে হবে। মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রক্ষা পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না। এই চরম সত্যিটা জেনেও আমরা মরতে চাইনা। তারপরেও প্রস্তুত থাকি, একদিন তো মরতে হবেই। আর মৃত্যুটা হবে স্বাভাবিক এই আশা নিয়ে বেঁচে থাকি।
জীবন ও মৃত্যু একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পেতে চাই। পৃথিবীতে হাজারো অনিয়ম থাকলেও এই পৃথিবী চির মাধুর্যমণ্ডিত। পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু, প্রাণিকে আমি ভালোবাসি। এ ভালোবাসা যে অন্তহীন।
মহাভারতে উল্লেখ আছে, যক্ষ রূপি ভগবান একদিন যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করল,”বলো দেখি পৃথিবীতে আশ্চার্য কি? উত্তরে যুধিষ্ঠির বলিল, প্রত্যেক দিনই পৃথিবীতে হাজারো মানুষ মরছে, কিন্তু সকলেই বাঁচতে চায়, অন্যায় করে, খুন করে, লোভ করে, জমি দখল করে, হানাহানি, ধর্ম-জাতি নিয়ে বিবেধ সৃষ্টি করে। এটাই আশ্চার্য।
মানুষ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি জীব। মানুষের মন, বিবেক, বুদ্ধি, শিক্ষা, পাপ-পূণ্যের হিসাব বোধ আছে। এই পাপ পূণ্যের মাঝেই মানুষের ইহকাল পরকালের হিসাব নিয়ে বেঁচে থাকা।
উপনিষদের‌ ভাষায় মানুষ অমৃতের সন্তান। বাইবেল বলে, সে ঈশ্বরের সন্তান। কোরআনের ভাষায় এক আদমের সন্তান, আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা জীব।আর এই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষতত্ত্ব ধর্ম ভুলে অসংখ তন্ত্র, মন্ত্র, জাতি, গোত্র, মতবাদে বিভক্ত।লিপ্ত হয়েছে হানাহানিতে। জীবন সত্যকে টুকরো টুকরো করে কেটে বন্টন করেছে। মৃত্যু দেওয়ার মালিক প্রাণ দাতার।মানুষ হিংস্রতার আশ্রয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মৃত্যুতে ঠেলে দেয়।
আমি আসলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলতে চাচ্ছি। আমি বাবার পেশাগত করণে হাসপাতাল কোয়ার্টারে বড় হয়েছি। তিনি প্যাথলজিস্ট। আর বিয়ে হয়েছে পুলিশ অফিসারের সাথে। তাই জীবনের কঠিন থেকে কঠিন জিনিসগুলো বড় কাছ থেকে দেখেছি। আমার মনটা হয়ত তাই কঠিন হয়ে যাবার কথা ছিলো। তবে অনুভূতিগুলো মরেনি বুঝতে পারি। কারণ অন্যায় কিছু দেখলে মন কেঁদে ওঠে।
যখন মাইকে কারো বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুর কথা শুনি, কষ্ট হলেও স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মেনে নেই। কারণ মৃত্যুটা স্বাভাবিক, বেঁচে আছি এটাই অস্বাভাবিক। আচ্ছা অস্বাভাবিক মৃত্যু কি আপোষ হয়? আত্মার সাথে যায় কি আপোষ করা? তবে কেন ঐ অস্বাভাবিক মৃত্যু সংঘটনকারী হত্যাকারীর সাথে আপোষ? বুদ্ধিজীবী হত্যায় রাজাকারের সাথে রাজনৈতিক আপোষ, তাদের গাড়িতে সরকারি পতাকা মেনে নেওয়া যেতো?
কেন বধূ হত্যাকারী স্বামীর সাথে বধূর পরিবারের আপোষ? সন্তান হত্যাকারী খুনির সাথে মায়ের আপোষ? বার আপোষ? কেন ভাই করে আপোষ?
আত্মা কি চিৎকার করে বলে না, কোরো না আপোষ, আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি তো আরো কিছুদিন বাঁচতে পারতাম, এই পৃথিবীতে। এই পৃথিবীর আলো বাতাস, মাটির গন্ধ নিতে পারতাম। মায়ের আচলে, বোনের আদরে থাকতে পারতাম।
আমাদের সমাজে মানুষ খুন হলে বলে, একটা গেছে তো গেছে, কিছু টাকা পেলে, বাকি জীবন সুখেই কাটাতাম! সুখ! এইভাবে খুনি হয়ে যায় সমাজের সমাজপতি। কারণ রাজনৈতিক আশ্রয়েই তো সে আপোষ হয়! বড় ভাই দিয়ে দেয় গিফট, কিছু মটরসাইকেল। সেই সাইকেলে ওড়নায় জড়ায়ে মৃত্যু, অস্বাভাবিক মৃত্যু আমরা দেখেছি।
জুলফিকারকে কয়েকবার এই আপোষের সম্মুখীন হতে হয়েছে। করতে দেয়নি আপোষ। নিজে বাদি হয়ে মামলা করেছে। আর এই মামলাগুলো টেকে কতটুকু আমরা জানি।
জুলি বলে আমায়”রীতু এখন না হয় আমি কিছু টাকা নিয়ে আপোষ করলাম, কিন্তু মারা গেলে, ঐ আত্মা যদি আমায় প্রশ্ন করে, স্যার, আমার মামলাটা প্রথমেই আপনার কাছে গিয়েছিলো, কি করলেন আপনি? আপোষ করলেন? ফাইনাল রিপোর্ট  দিয়ে দিলেন? আপনি তো জানেন না স্যার এই মৃত্যুর কতো যন্ত্রনা ছিলো! অনেক কষ্ট এখনও আমার, কতো কাজ করার ছিলো আমার”। জুলি বলে “শান্তিমতো ঘুমাতে চাই তাই এই আপোষ আমাকে দিয়ে হবে না”। সত্যি বলছি খুন হওয়া মামলায় আপোষ করলে কষ্ট হয় আমার। সত্যি কি আপোষ করা যায়! মৃত ব্যাক্তির হয়ে কারো কি আছে আপোষ করার অধিকার? না নেই।
আমি স্বাভাবিক মৃত্যু চাই। আমি যেমন ছোটবেলায় নানা-নানির কাছে খেজুর পাতার পাটিতে শুয়ে গল্প শুনেছি, তেমনি আমিও আমার নাতিনাতনিদের গল্প শোনাতে চাই। আমি অ্যাকসিডেন্টের মৃত্যুও চাই না। আমি স্বাভাবিক মৃত্যু চাই। আমি অস্বাভাবিক সব মৃত্যুর বিচার হতে দেখতে চাই।

১জন ১জন
0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ