ভারতবর্ষের সব থেকে প্রাচীনতম সাহিত্য হলো ‘বেদ’। এর মধ্যে ঋকবেদ হল সর্বাপেক্ষা প্রাচীন।ঋকবেদ থেকে জানা যায় আর্য জাতীর ভারতে আসার আগমন সম্পর্কে। তাদের জীবন যাত্রা সম্পর্কেও বেদ থেকে জানা যায়। আমরা ইতিহাসে দেখেছি যে, প্রত্নতত্ববিদরা বিভিন্ন সময়ে মাটির নীচে অনেক নগর আবিষ্কার করেছেন। ভারতবর্ষেও প্রাচীন সৌধ, স্মৃতি ও নগরের ধ্বংসাবশেষ থেকে বিভিন্ন যুগের সভ্যতা ও তার অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারা যায়। ভারতের সিন্ধু নদীর কোলঘেষে গড়ে উঠেছিল মহেন্জোদারো ও হরপ্পা নামের প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা। মহেন্জোদারো কথাটির অর্থ হলো”মড়ার ঢিপি”। হরোপ্পা অবশ্য পান্জাবের রাভি নদীর তীতে অবস্থিত।

আমরা ইতিহাস পড়ে এটুকু বুঝতে পারি যে, আগে মানুষ ছিল যাযাবর। তারা নিজেদের খাদ্যের যোগান ও তাদের পালিত গো খাদ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীর খাদ্যের যোগানের জন্য এক যায়গা থেকে অন্য জায়গায় বসতি গড়ে তুলতো বড় বড় নদীকে ঘিরেই। ইতিহাসবিদগণের ধারণা, তারা নগর গড়ে তুলতো অনেক পরিশ্রম করেই। পরে খাদ্য সংকট ও গোত্রে গোত্রে বিবাদের কারণে তারা নতুন নতুন যায়গার সন্ধানে বের হতো। এর প্রধান একটা কারণ হতে পারে তাদের খাদ্য উৎপাদন ও তা সংরক্ষণ। আগে মানুষ যুক্তি ও বিজ্ঞানের চিন্তা থেকে দূরে ছিল। যখন কোনো কারণে তাদের ফসল উৎপাদন কম হতো বা ভারী বর্ষণে ডুবে যেতো তারা সে এলাকা ছেড়ে চলে যেতো এই বিশ্বাসে যে, হয়ত কোনো দেবতার অভিশাপ পড়েছে তাদের উপর। আর এ কারণে সে নগর ছেড়ে আসার পর কালের বিবর্তনে তাতে ধুলো পড়ে জমে জমে সে নগর মাটির নীচে চাপা পড়ে যেতো।

মহেন্জোদারো ও হরপ্পায় প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাক-ঐতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে সকল কথা জানা যায়। সিন্ধু সভ্যতার লিখিত ইতিহাস না থাকায় একমাত্র মাটি খুঁড়ে যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে তারই ভিত্তিতে এ সভ্যতার ইতিহাস রচিত হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের ফলে ভারতবর্ষের সভ্যতা আর্য সভ্যতা থেকেও যে প্রাচীন তা আমরা বুঝতে পারি। এই সিন্ধু সভ্যতাকেই তাম্রযুগ বলা হয়। সিন্ধু অধিবাসীরা তামা বা ব্রোঞ্জের তৈরী জিনিসপত্র ব্যাবহার করতো। এরাই প্রথম চাকার ব্যাবহার করে। গরুর গাড়ির প্রচলন এই সভ্যতা থেকেই শুরু বলে ধারণা করা হয়।

পাটলিপুত্র, তক্ষশিলা, সারনাথ প্রভৃতি প্রাচীন নগরীর খননকাজের ফলে এই যুগের জনসাধারণের জীবন যাত্রা, ধর্মবিশ্বাস, শিল্প, স্থাপত্য সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে সিন্ধু সভ্যতা কোন জাতি তৈরি করেছিল তা কেউ সঠিক বলতে পারে না। তবে অনেকেই দাবি করে যে সিন্ধু সভ্যতা হয়ত আর্যরা তৈরি করেছিল। তাদের যুক্তিঃ সিন্ধু নগরে যে মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে তাতে আর্য জাতির কঙ্কাল আছে। কিন্তু যে সকল প্রমাণ পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় যে, বৈদিক সভ্যতা বা আর্য সভ্যতা আনুমানিক ১৫০০বা ১৪০০ খ্রীঃপূঃ আগে ভারতে ছিল না। এই কারণে আর্য জাতি সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্ঠা এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে প্রচুর পার্থক্য দেখা যায়। সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগর কেন্দ্রিক, আর্য সভ্যতা ছিল গ্রামীন। সিন্ধু অধিবাসীরা লোহার ব্যবহার জানতো না। আর্যরা ব্রোন্জ বা তামার পাশাপাশি লোহার ব্যবহার জানতো। সিন্ধু অধিবাসীরা মাতৃপূজো ও শিবপূজো করতো, বৈদিক আর্যরা ইন্দ্রো, মিত্র, বরুণ প্রভৃতি দেবতার পূজো করতো।
বিভিন্ন মাটির পাত্র দেখে বোঝা যায় আর্যদের থেকে সিন্ধুদের মৃৎশিল্প উন্নত ছিল। সিন্ধু অধিবাসীরা রং এর ব্যবহার করতো। তারা বানিজ্য করতো। বৈদিক আর্যরা পশুপালন ও কৃষিকাজই বেশি করতো। সিন্ধু অধিবাসীরা পোড়ামাটির তৈরি বহুতল বাড়িঘর তৈরি করতো। তাতে স্নানঘর থাকতো। বৈদিক আর্যরা খড়ের তৈরি ঘরে বাস করতো। সিন্ধু নগরের মৃতদেহগুলো সাধারণত কবর দেওয়া হতো, পরে অবশ্য কেউ কেউ কিছু মৃতদেহ দাহও করে। বৈদিক আর্যরা তাদের মৃতদেহ দাহ করতো। লিপিবিদদের মতে, সিন্ধু লিপি ছিল চিত্রলিপি, আর বৈদিক লিপি ছিল রৈখিক।

কোনো কোনো পন্ডিতের মতে, সিন্ধু সভ্যতা ছিল সিমেরীয়দের সৃষ্টি। ফাদার হেরাস প্রভৃতি পন্ডিতেরা বলেন, সিন্ধু সভ্যতা দ্রাবিড় জাতির সৃষ্টি। তার মতে, আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগে দ্রাবিড়রাই ছিল এখানকার আদি সন্তান। তাদের সভ্যতারই আগে বিকাশ ঘটে। আর্যরা পরে ভারতবর্ষে আগমনের ফলে দুই সভ্যতা মিলে যায়।

তথ্যসূত্র ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া। জওহরলাল নেহরু, পৃথিবীর ইতিহাস, ভারত ইতিহাস পরিক্রমা লিখেছেন ড. শ্রী প্রভাতাংশু মাইতি

ভারতবর্ষ ইতিহাসের টুকরো কথনঃ আর্যজাতি পর্ব-১

================================
#অসুস্থ থাকার কারণে পর্বটা দিতে দেরি হলো। এজন্য দুঃখিত।

৯২৫জন ৯২৫জন

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ