
কোকিলের নাম শোনেননি বা চিনেন না এমন লোক দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোকিলের সুমিষ্ট সুর মন ভরিয়ে দেয়। বসন্ত কালে কোকিল আমাদের দেশে বেশি নজরে পড়ে। তাই আমরা বহুদিনের অদেখা কাউকে দেখলেই উপমা দেই ‘তুমি দেখছি বসন্তের কোকিল হয়ে যাচ্ছো’। কোকিলকে নিয়ে অনেক কবি বা ছড়াকার লিখেছেন। কোকিল আমাদের আবাসিক পাখি। বাংলাদেশের সর্বত্র কোকিল চোখে পড়ে। গ্রামে ও শহরেও এদের বিচরণ যত্রতত্র। এরা বৃক্ষচারী পাখি। গাছের ডালে ডালে উড়ে বেড়ায়। এরা ফলভুক। বটের ফল প্রিয় খাদ্য। এদের দৈর্ঘ্য ৪২-৪৫ সে.মি. হয়।
পৃথিবীতে সব প্রাণীই মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করে। একমাত্র কোকিল ব্যাতিক্রম। এদের জীবন বৈচিত্র ও প্রজনন পরবর্তী কার্যকলাপ অন্যান্য পাখির মত নয়। তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির পাখি। এরা কখনও তাদের ছানাদের চোখে দেখেনি। যার জন্য তারা মাতৃত্বের অধিকার নিয়ে ছানাদের লালন-পালন করতে জানে না। খুবই বৈচিত্রময় জীবন এই কোকিলের। এদের প্রজননের সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত। এরা নিজেরা বাসা তৈরি করতে পারে না বা জানে না। অন্যান্য পাখিদের বানানো বাসায় মেয়ে কোকিল ডিম দেয়। দুই থেকে তিনটি ডিম পাড়ে। প্রজননের পর মেয়ে ও পুরুষ কোকিল এক সঙ্গে থাকে। এরা ধোঁকাবাজিতে পারদর্শী। যে কোন পাখিকে সহজেই ধোঁকা দেয়ার কৌশল এদের খুব ভালো করে জানা। খুব সহজেই অন্য প্রজাতির পাখিকে বোকা বানাতে পারে বলেই পরের উপর নিজেদের বংশ বৃদ্ধির দায়িত্ব অনায়াসে দিতে পারে।
বংশ বৃদ্ধির জন্য কোকিলের নিজস্ব কোনো গুণাবলীও নেই। ডিম পাড়ার সময় হলে তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। কাক বা অন্যান্য পাখির বানানো বাসার আশেপাশে পুরুষ কোকিল ডাকতে থাকে। পুরুষ কোকিলের শব্দ পেয়েই কাক বা অন্যান্য পাখি যাদের বাসা তৈরি করা আছে ও সেই বাসায় ডিম আছে তারা পুরুষ কোকিলকে তাড়া করে। অন্যান্য পাখি মনে করে পুরুষ কোকিল তাদের ডিম ছিনিয়ে নিতে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। যখন কাক বা অন্যান্য পাখি পুরুষ কোকিলকে তাড়া করে সেই সুযোগে পাশে লুকিয়ে থাকা মেয়ে কোকিলটি অন্যান্য পাখির বাসায় টুপ করে বসে পড়ে ও সেখান থেকে দু’একটি ডিম সরিয়ে ফেলে। এবং সেখানে ডিমের সংখ্যা ঠিক রাখতে পাখিটি নিজের ডিম রেখে যায়।
এভাবে দুই থেকে তিনটি বাসায় মেয়ে কোকিল ডিম দিয়ে চিরতরে সেই স্থান ত্যাগ করে। কোনদিন ফিরেও দেখে না তার দেয়া ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলো কিনা! অথচ অন্যান্য প্রজাতির পাখি ডিম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মাতৃত্ববোধ জেগে উঠে। বংশধরদের জন্য তারা খুব সচেতন থাকে। পালা করে মেয়ে ও পুরুষ পাখি ডিমে তা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বাচ্চা ফুটিয়ে বড় করে তোলে। আর এটাই হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। অথচ কোকিল পরের বাসায় ডিম দিয়ে নিশ্চিন্তে উড়াউড়ি করতে থাকে। তারা জানেও না তাদের বাচ্চা কোনটি।
কাক বা অন্য পাখির বাসায় কোকিলের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বাচ্চা ফোটার পর কোকিলের বাচ্চারা অদ্ভুত আচরণ করে। কাকের বাসায় রাখা কোকিলের ডিম থেকে সবার আগে বাচ্চা ফোটে। পরে সেই কোকিলের বাচ্চা অন্য ডিমগুলো ঠেলে বাসার নিচে ফেলে দেয়। মা পাখি দেখে দুটি ডিম নেই। তারপরও সে সদ্য ফোঁটা কোকিলের ছানাদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে ও পরম যত্নে লালন পালন করে। অনেক সময় এর ব্যতিক্রমও ঘটে। কাক বা অন্য পাখির বাচ্চার সাথে কোকিল ছানাও বড় হতে থাকে। বিভিন্ন খাবার মা ও বাবা পাখি সংগ্রহ করে কোকিলের ছানাকে খাওয়ায়। একসময় কাক বা অন্যান্য পাখি বুঝতে পারে এই ছানা তাদের না। তখন আপন মনে কোকিলের ছানা কাক বা অন্য পাখির বাসা থেকে উড়ে পালিযে যায়। এই হচ্ছে কোকিলের জীবন বৃত্তান্ত। মাতৃত্বের স্বাদ না নিয়েও তারা প্রকৃতিতে তাদের বংশ বিস্তার করে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে।
কোকিল ফল ছাড়াও বিভিন্ন পোক খাবার হিসেবে বেছে নেয়। পুরুষ কোকিল কালো বর্ণের হয়। আর মেয়ে কোকিল দুধের স্বরের মত হালকা হলুদ বর্ণের দেহে পালকের উপর কালো কালো ফোটা থাকে। এদের চোখ রক্ত চক্ষুর মত লাল। পুরুষ ও মেয়ে কোকিলের চেহারায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। বড় বড় গাছের ডালে এরা একা চলাফেরা করতে পছন্দ করে। এরা বিপদমুক্ত বাংলাদেশের সহজলভ্য পাখি।
বাংলা নাম: কোকিল
ইংরেজি নাম: Asian Koel
বৈজ্ঞানিক নাম: Eydynamys scolopacea
ছবিগুলো ঢাকা রমনা পার্ক থেকে তুলা।
২৪টি মন্তব্য
শাহরিন
অনেক কিছু জানলাম, পাখি গুলো জন্ম থেকেই স্বার্থপর নাকি নিজে বেচে থাকার তাগিদে অন্য ডিম গুলো ফেলে দেয় তা উপরওয়ালাই জানেন। অনেক ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
অবশ্যই স্বার্থপর। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মাত্র জন্ম নেয়া কোকিলের ছানাটি কিভাবে বুঝে বাকী ডিমগুলি তার স্বজাতের না। খুব ধোঁকাবাজ পাখি। অবশ্যই সৃষ্টিকর্তা ভালো জানেন।
ছাইরাছ হেলাল
অনেক দিন পর পাখি-লেখা পড়ে ভাল লাগল।
কোকিল আমার প্রিয় পাখি, কোকিলের ডাক শুনে আজকেও একটি লেখায় তা নিয়ে এসেছি।
ভাল থাকবেন।
শামীম চৌধুরী
হেলাল ভাই ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। আপনিও ভালো থাকুন।
আরজু মুক্তা
কোকিলা কালো বলে গান শুনে না কে??
অনেকদিন পর পাখি নিয়ে পড়ে ভালো লাগলো।।
শুভকামনা!
শামীম চৌধুরী
বিচিত্র চরিত্রের পাখি কোকিল।
ইঞ্জা
লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো ভাই, জানতে ইচ্ছে করে কোকিলই কি একমাত্র পাখি যে অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে, নাকি অন্য কিছু পাখিও একি কাজ করে?
শামীম চৌধুরী
নাহ ভাই অন্যকোন পাখি কোকিলের মতন আচরন করে না। সবাই নিজ নিজ বাসা করে বা কারো পরিত্যাক্ত বাসায় ডিম পাড়ে। নিজেরাই ডিমে তা দেয় ও বাচ্চা ফুঁটায়। তারা মাতৃত্বের স্বাদও পায়। একমাত্র কোকিল এর ব্যাতিক্রম। সে অন্যের বাসায় ডিম পেড়ে চলে যায়। অধিকাংশ কাজটি করে থাকে কাকের বাসায়।
আর একটি পাখি আছে জলমযূর। মেয়েপাখিটি প্রজননের পর বাসা বানাবে পুরুষপাখির সাথে মিলেমিশে। ডিম পাড়ার পূর্ব পর্যন্ত একসাথে থাকবে। কিন্তু সময়মত নিজের বানানো বাসায় ডিম পেড়ে মেয়েপাখিটি চিরতরে উড়ে চলে যাবে। পুরুষপাখিটি ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুঁটাবে। বাচ্চাদের লালন পালন করবে। খাবার দিবে। যাবতীয় সবকাজ পুরুষ পাখি করবে।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ ভাই। 😊
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা ভাই।
শিরিন হক
তথ্যে ভরপুর, অজানাকে জানলাম। পাখিদের কত বিচিত্র জীবন। যারা প্রকৃতি নিয়ে যানতে চায় তাদের কাজে লাগবে।খুব ভালোলাগলো।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু।
সঞ্জয় মালাকার
পড়ে বেশ ভাল লাগলো দাদা,
চমৎকার একটি লেখা,
পাখি নিয়ে অনেক কিছু জানলাম ও শিখলা।
ধন্যবাদ দাদা।
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্য রইলো শুভ কামনা ভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
মেয়ে কোকিল চিনিয়ে দিলেন! আমি মনে করতাম সব কোকিল দেখতে একই রকম হয়। ধন্যবাদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাখিটার সাথে সার্বিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে। ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
শামীম চৌধুরী
আপনি সহ আপনাদের ভালো লাগাতেই আমার ছবি তোলা স্বার্থক। ধন্যবাদ আপু।
জিসান শা ইকরাম
শ্রস্টা কোকিলদের এমন ভাবেই তৈরী করেছেন। প্রানী কুলের মধ্যে একমাত্র কোকিলই এমন তা জানতাম না। আগে ধারনা ছিল কোকিলের মত হয়ত আরো কিছু প্রানী আছে এমন।
জানলাম এদের সম্পর্কে বিস্তারিত।
ধন্যবাদ আপনাকে এমন পোস্টের জন্য।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্যও রইলো শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
অনেক অজানা জানা হলো। ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
আপনাকেও ধন্যবাদ আপু কষ্ট করে পড়ার জন্য।
তৌহিদ
অনেকদিন পরে আপনার লেখা পড়লাম। সত্যি চমৎকৃত হলাম কোকিল সম্পর্কে নতুন সব তথ্য জেনে।
শুভকামনা জানবেন ভাই।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ তৌহিদ।
রেহানা বীথি
মেয়ে কোকিল যে কিছুটা আলাদা দেখতে, আপনার লেখায় মাধ্যমে জানতে পারলাম। সুন্দর পোস্টটির জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু।