ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি রিকশা নামক একটি ত্রিচক্রযান । এটি শুধু এই বাংলাদেশেই নয়, রিকশা বা সাইকেল রিকশা একপ্রকার মানবচালিত মনুষ্যবাহী ত্রিচক্রযান, যা এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে প্রচলিত একটি ঐহিহ্যবাহী বাহন । বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী ত্রিচক্রযানটির বিস্তার এশিয়া মহাদেশের বহু দেশের শহর- বন্দর আর গ্রাম-গঞ্জে সবখানে সবজায়গায় । যদিও দেশভেদে এর গঠন ও আকারে বিভিন্ন পার্থক্য দেখা যায় । ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বঙ্গদেশে রিকশা আবিষ্কার হওয়ার বহু আগেই গণচীন, ভারত আর মিয়ানমারে ও জাপানে আবিষ্কার হয়েছিল । এগুলো কোনোকোনো দেশে দুচাকারও আছে, যা ঠেলাগাড়ির মতো মানুষে টেনেটুনে চালায় ।
উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধান থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে রিকশা আসে ১৯১৯ সালে রেঙ্গুন থেকে চট্টগ্রামে। তবে ঢাকায় রিকশা চট্টগ্রাম থেকে আসেনি; এসেছে কলকতা থেকে। নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীরা নিজস্ব ব্যবহারের জন্য কলকাতা থেকে ঢাকায় রিকশা আনেন । সম্প্রতিককালে (২০১১) সাইকেল রিকশায় বৈদ্যুতিক মোটর সংযোজন করার মাধ্যমে ব্যাটারিচালিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এজাতীয় রিকশা চলাচল করছে । বর্তমানে আমাদের দেশেও বিভিন্ন শহরে এই দেহচালিত ত্রিচক্রযানটির সাথে মোটরচালিত রিকশা দিয়ে সমাজের অবহেলিত কিছু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে আসছে । এটি ছাড়া যাদের জীবিকা নির্বাহ করার আর কোনো উপায় নাই, তাদের জীবন চলার সব আশা ভরসার চাবিকাঠি হলো রিকশা । হোক দেহচালিত হোক ব্যাটারিচালিত রিকশা, গরিব মানুষের জন্য এই বাহনটি হলো সীমিত পুঁজিতে আয় করার মতো একটা সহজ পন্থা ।
যেমন: যাদের নিজের কোনো রিকশা নাই, তারা দেহচালিত রিকশা দৈনিক ১১০ টাকা আর ব্যাটারিচালিত রিকশা দৈনিক ২০০ টাকা মহাজনকে ভাড়া দিয়ে আয় করতে পারে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত । আর মোটরচালিত বা ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা তৈরি করতে ব্যয় হয় নীচে ৪০০০০ হাজার টাকা, পুরাতন কিনতে লাগে রিকশা বুঝে ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা । বর্তমানে বেশিরভাগ রিকশাচালক বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করে অতি কষ্টে একটি রিকশা নিজেই করে ফেলে । প্রতিদিন তার ইনকামও হয় ভালো, পরিশ্রমও হয় কম, যদিও একটা রিকশার ব্যাটারি চার্জ (বৈদ্যুতিক) সহ গ্যারেজ ভাড়া দিতে হয় দৈনিক ৭০/৮০ টাকা । তার সাথে আছে এলাকাভিত্তিক প্লেট ভাড়া, যেসব প্লেট সংগ্রহ করতে প্রথমে অগ্রিম বাবদ ১০০০ টাকা আর মাসিক ভাড়া ১২০ টাকা । ওইসব কতিপয় প্লেট মালিকদের কাছ থেকে প্লেট না-নিলে আর রিকশা চালাতে পারবেনা, ধরা পরলেই রিকশাওয়ালাকে রিকশা ছাড়িয়ে আনতে গুনতে হবে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা । দেহচালিত রিকশা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশার পার্থক্য শুধু দৈহিক পরিশ্রম একটু কম, আর কিছুই নয় । যারা এই ত্রিচক্রযান রিকশাকে পেশা হিসেবে বেঁছে নিয়েছে, তারা শুধু এটির ওপর নির্ভর করেই পরিবার পরিজন নিয়ে এই সমাজে বেঁচে আছে কোনরকম ভাবে, কেউ শহরে কেউ বন্দরে । সেই রুজি নির্ভর রিকশা যদি হয়ে যায় নিষিদ্ধ, তখন ওই লোকের পরিবারবর্গের উপর পড়ে যায় বজ্রাঘাত ।
ইদানীংকালে আজ কয়েকদিন যাবত সকালবিকাল নারায়োণগঞ্জ শহরের আনাচেকানাচে অলিগলিতে মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, আগামী ১৫ মে’র আগে থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে ব্যাটারি খুলে ফেলতে হবে । অন্যথায় ১৫ মে’র পর কোনো রিকশায় যদি ব্যাটারিচালিত অবস্থায় ধরা পড়ে, তখন তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে । ভালো উদ্যোগ ও প্রশংসনীয়, এই সুন্দর উদ্যোগের জন্য সাধুবাদ জানাই । এই সুন্দর উদ্যোগ কার্যকর হলে শহরের যানজট কিছুটা হলে নিরসন হবে আশা করি ।
কিন্তু এই রিকশার চেয়েও বেশি আছে বর্তমানে কচুগাছের মতো গজে ওঠা লক্ষলক্ষ অটোবাইক, যেসব অটোবাইকের জন্য যত্রতত্র সৃষ্টি হয় যানজট । এই অটোবাইকের জন্য নিষেধাজ্ঞা আসেনা কেন? তাদের কি রোড পারমিট আছে? উত্তর আসবে না । অথচ: ব্যাটারিচালিত রিকশার চাইতে চারগুণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, এই অটোবাইক যানটির । বাংলাদেশের সব জেলাশহরের ন্যায়, আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহরেও এসব অটো-বাইকের জন্য পথচলা দায়, শুধু বাইক আর বাইক । এইসব অটোবাইকের কারণে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রুটের বাস, মিনিবাস, লেগুনা, বেবিট্যাক্সি ও সিএনজি চালকরা আজ পথে বসতে লেগেছে । এখন কোনো যাত্রি নিকটতম গন্তব্যে পৌছতে চাইলে এই ছোট বাহন অটোবাইকটাকেই বেছে নেয়, কোনো বাস মিনিবাসের জন্য আর অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকেনা । সিএনজি ড্রাইভাররা সারাক্ষণ স্ট্যান্ডে বসেবসে করে হায়-হুতাশ, তাদের পরিবার পরিজন থাকে অনাহারে অর্ধাহারে, বছরের পর বছর টানতে থাকে ঋণের বোজা । আবার সময়সময় দেখা যায়, এসব ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে দেহচালিত রিকশা মানুষ বেশি উঠতে চায়না, তাড়াতাড়ি জরে কোনো জায়গায় যেতে চাইলে এই ব্যাটারিচালিত রিকশাকেই মানুষ বেছে নেয় । যারা দেহচালিত এই বাহনটির নির্ভরশীল, তাঁরাও আজ পথে বসে পরেছে ।
এসব অটোবাইকের জন্য শরের রাস্তাঘাটের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে । বিনা রোড পারমিট ছাড়া আর সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি ছাড়া শহরের আনাচেকানাচে চলছে এই অটোবাইক যানগুলো । এমনিতেই আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে থাকে বিদ্যুতের মহাসংকট, তার উপরে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা আর অটোবাইকের ব্যাটারি চার্জ, যেন মারার উপর খড়ার ঘাঁ । এসব রিকশা আর অটোবাইক চার্জ দেওয়ার জন্য শরের যত্রতত্র গড়ে উঠেছে বড়বড় গ্যারেজ । কোনোকোনো গ্রেজের সঠিকভাবে কোনো মিটারও নাই, বিদ্যুৎ অফিসের কিছু অসাধু কর্মচারীদের হাত করে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে এই রিকশা আর অটোবাইক চার্জের ব্যবসা । একটা অটোবাইক চার্জের জন্য দিতে হয় দৈনিক ১৩০ টাকা, একটা রিকশার জন্য দিতে হয় দৈনিক ৭০ টাকা । বর্তমানে এমন অবস্থা হয়েছে যে, প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ শহরে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি এই ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোবাইক রাস্তায় নামছে হুর হুর করে । এসব অটোবাইক নিয়ে রাস্তায় নামছে স্থানীয় ব্যক্তিরা, যাদের বাড়িঘর ব্যাংক ব্যালেন্স আছে তাঁরা ।
যখন নতুন অটোবাইক কিনে রাস্তায় নামানো হয়, তখন দুএকমাস সুন্দর দেখা যায়, এরপর এসব অটোবাইকের আর কোনো চেহারা সুরত থাকেনা । তখন রাস্তার পরিবেশ হয়ে পড়ে কুশ্রী, সৌন্দর্যের ওপর নেমে আসে বিপর্যয় । ওইসব অটোবাইকের জন্য বড়বড় গাড়ীগুলোও ঠিকমতো চলতে পারেনা । আমরা মনে করেছিলাম, যদি কোন একসময় এইসব অবৈধ ব্যাটারিচালিত যানবাহনের উপর নিষেধাজ্ঞা আসে, তবে এই অটোবাইকের উপরেই প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি হবে । কিন্তু না, হচ্ছে উল্টে । যেখানে একটা অটোবাইক কিনতে লাগে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা, সেখানে একজন গরিব মানুষের একটা রিকশার মূল্য ৩০ থেকে ৪০ হাজার । সেখানে বেশি মূল্যের অটোবাইকের উপর নিষেধাজ্ঞা নেই, আছে দিন দুঃখী গরিব অসহায় মানুষের রিকশার উপর । ব্যাটারিচালিত রিকশার উপর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে, সেখানে ব্যাটারিচালিত অটোবাইকের উপরে কেন নয়? আমরা জানি, আইনের চোখে সবাই সমান, তাহলে কেউ পাড় পেয়ে যাবে কেউ ছাড় পাবেনা, তা কেন হবে? নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে দুটোর জন্য হতে হবে, নাহয় কোনোটার জন্য নয় । সবাই আমাদের সমাজের মানুষ, সবাই সমানভাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করুক, এটাই চাই ।
১০টি মন্তব্য
মৌনতা রিতু
আসলে মুখে আমরা যতোই বলি, কাজ করি কতোটুকু। সময়, বসার সুবিধা, হুড এসব কিন্তু আমরা নিজেদের বেলাতেই বেশি ভাবি।
গরীবদের নিয়ে ভাবনাটা আসলে তখন কেন যেন কাগজে কলমেই থেকে যায়। যেমন আমি,
ভাল লিখেছেন ভাই।
বাবু
এগুলো উঠিয়ে দেওয়া ভালো, তবে সবাইকে সমান ভাবে দেখা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
ধন্যবাদ ভালো থাকবেন ।
ছাইরাছ হেলাল
খুব কঠিন একটি বিষয় নিয়ে ভাবছেন।
সুষ্ঠু নিতিমালা আমাদের একান্ত দরকার। কিন্তু তা হচ্ছে কৈ!!
বাবু
দাদা, আমরা কেউ কাউকে দেখতে পারিনা । নাহয়, এটা হবে ওটা হবে-না-কেন? নিষিদ্ধ হলে সবই হতে হবে । আর বিশেষ করে এগুলো এখন বন্ধ করবে কীভাবে, তাই ভাবছি দাদা।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমাদের দেশে জোর যার, মুল্লুক তার। এটাই তো স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হতো সেটাই যদি অটোবাইক নিষিদ্ধ করা হতো।
বাবু
আশা করি দুয়োটাই নিষিদ্ধ করতে হবে দিদি । নাহয় কোনোটাই করতে পারবেনা । ধন্যবাদ দিদি ভালো থাকবেন ।
জিসান শা ইকরাম
কোন কিছুই নিয়ম মত হচ্ছে না, অনিয়মটাই নিয়ম। তাই এমন হচ্ছে।
বাবু
নমস্কার গুরু । গুরু অনিয়মেরও-তো একটা নিয়ম থাকা চাই, সেটাও নাই। তাহলে চলবে কী করে?
ধন্যবাদ গুরু ভালো থাকবেন আশা করি ।
নীহারিকা
খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন।
নিতাই বাবু
অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে । বর্তমানে এই ঘোষণা বন্ধ হয়ে গেছে । মন্তব্যের প্রত্যুত্তর দিতে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করছি ।