বাসায় ফেরার দিনে সময়টা খুব দ্রুত কেটে যায়। সকল কাজকর্ম অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। করেও। একটু তাড়া থাকেই। সহকর্মীদের মৃদু হাসি…আসন্ন কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস কি? যার উৎপত্তি ওদের যার যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে।
বাইরে বের হতে হতে সোয়া সাতটা বেজে যায়। অন্যরা আরো পনের মিনিট আগেই বের হয়েছে। অফিস গেটের সামনের চায়ের দোকানগুলোতে অলস আড্ডা দিচ্ছে কেউ কেউ। ফুটপাথে আমের ঝুড়ি এবং কাঁঠাল সাজিয়ে নিয়ে বসেছে একজন। পাশের দুটো গাছে কাপড়ের ব্যানার, ‘ এখানে ফরমালিনমুক্ত আম-কাঠাল পাওয়া যায়।’ হাঁটতে হাঁটতে ভাবে , যে হারে ফরমালিন মিশানো ফল খেয়ে এসেছে এতোগুলো বছর, তাতে এখন হঠাৎ ফ্রেশ ফল খেলেই বরং অসুবিধে।
রাস্তায় বের হলে দুই ধরণের মানুষ দেখা যায়। যারা নিজের গাড়িতে চলাফেরা করে আর অন্যরা পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করে। প্রাইভেট কারের ভিতরে যারা থাকে তারা ট্রাফিক জ্যামের বিড়ম্বনাটুকু এসির ভিতরে বসে উপভোগ করা ছাড়া আর তেমন কিছু অনুভব করে কি? যত কষ্ট সব তো পাবলিক পরিবহনের যাত্রীদের। একটা রিক্সা নিয়ে হাইওয়ে দিয়ে যেতে থাকে।বাম-ডান দু’পাশ দিয়েই বাস-ট্রাক আর ম্যাক্সির ভীড়। যে যেভাবে পারছে ফাঁকা পেলেই নিজের গাড়িটি ঢুকিয়ে দিয়ে অলস বসে থাকছে। রিক্সাগুলো পথচারীদেরকে হঠাৎ চমকে দিয়ে বেল বাজিয়ে ফুটপাথের সংকীর্ণ যায়গাটুকুও দখল করে নিচ্ছে। এরা সবাই পোশাক শ্রমিক। সারাদিনের পরিশ্রান্ত দেহটিকে একটু আরাম দেবার জন্য হাতে হটপট নিয়ে বাসায় ফিরছে। ওর খুব ভালো লাগে এই বাড়ি ফেরা মানুষগুলোকে দেখতে।
একটা ব্যাংকের সামনে রিক্সা থামে। অনেকগুলো ফলের দোকান অবৈধভাবে চলাচলের পথে গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের পাতি নেতারা টাকা খায়। এরা খায় না কি তা-ই ভাবে সে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় আসে সবাই। তাই যত পারে খেয়ে নিতে চায়। সপ্তাহের শেষ দিনে বাড়ি ফেরা মানুষের ভীড়টা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশী-ই থাকে। বাসের ছাদে মানুষ, ভিতরে বাদুড় ঝোলা হয়ে ঝুলছে। তারপরও সবাই উঠতে চায়। গেটে কয়েকজন ঝুলে ঝুলে চলছে। একটা ইঞ্জিন চালিত অটো এসে থামতেই মিছিল করে সবাই কে কার আগে উঠবে সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। সে অপেক্ষা করতে থাকে একটু অপেক্ষাকৃত কম ভীড়ওয়ালা বাহনের।
অবশেষে একটা ম্যাক্সীর সামনে ড্রাইভারের পাশে একজনের যায়গায় দুজন বসে রওয়ানা হল। চাপাচাপি এবং দুর্ঘটনার শিকার হলে একেবারে নেই হয়ে যাবার শঙ্কাকে বুকে নিয়ে পথ চলা। এক ধরণের থ্রীলও অনুভব করে। তবে ড্রাইভার ব্যাটার বকবকানি কানকে এবং ওর ধরানো সিগ্রেটের ধোয়া পরোক্ষভাবে ফুসফুসকে ঝালাপালা করে দেয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। যে দেশে আইন হলেও বিধিমালার অভাবে আইন এক্সিকিউট হয়না, সেখানে এইটুকু নাগরিক টর্চার তো সহ্য করতেই হয়।
ম্যাক্সী থেকে নেমে কিছুটা হাঁটতে হয়। এসময় তলপেটে চাপ অনুভব করে। কিন্তু রাস্তার পাশে তো আর ভারমুক্ত হওয়া যায় না। তাই মনের দুঃখ মনেই চেপে রেখে পরবর্তী রুটের বাহনের খোঁজে রাস্তায় ভীড় করা ‘পাবলিকে’র সাথে মিশে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে।
এভাবে আরো দুবার বাহন পরিবর্তন… সেই একই বিড়ম্বনা… প্রচন্ড ভীড়ে মানুষের ঘামের দুর্গন্ধে শরীর গুলিয়ে ওঠা… বিড়ি-সিগ্রেটের ধোঁয়ায় জ্বালা করা চোখের রক্তবর্ণ লাভ … স্বল্প পরিসর যায়গায় কোনো যুবতীর পাশে বসে তার শরীরের সাথে লেপ্টে থেকে ওর অসহায়ত্বটুকু অনুভব করে ম্রিয়মান হওয়া… আর অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়া নিয়ে যাত্রী এবং কন্ডাক্টরের ভিতরের বচসা শুনে ক্লান্ত হতে হতে একসময় নিজের বাড়ির পথের প্রান্তসীমায় পৌঁছানো। নিজের অজান্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসা। এ যেন প্রচন্ড একটা উত্তেজনামুখর স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে বের হয়ে একটি সাউন্ডপ্রুফ রুমে প্রবেশ করা।
দেড় ঘন্টার পথ পৌনে তিনঘণ্টায় অতিক্রম করাতে বাড়ির রাস্তাটি একদম নীরব… স্তব্ধ… কোথায়ও কেউ নেই। রাস্তার কুকুরগুলোকেও দেখা যায়না। দু’পাশে গাছ নিয়ে অন্ধকারে একটা সোজা রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে বাড়ির পরিচিত রাস্তাটিতে এসে পৌছায়। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠে। যে মেয়েটি সপ্তাহ ধরে ওর জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছে, সে খুব মোলায়েম স্বরে জানতে চায়, ‘তুমি কোথায়?’ এতোক্ষনের জ্বালা-যন্ত্রণা টেনশন-হতাশা মুহুর্তেই উধাও হয়ে সেখানে আসন্ন এক ভালোলাগার সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে মন। হাঁটার গতি কিছুটা বেড়ে যায়। অন্ধকারে মিশে থাকা গাছগুলোকে এতোক্ষণ অশরীরী’র মতো মনে হচ্ছিল। এখন ওদেরকে কত চেনা পরম বন্ধু মনে হয়। ওরাও পথের দুপাশে পরম হিতৈষীর মতো ডাল নুইয়ে পাতা দুলিয়ে স্নেহের পরশ বইয়ে দিয়ে যায়। তাতে ওর হৃদয়মন দুই-ই শান্ত হয়।
লাইফ ইজ বিউটিফুল!
তবে এ দেশে জীবন আমাদেরকে কিছু কিছু সময়ে এই অনুভূতির উদ্রেক করায়। বাকিটা সময়ে ওর কাছে জীবনকে ইদানিং কেমন এক বোঝা মনে হয়। যা থেকে মুক্তির একটা পথ কখনো কখনো এ হৃদয় পেতে চায়… … …
‘… এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সুর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব, পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া-
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সুর্য উঠে।’
সে একজন রানার… ছুটে চলাই যার নিয়তি। এর ভিতরেই যা কিছু উপভোগ করা… অপেক্ষায় থাকা কোনো এক বনলতার ফোন পেয়ে বেঁচে থাকার প্রেরনা লাভ করা… কোনো এক নির্জন তাল গাছের থেকে একটু দূরে ভারমুক্ত হওয়া… যানবাহনের ভীড়ে কোনো অচেনা তরুনীর সাথে লেপ্টে থেকে নিজের মনের ভিতরের কালো সাপকে দমন করা… এসব কিছু মিলিয়েই বর্নীল জীবন।
আর জীবনের প্রয়োজনেই সে একজন রানার। সিড়িদের বুক মাড়িয়ে অনেক উচুতে উঠে যাওয়া… কিন্ত পদস্খলনের ভয়ে পিছিয়ে যাওয়া নয়। জীবন তো কেবলি সামনের দিকেই এগিয়ে যায়।
সে ও যায়।।
[ কবিতাঃ রানার, সুকান্ত ভট্টাচার্য]
২৪টি মন্তব্য
খেয়ালী মেয়ে
ভালো লাগলো (y)
মামুন
ভালো লাগার অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
সঞ্জয় কুমার
এভাবেই চলছে আমাদের মত মধ্যবিত্তের দিনযাপন ।
মামুন
আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম!
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
শুভসকাল।
শিশির কনা
তারপরেও লাইফ ইজ বিউটিফুল। ভালো লিখেছেন ভাইয়া।
মামুন
অনুভূতি ছেড়ে গেলেন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভসকাল।
সায়ন্তনু
আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আছে তা বুঝতে পারছি।
মামুন
আমার ব্লগে স্বাগতম!
অনুভূতি রেখে সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
শুভসকাল।
সীমান্ত উন্মাদ
এরি নাম হল বেঁচে থাকা। অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য। তবুও নিরন্তর ভাল থাকুন বেলা অবেলার গল্প গানে
মামুন
নান্দনিক অনুভূতির প্রকাশে মুগ্ধ হলাম!
অনেক ধন্যবাদ। শুভসকাল।
হৃদয়ের স্পন্দন
জীবন কেবল সামনেই এগিয়ে যায়
মামুন
অনেক ধন্যবাদ।
শুভসকাল।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার দেখার চোখ আছে।
কবিতাটি জুড়ে দিয়ে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে এসেছেন লেখায়।
ভাল লাগল পড়ে।
মামুন
ভালো লাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
শুভসকাল। -{@
সোনিয়া হক
ভালো লেগেছে লেখক। প্রথম অংশ পড়ে ভাবতেই পারিনি, শেষ দিকে এসে লেখাটা এমন টার্ন করাবেন। ধন্যবাদ আপনাকে।
মামুন
আমার ব্লগে স্বাগতম!
অনুভূতি রেখে গেলেন, শুভেচ্ছা রইলো।
অরণ্য
মামুন ভাই, আপনার অণুগল্পটা পড়লাম। ভালো লাগলো। বিশ্লেষণী বক্তব্যটুকু আরো বেশি ভালো লাগলো। আমি অবশ্য “লাইফ ইজ বিউটিফুল” এর সাথে সবসময় এক মাত্রা বাড়িয়ে বলি। আমি বলি “লাইফ ইজ বিউটিফুল ইফ ইউ ক্যান মেক ইট”। (y)
মামুন
ভালো লাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
আর আপনার বলা “লাইফ ইজ বিউটিফুল ইফ ইউ ক্যান মেক ইট” – শতভাগ সহমত।
শুভসকাল। -{@
জিসান শা ইকরাম
ভালো লেখেন আপনি।
খুব বেশী ব্যস্ততার কারনে আসলে বড় মন্তব্য করা হয়না সব সময়।
রানার কবিতাটি আজ শুনলাম অনেক দিন পরে, আপনি মনে করিয়ে দিলেন।
ধন্যবাদ এমন গল্প দেয়ার জন্য।
মামুন
আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম!
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
শুভসকাল। -{@
শুন্য শুন্যালয়
কতো কতো দিন এইভাবে বাড়ি ফিরেছি। এভাবে লেখার চিন্তাও আসেনি। খুব ভালো লাগলো ভাইয়া।
স্টেডিয়াম থেকে সাউন্ডপ্রুভ ঘরে যাবার উপমাটা বেশ লাগলো। (y)
মামুন
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
শুভসকাল। -{@
Quahaf
Apnar Prokashito Boi Dekhte Cai Mamun Bhai…………. :v :v :T
মামুন
ইনশা আল্লাহ কাহাফ ভাই।
সাথে রয়েছেন, অনেক ভালো লাগল। -{@