
মাহবুবুল আলম।।
১.
শেষ পর্যন্ত যে তার ভাবনাটা এভাবে খাপের খাপ মিলে যাবে তা কষ্মিনকালে ও ভাবেনি মৃদুল। যে একটি কথা পিউকে বলবে বলে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগছিল সে, সেই কথাটাই পিউ কিছুটা আগে তাকে বলেছে। শুধু বলেইনি; হাতে একটা চিরকুট ও ধরিয়ে দিয়েছে। সেই চিরকুটটা এখন ওম দিচ্ছে মৃদুলের পকেটে। কিন্তু বিয়ে বাড়ির এতসব ঝামেলা ও ভিড়ের মধ্যে চিরকুটটা যে খুলে একটু চোখ বোলাবে সে সুযোগটিও এখন পর্যন্ত করে ওঠতে পারেনি মৃদুল। এ জন্যে তার মনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে।
মামাত বোন নাসিমার বিয়ে উপলক্ষে মৃদুলরা তাদের মামার বাড়ি এসেছে। খুব ধুমধামের সাথে বিয়ে হচ্ছে নাসিমার। সব আত্মীয়-স্বজনেরই সমাবেশ ঘটেছে এ বিয়ে অনুষ্ঠানে। মৃদুল এসেছে ঢাকা থেকে, পিউরা এসেছে চিটাগাং থেকে। সারা বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনে গিজগিজ করছে। আর উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের উচ্ছ্বাসের ডামাঢোল, হইহুল্লোর চেচামেচি চিৎকারে যেন কাঁপছে মোল্লা বাড়ির প্রতিটি ঘর। চলছে হার্ডবিটের গান।
রক্ষনশীল মোল্লা বাড়িতে গান-বাজনায় বিধি-নিষেধ আছে। কিন্তু সকল বিধি-নিষেধকে তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে গান বাজনার জমজমাট আসর জমিয়ে বসেছে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা। দুচারজন মুরুব্বী বাধা দিয়ে ও জুত করে ওঠতে পারেননি আধুনিক জামানার এইসব ছেলে-মেয়েদের সাথে। মুরব্বীরা বাধা দিতে আসলেই তেড়ে এসেছেন বাড়ির মহিলারাও
: যান যান আপনারা মুরব্বীরা পোলাপানের আনন্দে বাঁধা দিতে আইয়েন না। আপনেগো কামে আপনেরা যান।
একটু পরেই শুরু হবে নাসিমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। নাসিমাকে হলুদ শাড়ি পরিয়ে কানে-গলায় তাঁজা গাদা ফুলের অলঙ্কার পরানো হচ্ছে। সবাই যখন অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই সবাব চোখ ফাঁকি দিয়ে মৃদুলকে আড়ালে ডেকে নিয়ে অসম্ভব রকমের একটা কাজ করে বসেছে পিউ।
মৃদুল যখন গায়ে হলুদের মঞ্চের ফাইন্যাল টাচ দেয়ার কাজে ব্যস্ত ঠিক তখনই পিউ’র ছোট ভাই বাবু এসে মৃদুলকে বলে-
: মৃদুল ভাইয়া, পিউ আপু না আপনাকে ডাকছে।
: কোথায় তোমার আপু! মৃদুল বাবুকে বলে।
: ঐ যে আপু বাংলো ঘরের ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।
মৃদুল বাংলো ঘরের দিকে তাকাতেই দেখে, পিউ বাংলো ঘরের আলো আঁধারীতে কেমন একা একা দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুল ধীর পায়ে হাঁটা দেয় বাংলো ঘরের দিকে। পিছু পিছু আসে বাবু ও।
কাছে এসেই মৃদুল বলে-
: পিউ তুমি কী আমায় ডেকেছিলে?
: আপনার কি মনে হয়? কিরে বাবু তোদের মৃদুল ভাইয়াকে কী আমি ডেকেছিলাম নাকি?
: ও -রে ব্বাবাবা, এখন দেখি উল্টা কথা, তুমি না ডাকলে ওনাকে ডেকে আনতে কী আমাকে কুকুরে কামড়িয়েছে নাকি। পিউ তার ছোট ভাইটিকে আদুরে ধমক লাগায়-যা ভাগ।
: কাজতো শেষ এখন তো আমাকে ভাগতে বলবেই; দেখেন মৃদুল ভাই আপুটা কী স্বার্থপর। পিউ আপু আমাকে আর কখনো তোমার কোনো কাজে পাবেনা মনে রেখ।
: বাবু! তোমাকে কী পিউ মাঝে মধ্যে এ সব কাজে লাগায় নাকি? মৃদুল বলে।
: না আ-আ-আ। বাবু কিছু একটি বলতে যাবে পিউ আবার ধমক লাগায় বাবুকে।
: এই বাবু গেলি, না লাগাবো থপ্পর একটা। বাবু ভেংচি কেটে, দেয় এক ভোঁ দৌড়।
: এখন বল কেন ডেকেছ? মৃদুল বলে।
: ডেকেছি যখন কারণ তো নিশ্চয়ই আছে। আর বাবুকে এ কথা বললেন কেন; যে আমি তাকে কি প্রায়ই ডাকা ডাকির এসব কাজে লাগাই নাকি।
: না আমিতো কোনো কিছু মিন করে বলিনি। হেসে বলে মৃদুল।
: কোন কিছু মিন করে বলেননি মানে। আপনি কি এ কথাটার অর্থ জানেন?
: না জানি না তো। আবার হাসে মৃদুল। স্বগতোক্তির সুরে পিউ বলে-
: মিচকে শয়তান। ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেনা।
: ঠিক আছে যা বলবে তাড়াতাড়ি বল, ওদিকে আবার ডাকাডাকি শুরু হয়ে যাবে। মৃদুল তাড়া দেয়।
মৃদুলের বেরসিকের মত কথা শোনে পিউ রেগে যায়-
: ঠিক আছে যান আপনার কাজে যান, কোনো কথা নেই আপনার সাথে।
: শুধু শুধু রাগ করনা পিউ। প্লিজ বল কেন ডেকেছিলে?
পিউ কোনো কথা বলে না, অভিমান করে অন্য দিকে তাকিয়ে একটা নির্দোষ গাছের পাতা ছিঁড়ে। মৃদুল অনুনয়ের সুরে বলে-
: ঠিক আছে আমার ভুল হয়ে গেছে; এ ভাবে বলাটা আমার ঠিক হয়নি। প্লিজ বল, কি বলতে ডেকেছিলে-
মৃদুলের এ কথায় পিউ’র অভিমানের বরফ গলে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলে-
: আপনি এত ব্যস্ত মানুষ, আপনাকে একটু সময়ের জন্য ও নিরিবিলি পাওয়া যায়না, আপনার সাথে আমার একটা জরুরী কিছু কথা ছিল। কথার পিঠেই বলে মৃদুল-
: কী জরুরী কথা !
: একান্তে ডেকে এনে একটা ইয়াং ছেলের সাথে একটা ইয়ং মেয়ের কী কথা থাকতে পারে, তা কি আপনি বুঝেন না। নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকেন।
হঠাৎ করেই পিউ’র মত মেয়ের কাছ থেকে এমন একটি কথা শুনবে, তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলনা মৃদুল। ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট পুলকিত হলে ও বাহ্যিক অবয়বে একটা রাশভারী ভাব ফুটিয়ে তোলে বলে-
: তুমি আসলে কি বলতে চাচ্ছ ঠিক বুঝতে পারছিনা।
মৃদুলের মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় পিউ-
: ওরে আমার ন্যাকা! ওনি কিছুই বুঝেন না। তো আমার দিকে কাঙালের মত এমন করে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন কেন? পিউ’র কথা শুনে মৃদুল চাপা হাসি হেসে বলে-
: এটা বয়সের দোষ। এ বয়সে সব ছেলেই সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তারপর সে একটা নজরুলের কলি ভাজে-
‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি’ … সুরটা থামিয়ে মৃদুল হাসে।
হাসি দেখে ও গানের কলি শোনে পিউ আবার বলে-
ঢং করতে হবেনা, আর বত্রিশটা দাঁত বের করে হো হো হেসে সবাইকে জড়ো করার দরকার নেই।
আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে মৃদুল বলে-
: এই, হাসা এক্কেবারে বন্ধ। এখন কি বলবে বল।
মৃদুলের কথা বলার ভঙ্গি দেখে পিউ’র হাসির ফোয়ারা নামে যেন।
হাসি থামিয়ে বুকের জামার ভাজ থেকে একটা ছোট খামের মত মৃদুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে পিউ বলে-
নেন এ’টা। পড়ে দেখবেন কি লিখা আছে এ’তে। তাড়াতাড়ি উত্তর দেবেন নাইলে খবর আছে। বলে দিলাম কিন্তু। অনেকটা আদেশের সুরেই পিউ কথাটা বলে কেমন এক মোহনীয় দৃষ্টিতে মৃদুলের দিকে তাকায়। পিউর মাতাল করা হাসিতে ভেতরে ভেতরে মৃদুল গলে যায়। কিন্তু নিজের গলে যাওয়া ভাবটা পিউকে বুঝতে না দিয়ে মৃদুল হাসে। হেসে হেসেই বলে-
: এই মোবাইল বিপ্লবের যুগে চিঠি!
: কারো মোবাইল নাম্বার আমার জানা থাকলে তো। আর কেউ মোবাইল ব্যবহার করে, কি করে না তা ও তো আমি জানিনা।
: এটা হলো তিন হাতের এক হাত, তাই না।
: তিন হাতের এক হাত মানে?
: সব কিছুরই মানে বলতে হয় না।
: কেনো নেই। কথাটা যেহেতু বলেছেন এর মানে বলতেই হবে। না হলে কিছুতেই আমার কিউরিসিটি যাবেনা। আর এমন বিয়ে বাড়ির আনন্দের মাঝে কোনো কিউরিসিটি নিয়ে আমি থাকতে চাই না।
: আরে বোকা মেয়ে; তিন হাতে এক হাত হলো– অজুহাত।
মৃদুল হাত বাড়িয়ে কাগজটা হাতে নিতেই, গায়ে হলুদের মঞ্চের কাছ থেকে একটা হৈচৈ এর আওয়াজ আসে। মৃদুল পিউকে তাগাদা দেয়-
চল পিউ। ওই দিকটায় কী যেন সমস্যা হয়েছে, তাড়াতাড়ি চল। চলবে…
২০টি মন্তব্য
মোহাম্মদ দিদার
বেশ ভালো লেগেছে।।
পরের পর্বের অপেক্ষা …..
মাহবুবুল আলম
সাথে থাকার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ!
মোহাম্মদ দিদার
এটা বয়সের দোষ!!!
অজস্রবার হুনছি কতাডা….
মাহবুবুল আলম
শুভেচ্ছা জানবেন!
তৌহিদ
মৃদুল আর পিউ এর প্রেম কাহিনী ভালোই জমবে মনে হচ্ছে। চলুক লেখা।
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা তৌহিদ ভাই!
জিসান শা ইকরাম
অত্যন্ত সুন্দর ভাবে পিউ মৃদুলের প্রেম আরম্ভ হলো,
উপন্যাসের সুরুটা চমৎকার,
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
শুভ কামনা।
মাহবুবুল আলম
এটি একটি ত্রিভূজ প্রেমের গল্প। ধন্যবাদ জিসান ভাই!
সঞ্জয় মালাকার
অত্যন্ত সুন্দর ভাবে পিউ মৃদুলের প্রেম আরম্ভ হলো,পড়ে বেশ ভালো লাগেছে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
মাহবুবুল আলম
আজ দ্বিতীয় পর্ব দিলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ!
মোঃ মজিবর রহমান
অনেক দিন পর মন ভরে লেখা উপন্যাস পড়লাম মাহবুব ভাই। ধন্যবাদ। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
মাহবুবুল আলম
ভাল লাগলো জেনে খুশি হলাম! আজ দ্বিতীয় পর্ব দিয়েছি। সময় করে দেখবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
অল্রেডি পড়েছি ভাইয়া।
কামাল উদ্দিন
মৃদুল আর পিউ এর প্রেম কাহিনীর শেষটা ভালো হইলেই ভালো। কিন্তু কাহিনীর নাম বিরূপ বসন্ত হওয়ায় আমি শেষাংশ নিয়ে শংকিত, তবু চলুক প্রেমোপন্যাস।
মাহবুবুল আলম
খুশি হলাম। আজ দ্বিতীয় পর্ব দিয়েছি। ধন্যবাদ!
কামাল উদ্দিন
দেখে নেবো
নিতাই বাবু
মৃদুল আর পিউ এর প্রেম কাহিনী পড়ে ভালো লাগলো শ্রদ্ধেয় দাদা। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
মাহবুবুল আলম
ভাল লাগলো জেনে খুব খুশি হলাম দাদা! আজ দ্বিতীয় পর্ব দিয়েছি। শুভেচ্ছা জানবেন!
নুর হোসেন
ধারাবাহিক উপন্যাস পড়ে ভাল লাগলো,
আপাতত মন্তব্য রেখে গেলাম।
বিকালে এসে পুর্বের পর্ব গুলো পড়ে নিবো।
ভাল থাকুন।
নৃ মাসুদ রানা
প্রেমের আভাস পাওয়া যাচ্ছে