রোজ সকালে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে যে পথে বাড়ি ফিরি, সে পথে পাশাপাশি আরেক মা-ও ফিরেন। কিছু দূর হেঁটে আমাদের পথ বেঁকে যায় দু’দিকে। এই বেঁকে যাওয়ার আগ অবধি আমাদের কথা হয়। খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন আমায়, কেমন করে খেলার ছলে বাচ্চাদের পড়ায় মনোযোগী হতে শেখাবো কিংবা ঘুমাতে যাবার আগে বই পড়ায় অভ্যস্ত করে তুলবো। ভীষণ সচেতন এক মা। তাঁর কাছ হতে আমার অনেক কিছু শেখা, জানা।
এরপর অনেকগুলো দিন আমি একলাই ফিরি। মনের গহীনে এক প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে ফিরি। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানুষ আমরা। কাউকে জিজ্ঞেস করবার কিংবা খোঁজ নেবার সময় হয় না !
জানলাম, ক্যান্সার ধরা পড়ার পর অনেকগুলো মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। জটিলতা ছড়িয়েছে পুরো শরীরে। এখন শুধু ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করার চিকিৎসা। ক’দিন হয় বাড়িতে এনেছে। সকাল বিকাল দুই বেলা নার্স ডিউটি করছে বাড়িতেই। ছেলেমেয়ে দুটি স্কুলে যায় নিয়মিত। স্বামীও জবে যায়। জীবন থেমে থাকে না কারো।
এক সকালে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে ক’জন সেই অসুস্থ ভাবীকে দেখতে যাবেন বলে স্থির করলেন। আমি তাঁদের সাথে গেলাম না। একজন মানুষ নিশ্চিত মারা যাচ্ছে, আর আমি তাঁকে শেষ বিদায় জানাবো__ এতটা মানসিক শক্তি আমার নেই। আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটি। এই প্রথম আমার বাড়ি ফেরার পথটুকু একলা লাগে। ভীষণ একলা। পৃথিবীর সমস্ত কিছু থেকে একা, বিচ্ছিন্ন এক পথ…
যারা দেখতে গিয়েছিলেন, তাঁরা কেউই পরবর্তী কয়েক রাত ধারাবাহিক ভাবে ঘুমোতে পারেনি। খেতে পারেনি। আকারে ছোট্ট এক শিশুর মত দেখতে, চুলহীন মাথা, অচেনা এক মানুষ … আমি আর সেইসব বর্ণনা শুনতে চাইনি। বাড়ি ফিরি প্রান চঞ্চল, হাসিখুশি মানুষটির মুখখানি মনে করতে করতে। ভেসে যাওয়া মেঘের আকাশ দেখতে দেখতে। দীর্ঘশ্বাস নেই। স্রষ্টাকে বলি, যা কিছু তাঁর জন্যে ভালো, তুমি তাই করো প্রভু।
সহসাই তিনি মারা গেলেন। ছেলে মেয়ে দুটিকে প্রতিবেশীদের কাছে রেখে স্ত্রী’র লাশ নিয়ে স্বামী একাকি দেশে গেলেন। ক’দিন থাকলেন। বিয়ে করলেন দ্রুততম সময়েই। বাস্তবতা হল, ছোট দু’টি ছেলে মেয়েকে দেখে রাখবার কেউ ছিল না এই এক্লার দেশে।
রোজ সকালে সেই একই পথ ধরে হেঁটে আসবার সময় এবার আমার পাশাপাশি অন্য একজন। নতুন মা। অল্প সল্প গল্প শেষে আমাদের পথ দুই দিকে বেঁকে যায়। দশ বছরের মেয়েটি এখন ষোলোতে। আজ তাঁর সুইট সিক্সটিন। অল্প পরিসরে ঘরোয়া ভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। অনুরোধ ফেলতে পারিনি, তাই যাওয়া। কালো লেহেঙ্গায় অদ্ভুত মায়াময় লাগছিলো মেয়েটিকে। বললাম, এত সুন্দর ড্রেস কে পছন্দ করে কিনলো ? চোখে মুখে আনন্দের হাসি খেলে গেলো তাঁর। বলল, ” ছোট মা “।
কিছু দৃশ্য বেশ গেঁথে থাকে মনে। “ছোট মা” মেয়েটিকে চুল বেঁধে দিচ্ছেন… ব্রেসলেট পরিয়ে দিচ্ছেন__ সব কিছুতে কেমন এক যত্ন আর মমতা মাখা। আগলে রাখা। প্রতিবেশী দুই একজন বলাবলি করছিল, ওদের মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি এই মা। ওরা ভালোভাবেই বেঁচে আছে অন্য এক মায়ের যত্ন আর মমতায়__ এরচেয়ে ভালোলাগা আর কি হতে পারে ?
অনুষ্ঠান শেষে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছি। চাঁদহীন আকাশ আর একলা আমি।
ভীষণ মনে পড়ছে মানুষটিকে যে আমাকে শিখিয়েছিল, কিভাবে বাচ্চাদের পড়াশুনায় মনোযোগী হতে শেখাবো কিংবা ঘুমের আগে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবো।আমার গলা ভিজে আসে। এ ভেজা আনন্দের, সুখের, আশীর্বাদের।
আমরা প্রতিনিয়তই সৃষ্টিকর্তার পরীক্ষার সম্মুখীন হই, তাই না ?
২০টি মন্তব্য
খসড়া
সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টি নিয়ে সারাক্ষনই খেলেন, এটা তার অনন্দ।
রিমি রুম্মান
হয়তো বা…
ভাল থাকুন সবসময়।
শুভকামনা…
ড্রথি চৌধুরী
জেনে ভাল লাগলো যে বাচ্চাগুলো অযত্নে অসহায় না বং সুন্দর ভাবে বেঁচে আছে তার ” ছোট মা” এর কাছে! সেই ভাবী যেখানেই থাকুক তার সন্তানরা ভাল আছে জেনে তিনিও ভাল থাকবেন !
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। তিনি ভাল থাকলে ছোট মা ও ভাল থাকবেন, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
অনিকেত নন্দিনী
ছোট মা তাঁর ভালোবাসায় বাচ্চা দুটিকে জড়িয়ে নিয়েছেন জেনে ভালো লাগলো। বাচ্চা দুটি এক মা হারিয়ে আরেক মায়ের আদর পাচ্ছে। কত বাচ্চা আছে যাদের বাপ/মা বেঁচে থেকেও নেই, তাদের কথা নাই বলি। 🙂
ওপার থেকে এপারের কিছু কি দেখা যায়? খোঁজখবর পাওয়া যায়? দুটি প্রশ্নের উত্তরই হ্যাঁ হলে বাচ্চাদের মা নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবেন।
কত্তো কত্তো পরীক্ষা দেই রোজ! কিছু গোচরে, কিছু অগোচরে।
ভালো থাকবেন আপু। ভালোবাসা। -{@
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন আপনিও। ভালোবাসা -{@
জিসান শা ইকরাম
এমন ঘটনা বিরল
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর উল্টো অবস্থা দেখা যায়
ছোট মা তার স্বামীর সন্তানদের শত্রু ভাবেন।
শ্রষ্ঠার লীলা বোঝা অত্যন্ত কঠিন।
ভাল থাকুক পরিবারের সবাই।
রিমি রুম্মান
ছোট্ট এই জীবনটাতে চাইলেই ভাল থাকা যায়।
তবুও আমরা সব কিছু জটিল করে তুলি অযথাই।
জটিল না করে সহজ করে দেখলে সবকিছুই সহজ হয়ে উঠে।
এই ছোট মা হয়তো এমনই সহজ করেই নিয়েছেন সব।
ইলিয়াস মাসুদ
আমারো এমন অবস্থার মুখোমুখি হবার সাহস হয় না, আমার ভীষন প্রিয় এক জন মানুষ বেশ কিছুদিন ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে দিন গুনছে,অথচ আমি কিছুতেই সেই মুখ টা দেখতে যেতে পারছি না, অনেকে অনেক কথা বলছে আমার না যাওয়া নিয়ে কিন্তু আমি তার এমন মুখটি দেখতে চাই না,আমার চোখে লেগে আছে যে সুন্দর মুখ খানা সে তেমনই থাক।
সব নতুন মা এমন হয় না, এই মায়ের জন্য রইল শুভ কামনা ….
রিমি রুম্মান
বাস্তবতা ভীষণ নির্মম । আমাদের এমন নির্দয় পরিস্থিতির মুখোমুখি যেন হতে না হয়, সেই প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তার প্রতি।
ছাইরাছ হেলাল
অভাবিত হলেও এখনও এমন ঘটনা ঘটছে বলেই হয়ত আমরা বেঁচে থাকি আশার আলো নিয়ে
ঐ যে,
খেলিছ বিশ্ব লয়ে আপন মনে………………………
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছে। ভাল থাকুন অনেক।
শুভকামনা…
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যা সকল মা হোক এমন।
আমার সম্পরকে একভাবি আছে তারও সৎ মা আছে।
ভাবি কাদলেই বলত কেন কাদছ তমার কোন অভাব ত আমি অপূর্ণ রাখি না।
রিমি রুম্মান
এমন ভাল ছোট মা আমি একজন নয়, কয়েকজন দেখেছি এই প্রবাসে।
পৃথিবী থেকে এখনো মমতা, ভালোবাসা’রা হারিয়ে যায়নি…
নীলাঞ্জনা নীলা
কবিতা-গল্পে মন্তব্য করা খুব সহজ। কিন্তু জীবনের যে গল্প ওখানে কোনো কথা থাকেনা।
শুধু আবেগী অনুভূতিগুলো নিশ্চুপ হয়ে ভাবতেই থাকে।
মেয়েটির ভাগ্য অনেক ভালো এ কারণে, ছোট মা বিমাতা সুলভ আচরণ দেখায়নি।
মেয়েটি জীবনে স্বস্তি পাক, এই প্রার্থনা করি।
রিমি রুম্মান
এখনো পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে বলেই আমরা “মানুষ” পরিচয় দিতে পারি।
এখনো এমন কিছু মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই পৃথিবী অসাধারন রকমের সুন্দর …
নীলাঞ্জনা নীলা
ঠিক বলেছো আপু।
মৌনতা রিতু
জীবনের বাস্তবতা।ভালোর মধ্যেই হয়তো আমাদের বসবাস বেশি।মায়ের ওই মাতৃত্ব চির অটুট থাক।বেশ ভালো লাগলো গল্পটা।
ধন্যবাদ। :c
মৌনতা রিতু
আপনার এই লেখাটা আমার ওনাকে পড়ালাম।আসলেও গলা ভিজে আসে এই ললেখাগুলো পড়ে।পরক্ষনেই আনন্দ।কখনও ভাবি,যদি আমি চলে যাই ঐ না ফেরার দেশে!আমার সন্তান পাবে কি এই যত্ন,এই বন্ধন?
অসংখ্য ধন্যবাদ।
রিমি রুম্মান
এমন চিন্তা করবেন না। সন্তানদের ভালোর জন্যে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি, প্রার্থনা করি।
আমাদের আশেপাশেই অনেক ভাল মানুষের বিচরণ। শুধু দেখা হয় না চক্ষু মেলিয়া তাঁহাদের।
ভাল থাকুন প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে। -{@