সকাল নয়টায় সাপ্লাইয়ারের অফিসে পোঁছেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, কাজ শেষ করতে করতে দুপুর হয়ে গেল, সাপ্লাইয়ার বললো, চলো তোমাদের নিয়ে লাঞ্চ করবো, সাথে আমাদের সব চেয়ে বড় ক্যাথেড্রাল দেখাবো।
আমরাও এক পায়ে রাজি, রওনা হয়ে গেলাম, ক্যাথেড্রালের কাছাকাছি এসে অস্কার (সাপ্লাইয়ারের ছদ্মনাম দিলাম) এক পার্কিংলটে কিছু লিরার বিনিময়ে (ততকালিন ইটালির টাকা যা এখন ইউরো হয়ে গেছে) গাড়ী পার্ক করে হাটতে শুরু করলাম।
দশ মিনিটের হাটা পথ ছিলো, ক্যাথেড্রালে মুখে এসেই অবাক হলাম, দূর থেকেই দেখা গেলো ক্যাথেড্রাল দ্যুমো ডি মিলানো, কি বিশাল ক্যাথেড্রাল, দূর থেকেই বোঝা যায় তার বিশালতা, ষোড়শ শতাব্দীর এই ক্যাথেড্রাল এখনো সেই আগের মতোই রয়ে গেছে, ক্যাথেড্রালের সামনে বিশাল খোলামেলা জায়গা (হয়ত বড় ফুটবল মাঠ হতে পারতো), যেখানে হাজারো মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, আছে কয়েকশো কবুতর, অনেকেই কবুতরকে গম খাওয়াচ্ছে, কবুতর গুলো কারো মাথায়, কারো কাঁদে, কারো হাতে বসেই খাচ্ছে, ক্যাথেড্রাল মাঠের দুই পাশে আছে বড় দুই শপিংমল, শপিংমল ধরেই হাটছিলাম, সব বড় বড় দোকান, কতো কিসিমের যে দোকান আছে এইখানে তা বলাই বাহুল্য, ব্রান্ড নন ব্রান্ড সব আছে, আছে পেস্ট্রি শপ, ওয়াইন শপ, সবই আছে।
আশ্চর্যজনক ভাবে এইসব শপের সামনের বারান্দা বা ওয়াকওয়েতে আছে ছোট ছোট ফেরিওয়ালা আর তার মধ্যে আমাদের বাঙ্গালিরাও আছেন।
অস্কার আমাদের নিয়ে এক ছোট রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে এক টেবিল দখল করে জিজ্ঞেস করলো, কি খেতে চাও?
আমরা বললাম, তোমাদের পাস্তার অনেক নাম শুনেছি, পাস্তাই খাওয়াও কিন্তু নো পর্ক (শুয়োর)।
সে আমাদের জন্য বাটারফ্লাই পাস্তা, স্পেগেটি বলোনিয়ার অর্ডার দিলো, সাথে বিয়ার।
খাবার এলে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, বাইরে এতো ফেরিওয়ালা দেখলাম, এরা কি বৈধ ভাবে বেচা বিক্রি করে নাকি অবৈধ?
সে জানালো, ফেরিওয়ালারা সবাই অবৈধ, সব ফরেনার (মানে হলো অন্য দেশ থেকে এসেছে), এরা বিভিন্ন কমদামী জিনিষ ফেরি করে বেড়ায়, কেউ ফুল, কেউ ইমিটেশন, কেউ কম দামী কাপড়, মেকআপ, সুভেনির ইত্যাদি বিক্রি করে, আবার কেউ কেউ শিল্পী, তারা অবিকল আপনার চেহেরা ফুটিয়ে তুলে তাদের কাগজ আর পেন্সিলে, পুলিশ আসতে দেখলেই হয়, দে দৌড় সব নিয়ে, সেকি উর্দ্ধশ্বাস দৌড়, ধরা খেলেই তো বিপদ।
আমরা খাবার শেষ করে এগুলাম ক্যাথেড্রালের দিকে, লাইন দিয়ে প্রবেশ করলাম ভিতরে, দ্যুমো ডি মিলানোর বিশালতা বুঝা যায় যখন ভিতরে আপনি প্রবেশ করবেন, ভ্যাটিকান সিটির আন্ডারে এই ক্যাথেড্রাল, এর চারিদিকে কারুকাজ করা রঙ্গিন কাঁচের বড় বড় জানালার মতো করে রাখা হয়েছে যাতে আলো প্রবেশ করতে পারে, আছে বড় বড় মা মেরি আর যিশুর মূর্তি, হাজারো মানুষের স্থান হয় এই ক্যাথেড্রালে, এক জায়গায় এক ফাদার সবাইকে হলি ওয়াটার খাওয়াচ্ছেন অতিথিদের।আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরা ক্যাথেড্রাল, এরপর বেরিয়ে এলাম বাইরে, বাইরে এসে ফটোসেশন শুরু হলো আমাদের, ক্যাথেড্রেলের দরজায় দাঁড়িয়ে, ক্যাথেড্রালকে পিছনে রেখে, কবুতরকে গম খাইয়ে, কতোভাবে না ছবি তুললাম।
এরপর শুরু হলো আমাদের শপিং আর উইন্ডো শপিং, পুরা মল ঘুরে ঘুরে টুকটাক শপিং করলাম, ডকারস ট্রাউজার্স কিনলাম আমার জন্য, এই করে করে সন্ধ্যা হয়ে গেল, এইবার অস্কার আমাদের নিয়ে চললো ডিনারে।
রেস্টুরেন্টের সামনে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বললো, তোমরা বাইরের এক টেবিল নিয়ে বসো, আমি গাড়ী পার্ক করে আসি।
আমরা টেবিল একটা চয়েজ করে বসে পড়লাম, একটু পর অস্কার এসে জয়েন করলো।
ওয়েটার এলো অর্ডার নিতে, অস্কার ইটালিয়ান ভাষায় ভুং ভাং করে অর্ডার দিলো।
একটু পর ওয়েটার আমাদের রেড ওয়াইন সার্ভ করে গেলে আমি চিয়ার্স করলাম অস্কারের দীর্ঘ আয়ু কামনা করে।
আমাদের পানিয় পানের মাঝে এক ছেলে এগিয়ে এলো ফ্লাওয়ার ফ্লাওয়ার, নাইস ফ্লাওয়ার করে করে, কাছে এসে আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ পড়তেই ব্যাটা দেখি উল্টো পায়ে হাটা দিলো, আমি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দেখি ভাইও অবাক, আমাকে বললো কাদের ভাই না (ছদ্মনাম)?
আমি হাঁ বললাম।
একটু পর কাদের আবার এলো, এসে বললো, ভাই আমাকে চিনে ফেলেছেন না?
ছোট ভাই বলে উঠলো, না না কাদের ভাই, আপনাকে আমরা চিনি নাই।
ও লজ্জিত হয়ে বললো, আসলে আপনাদের এইখানে দেখে আমি ভয় আর লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম, আসলে ইটালি এসে আমি কোনো কাজ না পেয়ে এই কাজ করছি, প্লিজ দেশে কাউকে বলবেন না।
আসলে কাদের ছিলো বিখ্যাত এক পরিবারের ছেলে, ওর বড় ভাই মাল্টি মিলিয়নিয়ার।
আমরা ওকে অভয় দিয়ে বিদায় দিলাম।
একটু পর খাবার আসতে লাগলো, প্রথমে এলো লবস্টার, লবস্টার শেষ হলে এলো ল্যাম্ব (ভেড়া) চপ, পাস্তা লাসানিয়া।
খাওয়া শেষে অস্কার বললো, সে খাওয়ার পর ড্রিংক করে, আমরা করবো কিনা?
ভাই অনিহা দেখালে, আমি অস্কারকে বললাম, কোন ড্রিংকস খাবে তুমি?
সে বললো, ইটালিয়ান এক ড্রিংক আছে, নাম গ্রাপ্পা, খুব বেশি এলকোহল যা তুমি খেলে বেহুশ হয়ে যাবে, তুমি অন্য ড্রিংক নাও।
বলে কি ব্যাটা, দেশ বিদেশ ঘুরি আমি, বিভিন্ন ড্রিংকস চেখে দেখি আর এই দেশে এসে গ্রাপ্পা খাবোনা, এইটা হয় নাকি?
আমি বললাম, তুমি কয়টা খাবে (কয় পেগ)?
সে বললো, চারটা, আপাতত একটার অর্ডার দেবে।
আমি বললাম, ওকে তুমি দুইটা গ্রাপ্পার অর্ডার দাও।
সে বুঝতে পারলো, আমি দমার পাত্র নয়, তখন অর্ডার দিলো, সাথে এও বললো, এই একটাই, এরপরে আর পাবেনা, দরকার হলে অন্য ড্রিংকস নেবে।
আমি চুপ মেরে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
গ্রাপ্পা সবুজ আঙ্গুর থেকেই হয় কিন্তু এলকোহলের মাত্রা অনেক।
গ্রাপ্পা এলো, দুজনে চিয়ার্স করে শুরু করলাম, খেতে খারাপ না, দুজনে একে একে চার চারটা পেগ শেষ করার পর সে নিজেই বন্ধ করে দিয়ে বললো, বুঝেছি তুমি থামবে না, তাই আমিই থেমে গেলাম।
আমি মিষ্টি এক হাসি উপহার দিলাম তাকে।
চলবে………
Images: Google.
২৫টি মন্তব্য
নীহারিকা
কাদের ভাইয়ের মত কত কত বাংলাদেশীরা যে এভাবে বিদেশের মাটিতে বেঁচে আছে আমরা জানিও না। ভাবি, তারা কত সুখেই না আছে। এবারের পর্বটি বেশ লাগলো, শুধু শেষের হার্ড ড্রিংক্স এর অংশটুকু বাদে 🙂 কি দরকার ছিলো খাবার?
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
ইঞ্জা
সত্য হলো সে নিজেই কোটিপতির ছেলে হয়েও এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, দাদী।
দাদী ব্যবসায়ী মানুষ আমি, বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে উঠাবসা, মাঝে মাঝে খেতেই হয়।
আগুন রঙের শিমুল
গ্রাপ্পা (3
ইঞ্জা
\|/
আগুন রঙের শিমুল
আমারো মন্তেনেগ্রো খাইতে পার্তেন 😀
ইঞ্জা
আহারে, এইটা টেস্ট করলাম না, মাথা ভাঙ্গার ইমো কই ভাউ? ;?
নীলাঞ্জনা নীলা
কতো মানুষ এভাবে কষ্ট করে উপার্জন করে! দেশে কেউ বোঝেনা। বিদেশ মানে যে সোনার হরিণ!
গ্রাপ্পা? \|/
ইঞ্জা
আপু আমাদের দেশের মানুষ মনে করে বিদেশ মানেই অনেক কিছু, কিন্তু অনেক কিছুর পিছনেই যে আছে বেদনা, গ্লানি, অশ্রু, তা যদি বুঝতো, আহারে…
গ্রাপ্পা \|/
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়া এক্সিডেন্টের পর হাসপাতাল থেকে চল্লিশ দিন পর ফিরলাম। মাঝরাতে ব্যথায় কুঁকড়ে থাকতাম, ছেলেটা ঘুমে থাকতো। কেউ কোথাও নেই। একসময় একটু ফ্লু হলেও পাশে কেউ না কেউ থাকতো। যাক এসব কথা!
ইস গ্রাপ্পা! 😀 \|/
ইঞ্জা
একটা কথা বলি আপু, ওখানে ভালোই আছেন, এই দেশ এখন দুর্গন্ধ ছাড়ছে, এই দেশের মানুষ গুলো আজকাল ভং ধরেছে, আদর বাসনা সবই মেকি। 🙁
গ্রাপ্পা \|/
ছাইরাছ হেলাল
আপনি তো দেখছি বিশাল খাদক!!
পাল্লা দিয়ে মেরে দিচ্ছেন!!
বিদেশের সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে যে পেইন আমার দেশের মানুষ নিচ্ছে তা নিজে দেখছেন বলেই
বুঝতে পারছেন, মাথার ঘাম পায়ে যা কিছু উপার্জন করছে তার কৃতিত্ব নিচ্ছি, কিন্তু ফিরে এসে বিমান বন্দরে পা দিলেই
হেনস্থার শুরু,
আরও বেশি বেশি বর্ণনা চাই সব কিছুর।
ইঞ্জা
ভাইজান, মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্ট করার মজাই আলাদা। 😀
মানুষের কষ্ট কেউ বুঝেনা, বিদেশে দেখবেন বাঙ্গালিরা ভাই ভাই, দেশে আসলেই, তুই কার খালু?
দেশে পা দিয়ে হেনস্থা, নিজের চোখে দেখেছি, হায়না গুলো লোলুপ চোখে তাকিয়ে থাকে কখন জাপিয়ে পড়বে প্রবাসীদের উপর।
ভাইজান অনেক ইনফরমেশন তখন জেনে ছিলাম, যার বেশির ভাগ ভুলেই বসে আছি, ২০০১ এর ঘটনা কিনা।
ছাইরাছ হেলাল
ভুলে-যাওয়া গুলোই একটু ঝেড়ে মুছে দিয়ে দিবেন।
ঠিক ঠিক, চ্যালেঞ্জের মজাই আলাদা।
ইঞ্জা
মচ্চি ;(
মিষ্টি জিন
বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কাদের আমি দেখেছি। এখনও দেখছি। শিক্ষিত অশিক্ষিত কাদেররা বিদেশের মাটিতে কি ধরনের কাজ করে তা কারোরই অজানা না । এদের পাঠানো রেমিটেন্সেই দেশের ইকোনমিক স্ট্রং হচ্ছে।
সুন্দর বর্ননা দিয়েছেন ভ্রমনের।
ইঞ্জা
আপনার চাইতে কেবা বেশি জানে আপু, ভাইয়ার কাজই তো প্রবাসীদের নিয়ে, লিখে ফেলুন না আপনার অভিজ্ঞতা।
জিসান শা ইকরাম
কাদেররা যায় কেন বিদেশে? এই কাদেরই দেশে এসে ফুল বিক্রেতাকে ঝারি দেবে, অবজ্ঞা করবে। এদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করিনা আমি।
গ্রাপ্পা!! ইতালি কখনো গেলে আপনার সাথে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখবো 🙂
ইঞ্জা
একদম মনের কথা বলেছেন ভাইজান, এই কাদের ব্যাটা দেশে ফিরে আসার পর মানুষই চিনেনা, সুযোগে পেয়ে বলেছিলাম, ফুলওয়ালা তোর খবর কি?
এরপর থেকে সে আমার সামনে দিয়েও হাটেনি কখনো।
গ্রাপ্পা, আমরা যারা মাঝে মাঝে ড্রিংকস করি, তাদের জন্য অবশ্যই করা, কিন্তু টেস্ট সেইরাম।
ঘুরে আসুন ভাইজান ইটালি, যাবেন আমার প্রিয় শহর মিলান, রোম, ভেনিস, দেখবেন পিসার হেলানো টাওয়ার, পঞ্চম ও ষোড়শ শতাব্দীর স্থাপনা, দেখার মতো দেশটি।
খেয়ে দেখবেন ওদের পিজ্জা, ওদেরটা খাওয়ার পর অন্য দেশের, আমাদের দেশের পিজ্জাকে যথেষ্ট গালাগালি দেবেন। 😀
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সেখানেও ফেরিওয়ালা!ভ্রমণ কানিহী ভাল লাগছে…অনেক কিছুর সাথে নতুন পরিচয় হচ্ছি। -{@
ইঞ্জা
ভাই জীবনে অনেক দেশ ঘুরেছি, পড়াশুনার কারণে ইটালি যেন আমার সেকেন্ড হোম, যদি সব নিয়ে লিখতে বসে যায়, তাহলে আজীবন শেষ করতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে?
লীলাবতী
ভাইয়া ইতালি ভ্রমনের প্রতিটি পর্বই পড়েছি। আপনি ভ্রমনের ডিটেইলস দেন খুবই যত্ন সহকারে। ভাল লাগে তা। ওয়াইন!!!! 🙁
ইঞ্জা
ধন্যবাদ আপু, চেষ্টা করি যেন ডিটেইল দিতে পারি, নাহলে লেখাটি যে জমবে না।
ওয়াইন 🙁
আপু ওয়াইনে বেশি এলকোহল থাকেনা, যেমন দরুণ আঙ্গুরের জুস।
অপ্সরা
দূর্ভোগ শিরোনামে পড়লেও, পোস্ট পড়ে মজা পেলাম!
ইঞ্জা
আপু দুর্ভোগ শিরোনাম তার কারণও আছে যা ফিরতি পথে হবে, শুধু দুর্ভোগের কথা বললে ভ্রমণ কাহিনী আর জমবে না। 😀
ইঞ্জা
কিছু দুর্ভোগ অবশ্য ১ম পর্বেই এসেছে আপু।