
ধীরে ধীরে আকাশটা অন্ধকারে রূপ নিচ্ছে।দমকা হাওয়ায় আকাশের ঘন কালো মেঘগুলো দিশেহারা।কখনো উত্তরে কখনো বা দক্ষিন দিকে ছুটাছুটি করছে।এ দিকে প্রিয়তমা হারানোর শোক ইকরামুলের মনে কষ্ট ব্যার্থতার ঝড় বইছে তবুও বিশ্বাসে অটুট আছেন আল্লাহর উপর।
মাতলীর অপারেসনের জন্য টাকা ও রক্তের যোগান এখনো হয়ে উঠেনি।হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার এসে বলবেন
-সরি!আপনার ওয়াইফকে আর বাচানো গেলো না।
এমন অলক্ষুনি ভাবনাগুলো মনে আসতে হঠাৎ হাটু গেড়ে নামাজের মতন ফ্লোরেই বসে পড়লেন ইকরামুল।দু’হাত তুলে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন।দু’চোখের দুপাশ দিয়ে বেয়ে পড়ছে জলের ফুটা।সেকেন্ড মিনিট ঘন্টা পার হয়ে গেল ইকরামুল মোনাজাত ছেড়ে উঠছেন না।হঠাৎ এক সহকারী ডাক্তার বা নার্স এর কন্ঠে ইকরামুলের নাম ধরে ডাক শুনে চমকে উঠে বললেন।
-ইকরামুল সাহেব কে?
-জ্বি জ্বি আমি,
-রোগী আপনার কী হয়?
-জ্বী আমার স্ত্রী..
-তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।তার সফল অস্ত্রপাচার হয়েছে।তবে তার সাথে দেখা করতে এখন পারবেন না সময় হলে আমরা ডাকব।
ইকরামুল সাথে সাথে ফ্লোরে আল্লাহর কাছে শুকিয়া আদায় করতে সেজদায় পড়ে গেলেন।কিন্তু মনে খটকা লাগল।এতো টাকাপয়সা রক্ত কে দিলো?
নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন।এর মধ্যে সেই অপারেসন রুম হতে আসা বেশ কয়েকজন ডাক্তারদের দেখলেন মুখ কালো করে তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে তাকিয়ে চলে যাচ্ছেন।তার মনে হল হয়তো ডাক্তারদের মাঝে তার এ বিষয়টি নিয়ে কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে।ঠিক সেই সময় যে ডাক্তারটি ইকরামুলকে বার বার এসে তাকে টাকা এবং রক্ত যোগার করে রাখতে বলেছিলেন সেও তাকে দেখে না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলেন।ইকরামুল তাকে ডাক দিলেন।ডাক্তার তার সামনে এসে বললেন,
-সরি ভাই আপনাকে বার বার বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
-না না স্যার কী যে বলেন!আপনাদের চেষ্টায় আজ আমার স্ত্রীকে বাচালেন আল্লাহ।সে জন্য কৃতজ্ঞ আমি।
-না আমাদের কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে কৃতজ্ঞতা জানান গিয়ে আমাদের বিভাগীয় প্রধান সার্জন আহসান হাবীব স্যারকে।
ইকরামুলের যেন সার্জনের প্রতি কৃতজ্ঞায় মন কেদে উঠল।এর মধ্যে সম্ভবত এক নার্স এসে তাকে বললেন।
-হাবীব স্যার আপনাকে তার অফিসে ডাকছেন।আসুন আমার সাথে।
ইকরামুল সার্জেন ড. হাবীবের অফিসে ঢুকার সাথে সাথে ড. হাবীব তাকে সালাম দিলেন।ইকরামুলও সালামের জবাব দিলেন।অবশ্য ইকরামুলের বেশভুষা দেখে সালাম না দিয়ে থাকাটা একজন মুসলমানের জন্য অসম্ভব হয়ে যায়।সার্জেন ড.হাবীব ইকরামুলকে চেয়ারে বসতে বলে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।ইকরামুলেরও হাবীবের ফেইসটা চেনা চেনা বলে মনে হচ্ছে।
-আচ্ছা আপনি মালতীর কি হন?
-জ্বি আমি ওর স্বামী
হাবীব আশ্চর্য হলেন।একজন পাক্কা মুসলিম একজন হিন্দু মেয়ের স্বামী হয় কেমনে!ডাক্তারীর মত কঠিন বিদ্যার সূত্র মাথায় ঢুকলেও হাবিবের এ বিদ্যা মাথায় ঢুকছে না।ইকরামুলের হাবীবের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে হাবীবকে অনেকটা চেনা চেনা মনে হল।আরে এতো আর কেউ নয়! এতো তার কলেজ লাইফের বন্ধু হাবু ।হাবীবও এবার অনেকটা আচ্ করতে পারলেন।তার মনে পড়ল সে যখন ডাক্তারী লেখা পড়ার পাঠ চুকাতে বিদেশ ছিলেন তখন যে শুনেছিলেন-তার একবন্ধুর তাদেরই এক হিন্দু বান্ধবী মালতীকে বিয়ে করে দেশান্তর হয়েছেন।তাহলে!এই কী সেই!হাবীব এবার পুরোটাই চিনে ফেললেন।বসে থাকা নিজের চেয়ার থেকে উঠে অনেকটা রাগ হয়ে ইকরামুলের চেয়ারে সামনে এসে বললেন।
-এই উঠ…উঠ চেয়ার থেকে উঠ…দেবো এক থাপ্পর বলে ইকরামুলকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।ইকরামুলও বহু বছর পর বন্ধুকে পেয়ে খানিকটা আলিঙ্গণে থাকলেন। উভয়ের চোখে আনন্দঅশ্রু।
এরপর যে যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
-এবার বল কেমন ছিলি এ কটা বছর?
-এইতো মন্দের ভাল আলহামদুলিল্লাহ।
-ভাগ্য ভাল যে মালতীর ফাইলটা আমি ইচ্ছে করে দেখতে চেয়েছিাম নতুবা আমার ডাক্তাররা আজ তাকে চিকিৎসা না দিয়েই বিদায় করে দিতেন।
-মানে?একটু খুলে বলবি?
-শুন তাহলে…
ফ্লাসব্যাক,
মালতীর চিকিৎসা সেবার টাকার ব্যাবস্থা করতে যখন ইকরামুল সময় সুযোগ সব হারিয়ে ফেলেছেন তখন অন ডিউটি ডাক্তার মালতীর ফাইলটার ছাড়পত্র নিয়ে ডাক্তার নার্স সবাই কানাগুষা করছিলেন ফাইলটার বিষয়ে স্যারকে জানাবেন কীনা।তাদের অনেকে না জানানোর পক্ষে থেকে আর সবার মতন তাকেও বিদায় করে দেয়া হউক এমন এক ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যাবেন ঠিক সেই সময়ে তাদের মাঝে একজন ছিলেন যিনি ডা.হাবীবের অত্যান্ত বিশ্বস্ত পিএ মত তিনি গিয়ে ডা.হাবীবকে জানালেন।
-আসবো স্যার?
-এসো, বলো কীছু বলবে?
-জ্বী স্যার।মালতী নামের এক পেসেন্ট তার হাসবেন্ড অপারেসনের টাকা যোগার করতে পারছেন না।
-তো কী হয়েছে?যা করার তাই করো।
-ঠিক আছে স্যার,
পিএ রুম হতে বের হওয়ার দেহ বাক নিতেই ড. তাকে থামালেন।
-কী নাম বললে?
-মালতী,
-মালতী!যাওতো ফাইলটা নিয়ে আসো।
জ্বী স্যার।ফাইলটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে তার রুমে ফের ঢুকলেন।হাবীব ফাইলটা হাতে নিয়ে মালতীর ঠায় ঠিকানা বাবার নাম সব কিছু পড়ে দৌড়ে রোগীর নিকট গিয়ে অবাক হলেন।
আরে এতো আমার কলেজ বান্ধবী মালতী।কেমন নিথর দেহে চিকিৎসাহীন পড়ে আছে তারই হাসপাতালে।অন্য ডাক্তারদের বললেন তাকে দ্রুত যেন অপারেসন টেবিলে নেয়া হয়।এ অপারেসনটা সে নিজে করবেন।অপারেসন সফল হবার পর সব ডাক্তার নার্স দায়ীত্বপ্রাপ্ত সকল কর্মকর্তাদের বললেন।
-এমনটি যেন আর কখনো এই হাসপাতালে না হয়।টাকা বড় না মানুষ বড়।টাকার জন্য একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে বাচাবেন না এটা কেমন কথা এ আবার কেমন সেবক! মনে রাখবেন পৃথিবীর সকল মানুষই কোন না কোন ভাবে আপনার আমার আত্মীয়-আপনার আমার আপণ জন।আজ যদি আমি এই ফাইলটি না দেখতে পারতাম তাহলেতো হয়তো আজ আমি আমার কলেজ বান্ধবীকে চির তরে হারাতাম।
-তারপর যদি আর একটু দেরী হতো তাহলে হয়তো মালতীকে আর বাচাতে পারতাম না।মাথাটা দুভাগ হয়ে গিয়েছিলো মগজটা অনেকটা বের হয়ে গেছিল।হার্ট সচল ছিলো বলে অক্সিজেন দিয়ে অনেকক্ষণ রাখতে পেরেছিলাম।
-যাক উপর আল্লাহর ইচ্ছায় তোর উছিলায় আমি আমার মালতীকে ফিরে পেলাম।সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
-আরে ধ্যাত!কৃতজ্ঞতার কি আছে!মালতীতো আমারও ক্লোজ বান্ধবী।
-তবুও …আচ্ছা খরচ কত দিতে হবে?
-দেখ এবার কিন্তু রেগে যাবো বুঝলি!তাছাড়া তোর কাছ থেকে নেবো কেন যাকে চিকিৎসা করছি সে সুস্থ হয়ে উঠুক।তখন পুষিয়ে নেয়া যাবে।
উভয়ের চেহারায় খুশির ঝিলিক।এক বন্ধু পেয়েছেন তার দুই বন্ধুকে আর এক বন্ধু ফিরে পেয়েছেন হারাতে যাওয়া তার প্রিয়তমাকে।
আসছে শীতে কোথায় কোথায় ওয়াজ মাহফিল করবেন তা নিয়ে এক সভায় ইকরামুলও যোগ দিলেন।যদিও শীত এলে মাহফিল,সময় এখনো ঢের বাকী কিন্তু এখন থেকেই নামী দামী বক্তাদের সিরিয়ালের জন্য দৌড়াতে হবে।প্রয়োজনে অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখতে হবে।এই একটা মৌসুমে মসজিদ মাদ্রাসার একটু বাড়তি ইনকাম হয় সেই সাথে নেতাদেরও পেট ভরে।আর একটা শ্রেনী আছেন যারা টাকা কালেকটসন করবেন ইসলাম ধর্ম মতে নাকি তারা শতকরা ২৫ ভাগ টাকা পাবেন।তাদের জন্য এটা একটা বাড়তি ইনকাম।তাই সভাস্থল খুশির আমেজে সরগরম।
চলবে,,
তৃতীয় পর্ব যদি ইচ্ছে হয় পড়তে পারেন
১৪টি মন্তব্য
রোকসানা খন্দকার রুকু
বাহ্ দুই বন্ধুর দেখা হয়ে গেল। এদিকে মালতিও বেঁচে গেল।
দেখা যাক সামনে কি রেখেছেন আমাদের জন্য।
শুভ কামনা ভাই।
মনির হোসেন মমি
হুম।ধন্যবাদ আপূ।
হালিমা আক্তার
আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
মনির হোসেন মমি
দোয়া করবেন।
ছাইরাছ হেলাল
প্রকৃত বন্ধু এসে উপস্থিত, অপেক্ষা করি।
মনির হোসেন মমি
হুম ধন্যবাদ প্রিয়।
তৌহিদুল ইসলাম
বন্ধুর জন্য বন্ধুর ভালোবাসা ইদানিং বিরল। তবে ডাক্তার বন্ধুত্বের পাশাপাশি মানবিকতাকেও প্রকাশ করেছেন। এটি তার বন্ধু না হয়ে অন্য কেউ হলে এমনটা হতো না মনে হয়।
সবশেষে নিজের স্ত্রীর জন্য টাকা যোগাড় করা ইকরামুল চিন্তা করছে ওয়াজমাহফিলের টাকা যোগাড়ের।…..
বাকী মন্তব্য পরের পর্বে করবো। ভালো লাগলো পড়ে।
শুভকামনা ভাই।
মনির হোসেন মমি
বন্ধু না হয়ে এমনটি হয়ওনি যা ড. তার অন্যান্য স্টাফদের ডেকে বলে দিয়েছেন।আসলে একটি প্রতিষ্ঠানের অনেক কিছুই উপরের লেবেল পর্যন্ত অনেক সময় যায়না ।যখনি যায় তখন হয়তো কোথাও কোথাও পরিবর্তন ঘটে।
সুন্দর মন্তব্যে আপ্লুত হলাম।ধন্যবাদ।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ঈশ্বর সহায় হলে কোনো না কোনো উছিলায় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বন্ধু বাঁচালো আরেক বন্ধুকে, আরেক বন্ধুর প্রিয়তমা স্ত্রীকে। আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। তাড়াতাড়ি পর্বটি দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন শুভকামনা অবিরাম
মনির হোসেন মমি
ধীরে ধীরে পারফেক্ট ব্লগার হচ্ছি।দোয়া করবেন। চমৎকার মন্তব্য।অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আগামী পর্বের অপেক্ষায়।
শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
দোয়া করবেন যদি বেচে থাকি।ধন্যবাদ।
সাবিনা ইয়াসমিন
বিপদে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় ঘটে।
যেভাবেই হোক মালতী আর ইকরামুলকে এই যাত্রায় রেহাই দিয়ে আমাদের চিন্তা মুক্ত করলেন।
আগামী পর্বের অপেক্ষা করি।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ বড় আপু।দেখা যাক গল্পের বাক কোন দিকে যায়।