মামাকে দেখতে যাওয়া। (পর্ব-১০)

শামীম চৌধুরী ১১ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার, ০৮:০৫:৪৮অপরাহ্ন ভ্রমণ ৩১ মন্তব্য

মিউজিয়ামে প্রবেশ না করে আমরা সামনে দিকে আগালাম। দেখা পেলাম বিশাল বোর্ডে চিহ্নিত করা গোটা কেওলাদেও বনের একটা ম্যাপ। কোন জায়গায়, কত নাম্বার লেকে বা বিলে, কোন কোন পাখির অবস্থান সবই বোর্ডে দেখানো আছে। ভারতীয় ফটোগ্রাফারদের কাছে সবই জানা। তাই তারা সাইকেল ভাড়া নিয়ে বনের ভিতর চলাফেরা করে। ম্যাপে দেখলাম উত্তর আমেরিকা থেকে আসা ফ্লেমিংঙ্গো পাখি ৬ নাম্বার জোনে। আমাদের বহন করা গাইডকে বললাম আগে সেখানে যাবার জন্য। রিক্সা দূর্বার গতিতে আমাকে নিয়ে ছুটে চলছে ৬ নাম্বার জোনে। ততক্ষনে আমার শরীরের ভিতর উত্তেজনা বেড়ে চলছে। জীবনের প্রথম নিজ চোখে ফ্লেমিংঙ্গো পাখির দেখা মিলবে।

রিক্সার বাহক বা গাইড তাঁর স্বভাব সূলভ ভঙ্গিমায় শরীর হেলিয়ে দুলিয়ে রিক্সার প্যাডেল মেরে যাচ্ছে। বার বার তাঁকে জিজ্ঞেস করছি ৬ নাম্বার জোন আর কতদূর? সে অনর্গল বলে যাচ্ছে- “সাহাব জারা সামনে”। ওর জবাব পেয়ে আমাদের দেশর গ্রামের রাস্তার দূরত্বের কথা মনে পড়ে গেল। ধরুন,আপনি কোন গ্রামের অচেনা পথ ধরে হাঁটছেন। আপনার গন্তব্যের রাস্তাটি অচেনা। গ্রামের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করেন করিম খাাঁ’র বাড়ি কোনটা? সেই লোকটি আপনাকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলবে, ঐ…. যে……. তালগাছটা দেখতাছুইন হের লগের বাড়িডা। যদি জানতে চান দূরত্ব কত কিলোমিটার? হেঁসে উত্তর দিবো আধা মাইলের মতন। কিন্তু কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যাচ্ছেন তারপরও তাল গাছ আসছে না। আমার অবস্থাটাও হয়েছে তেমন। যতবার গাইডকে বলছি- “জীতেন ক্যাতনা টাইম লাগে গা”? ততবার সে বলছে “চুপকে বাইঠো সাহাব”। টাইমপে চাল যায়েঙ্গা। সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রবাসী গল্পের মতন “বাঙালী দেশে ইতর বিদেশে কাতর” লাইনটি মনে পড়ে গেল। আমিও বিদেশের মাটিতে কাতর হয়ে রইলাম।
 
জ্বী, আমাদের গাইডের নাম জীতেন্দ্র। সবাই তাঁকে জীতেন বলে ডাকে। ছোট-খাটো গড়নের ভারী দেহের অধিকারী মাঝ বয়সী জীতেন দীর্ঘ ১৮ বছর এই বনে রিক্সা চালায়। নভেম্বর থেকে মার্চ এই ৫ মাস গাইডের কাজ হয়। বাকী সময়ে বর্ষা ও পরিযায়ী পাখি না থাকায় কোন পর্যটক কেওলাদেও পার্কে আসে না। তখন জীতেনদের অন্য কাজ বেঁছে নিতে হয়। সংসার চালাতেও কষ্ট হয়। এমন গল্প বলছিলো আর রিক্সার প্যাডেলে পা রেখে কোমর দুলিয়ে প্যাডেল চালাচ্ছিল। জীতেনের কথাগুলি আমার কাছে বিরক্তিকর লাগছিলো। তার কারন দুটি-
প্রথমতঃ আমরা যে সময়টা বনের ভিতর প্রবেশ করি তখন পাখিদের খাবার খোঁজার সময়। পাখিরা খাবারের সন্ধানে ব্যাস্ত থাকে। তাই খুব কাছ থেকে পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয় কারন হলো সূর্য উঁকি দেয়া শুরু করেছে। কুয়াশার আবরন ভেদ করে সূর্যের সকালের তাপ যখন বাড়তে থাকবে তখন পাখিগুলি আস্তে আস্তে দূরে জলাশয়ের মাঝ খানে চলে যাবে। আর তা ঘটবে আধা ঘন্টার মধ্যে। দীর্ঘ দিন ধরে পাখির ছবি তুলছি, তাই এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ফ্লেমিংঙ্গোর ভাল ছবি তোলার নেশা আমাকে ঝেঁকে ধরলো। তাই তার উপদেশমূলক ভাল কথাও আমার কাছে তিক্ত মনে হচ্ছে।
 
৬ নাম্বার জোনে যাবার প্রাক্কালে রাস্তার দুই ধারে হরেক প্রজাতির পাখি নজরে পড়লো। শুধু চোখ দিয়ে দেখলাম। ইচ্ছা হলো না নেমে এদের ছবি তোলার। তার মূল কারন হলো, দিনের যে কোন সময় এদের পাওয়া যাবে। কিন্তু ফ্লেমিংঙ্গো এই কেওলাদেও পার্কে দীর্ঘদিন থাকবে না। তারা খাবারের জন্য উড়ে আসে। তাদের মূল বাসস্থান উত্তর ঝাড়খান্ড। খাবার সংকট হলে কেওলাদেও বনে মাঝে মাঝে এরা উত্তর ঝাড়খান্ড থেকে উড়ে আসে । জীতেনের কথানুযায়ী গত দুইদিন যাবত ফ্লেমিংঙ্গো পাখি দেখা যাচ্ছে এই বনে। তাও সংখ্যায় চারটি। এরা দলগত পাখি। দলগত ভাবে ঘুরা ফেরা ও খাবারের সন্ধান করে। ১০০-১৫০ পাখির ঝাঁক এক সঙ্গে দেখা যায়। এদের মধ্যে মতের অমিল হলে নিজেরাই মারামারি করে রক্তাক্ত করে। কোন বিপদের সম্মুখীন না হলে বা খাবার সংকটে না পড়লে এরা দলছুট হয় না। পাখিগুলি উত্তর আমেরিকা থেকে শীত মৌসুমে পরিযায়ী হয়ে দলবদ্ধ ভাবে এবারই উত্তর ঝাড়খান্ডে এসেছে। এরা কোথাও নামার আগের আকাশে চক্কর দিতে থাকে। চক্করের মধ্যেই খোঁজ করে তাদের বিচরনের স্থান ও খাদ্যাবস্থা। যদি এদের সন্ধানে এসব মিলে যায় ও নিরাপদ আশ্রয় মনে করে তখনই নীচে নেমে প্রায় তিন মাস অবস্থান করে। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক উড়ে গেলেও রাতে এক সঙ্গে থাকে। এই হলো ফ্লেমিংঙ্গো পাখির চরিত্র। আমার পাঠক বন্ধুদের পাখির পরিচয় দেবার জন্য কথগুলি লিখতে হলো। আশা করি পাখিটি সম্পর্কে মোটামোটি একটা ধারনা পাঠক বন্ধুরা পেয়েছেন।
 
আমি আগের পর্বে বলেছিলাম ৬ নাম্বার জোনটি কেওলাদেও বনের শেষ প্রান্তে। যখন আমরা পৌছালাম তখন সূর্যের আলো থাকলেও কুয়াশার রেশ রয়ে গেছে। চারিদিকে পাখির কলতান আর উড়াউড়ির দৃশ্য চোখে পড়ার মতন। জীতেন গাইড আমাদের ফ্লেমিংঙ্গোর জায়গায় নিয়ে এলো। জীতেন সহ আমরা ফ্লেমিংঙ্গো পাখির খোঁজ করছি। কোথাও দেখা না পাওয়ায় কয়েকজন ফটোগ্রাফারদের জিজ্ঞেস করলাম। তারা কোথাও পাখিটির দেখা পেয়েছে কিনা। তারা বললো তাদের নজরে এখনও পাখিটির দেখা পাওয়া যায়নি। তারাও আমাদের আধা ঘন্টা আগে এখানে এসে বসে আছে। প্রায় ঘন্টা খানিক অপেক্ষা করার পর ফ্লেমিংঙ্গো পাখির দেখা না পাওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমার দীর্ঘ দিনের পাখি বিষয়ে অভিজ্ঞতার আলোকে যা বুঝলাম তা হলো এরা ঝাড়খান্ডে বা তার আশে পাশে খাবার পেয়ে গেছে। যার জন্য আজ কেওলাদেও বনে আসেনি। আর আসারও সম্ভাবনা নেই। তাই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ভাবলাম সময় নষ্ট না করে এই জোনে আর কি কি পাখি আছে তার খোঁজ নেওয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এমনটা ভেবে সামনে দিকে দলের সঙ্গীদের নিয়ে আগাতে শুরু করলাম।
 
ছোট্ট একটা খাল পার হয়ে একটা খোলা মাঠে এসে দাঁড়ালাম। তখনও কুয়াশা পুরোপুরি কেটে উঠেনি। খোলা মাঠের শেষ প্রান্তে একটা ঘন বন দেখা পেলাম। সেই বনের ভিতর থেকে ফ্লেমিংঙ্গো সাইজের কয়েকটি পাখি বের হয়ে খাবার খুঁজছে। সতীর্থরা সেটাকে ফ্লেমিংঙ্গো ভেবে আমার দিকে তাকালো। বেশ দূরে থাকায় আমিও ঠিক মতন ধারনা করতে পারলাম না। আমি তাদের বললাম সবাই নিজেদের হাইড করুন। পাখি দুটা ঘাসে খাবার খুঁজতে খুঁজতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে। আমি বন্ধুদের বললাম এরা আমাদের সামনে চলে আসবে। ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে বললাম। কথা বা শব্দ করতে বারন করলাম। পাখির ছবি তোলার জন্য যে কোন ফটোগ্রাফারের ধৈর্য্য হলো সবচেয়ে বড় পুঁজি।
 
আমরা সবাই পিনঃপতন চুপ হয়ে শুয়ে আছি। বেশ কিছুক্ষন পর পাখি দুটি যখন সামনে চলে আসলো তখন দেখলাম এরা ফ্লেমিংঙ্গো নয়। এরা Sarus Crane বা লাল মাথা সারস পাখি। এই পাখি আমার ফটোগ্রাফী জীবনে প্রথম দেখা। আজ থেকে বহু বছর আগে একবার আমাদের দেশে রাজশাহীর পদ্মায় সারস পাখির দেখা মিলেছিলো। তারপর আমাদের দেশে এরা কখনই আসেনি। আমরা সবাই মনের মতন করে সারস পাখির ছবি তুললাম। ফ্লেমিংঙ্গোর দেখা না পেলেও সারস পাখির ছবি তুলতে পেরে পরিশ্রম ও কষ্টের কথা ভূলে গেলাম। পাঠকদের একটি কথা বলতে চাই। বার্ড ফটোগ্রাফী বহুাংশে নির্ভর করে ভাগ্যের উপর। দলগত ভাবে ছবি তুলতে গেলেও কে কখন কি ধরনের ছবি পাবে সেটা কেউ বলতে পারে না। তাই ভাগ্যটাও আামদের জন্য বড় একটা সহায়ক।
ছবি দুটি আমার সতীর্থ নাফিসার তোলা।
(চলবে)
সারস পাখি।
 

 

৯৮৩জন ৭৯১জন
0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ