
এখন আমের মৌসুম। ভ্রমন পিপাসুগন আমের মৌসুমে উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত জেলা রংপুরে এসেছেন আর হাড়িভাঙ্গা আমের স্বাদ নেননি এমন খুব কমই আছেন। তাই সোনেলার পাঠকদের জন্য “বাহের গল্পের ২য় পর্বে” আজ থাকছে রংপুরের বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আমের ইতিকথা।
রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম এখন বেশ জনপ্রিয় ফলের মধ্যে অন্যতম। রঙ্গ রসে ভরপুর-রংপুর এখন ব্রান্ডিং ও পরিচিত পাচ্ছে রংপুরের হাড়িভাঙ্গার মাধ্যমেই। ফলের জগতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সুমিষ্টি,সুস্বাদু,শাঁস-আঁশবিহীন হাড়িভাঙ্গা আম স্থানীয় চাহিদা পুরণ করে দেশ-বিদেশেও বিক্রি হচ্ছে। রংপুরের মিঠাপুকুরে হাড়িভাঙ্গা আমের আদি উৎপত্তি হলেও বর্তমানে রংপুর জেলার তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, পীরগাছা এবং পীরগঞ্জ, কাউনিয়া, বদরগঞ্জের উপজেলার কিছু অংশতে ব্যাপকভাবে হাড়িভাঙ্গা উৎপাদন হচ্ছে। চাষের অনূকুল আবহাওয়া ও মাটির কারণে বসতবাড়ি ও বাণিজ্যিকভাবে রংপুরের পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও গাইবান্ধা জেলার কিছু অংশে এই আমের চাষ হচ্ছে।
যে ব্যক্তি এই হাড়িভাঙ্গা আম চাষ, ফলন ও সম্প্রসারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার নাম আলহাজ আব্দুস সালাম সরকার, পাইকার নফল উদ্দিন ও তার ছেলে তমির উদ্দিন। আব্দুস সালাম সরকার ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে চাকুরী জীবনেও বৃক্ষরোপনে অত্যন্ত আগ্রহী ও নিবেদিত ছিলেন। সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে ১৯৯৩ সালে আব্দুস সালাম সরকার হাড়িভাঙ্গা আমের চারা সংগ্রহে নামে। তিনি মিঠাপুকুর উপজেলার খোরাগাছ ইউনিয়নে তেকানি গ্রামের পাইকার নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে তমির উদ্দিন পাইকারের বাড়িতে যান, যিনি মূলতঃ এই আমটির চারা সংগ্রহ করে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আব্দুস সালাম সরকার জানান, বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নের জমিদার বাড়ির বাগানে উদারমনা ও সৌখিন রাজা তাজ বাহাদুর শিং এর আমলে আমদানিকৃত ও রোপিত বিভিন্ন প্রজাতির সুগন্দিযুক্ত ফুল ও সুস্বাদু ফলের বাগান ছিল। প্রথমে নফল উদ্দিন ও তার সাথে তারই ছেলে তমির উদ্দিন জমিদার ও স্থানীয়দের আম সংগ্রহ করে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করতেন। দেশে ১৯৮৮ সালের বন্যা ও ভাঙ্গনে যমুনেশ্বরীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায় জমিদার বাড়ির আমের বাগান। বিলীন হওয়ার মুহুর্তে তমির উদ্দিন জমিদারের আমের বাগান থেকে একটি আম গাছের চারা এনে নিজ বাড়িতে রোপন করেন। শুকনো মৌসুম ও বরেন্দ্র প্রকৃতির মাটি হওয়ায় আমের কলম চারাটি একটি হাড়িতে তুলে নিজ জমিতে রোপন করে পরিচর্যা করতে থাকেন। কিন্তু কয়েকদিন পরেই কে বা কারা হাড়িটি ভেঙ্গে ফেলে। তবে হাড়িটি ভাঙ্গলেও গাছটির কোন ক্ষতি হয়নি। ক্রমেই বড় হয়ে ৩ বছরের মধ্যেই ফল দেওয়া শুরু করে। স্থানীয় ও প্রতিবেশিরা এই গাছের আম খেয়ে নফল উদ্দিনকে জাত ও গাছের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ভাঙ্গা হাড়ি গাছের আম। নফল উদ্দিনের মূখ থেকে উচ্চারিত হাড়িভাঙ্গা কথার অনুযায়ী পরবর্তীতে “হাড়িভাঙ্গা’’ নামে পরিচিত লাভ করে।
বর্তমানে শুধুমাত্র রংপুর জেলায় ১৬শ ২৩ হেক্টর জমিতে বানিজ্যিকভাবে হাড়িভাঙ্গা আমের চাষ হচ্ছে। আর এ জেলায় হাড়িভাঙ্গা আমের বাগানের সংখ্যা ৪ হাজার ৬শ ৮৫টি এবং বসতবাড়িতে গাছের সংখ্যা ৪লাখ ৭৩ হাজার ৩শটি। প্রতি হেক্টরের গড় ফলন ১১ মে.টন।
হাড়িভাঙ্গা আম গাছের চারা আকর্ষণীয়। গাছটির ডগা অত্যন্ত বলিষ্ঠ। গ্রাফটিং করলে বা ডালে জোড়া কলম লাগলে গাছটি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। চারা রোপনের পরবর্তী বছরেই মুকুল আসে। তবে প্রথম বছর মুকুল ভেঙ্গে দিলে ডগার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। গাছটি উচ্চতার চেয়ে বিস্তৃত বেশি হওয়ায় ঝাড়-বাতাসে ক্ষতি কম হয়।
আকৃতির দিক থেকে পুর্নাঙ্গ আমের উপরিভাগ বেশি মোটা ও চওড়া এবং নিচের অংশ অপেক্ষাকৃত চিকন। দেখতে সুঠাম, মাংসালো এবং আটি পাতলা। ভেতরে কোন আঁশ নেই। ৩ থেকে ৪টি আম গড়ে ১ কেজি হয়ে থাকে। আবার কোন কোন আম ৬ থেকে ৭শ গ্রাম পর্যন্তও হয়। পাঁকলেও আমটির রং খুব বেশি পরিবর্তন হয় না বা পাঁকা দেখা যায় না। মাঘ ও ফাল্গুন মাসে মুকুল আসে এবং আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাঁকতে শুরু করে শ্রাবন মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। হাড়িভাঙ্গা কাঁচা থেকে পাকা পর্যন্ত খেলে বিভিন্ন স্তরের স্বাদ পাওয়া যায়। তবে, পাকা খেলেও স্বাদ বেশি।
চারা রোপন বাদে হেক্টরপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা উৎপাদন খরচ হলেও ৫ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। আমের কেজি রংপুর অঞ্চলে মৌসুমে ৪০ থেকে ৬০ টাকা ধরে বিক্রি হয়ে থাকে। তবে চলতি মৌসুমে শুরুর দিকে কেজির মূল্য ১০-১২ টাকায় নেমে আসলেও বর্তমানে দাম একশ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আম জাতীয় আয় ও স্বাস্থ্য বিনির্মানে অবদানে ভূমিকা রাখছে। আম গাছ একটি পরিবেশবান্ধব গাছ।
হাড়িভাঙ্গা আমই এখন রংপুর জেলাকে দেশ ও বিদেশে ব্রান্ডি জেলাতে তুলে ধরছে। অনেক সম্ভাবনাময় আম চাষ ও আম শিল্পকে আরো আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ গবেষনা ও ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অর্থকারী ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে হাড়িভাঙ্গা আম উজ্জ্বল রাখার দাবী রাখে।
আমার কথাঃ
আঁশবিহীন হাড়িভাঙ্গা আম এত সুস্বাদু যে মুখে গেলে মাখনের মতন অনুভূত হয় এটা সত্যি। দেশে উৎপাদিত অন্যান্য জাতের আমের পাশাপাশি এই আমও আমাদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আমের মৌসুমে রংপুরের মানুষের পাতে হাড়িভাঙ্গা আম থাকবেনা এ যেন কল্পনাতীত। একবার খেয়েই দেখুননা।
তথ্যসূত্র এবং ছবিঃ হাড়িভাঙ্গা আম
৪১টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
বাহ ! দারুন এক তথ্য সমৃদ্ধ লেখা সোনেলায় দিয়ে ব্লগের তথ্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করলেন।
হাড়িভাঙ্গা আমের নামকরন চমকপ্রদ। উনি একটি চাড়া না আনলে এই হাড়িভাঙ্গা আমই আর খাওয়া হতো না আর।
এমন পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
শুভ কামনা।
তৌহিদ
এই আমের ইতিহাস পাঠকদের জানাতে পেরে আমার নিজেরও ভালো লাগছে ভাই। ভাগ্যিস তিনি একটি চারা এনেছিলেন। তা না হলে জমিদারের সাথে সাথে আমও চলে যেত রাজত্ব ছেড়ে।
আপনার জন্যে অনেক অনেক শুভকামনা।
আসিফ ইকবাল
চমৎকার লেখা। হাড়িভাঙ্গা নামের উৎপত্তি নিয়ে কৌতূহল ছিল। আজ মিটলো। তবে এই আম এখনো খাওয়া হয়নি। নিবন্ধ পড়ে খাও্য়ার জন্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হলো।
তৌহিদ
পাঠকের কৌতুহল কিঞ্চিৎ মেটাতে পেরেছি জেনে ভালো লাগছে। হ্যা, খাবেন কিন্তু। আসলেই দারুন।
ধন্যবাদ জানবেন।
আসিফ ইকবাল
আপনাকেও ধন্যবাদ। দেখা যাক, আমের লোভে শেষ পর্যন্ত অংপুরেই হাজির হই কি-না!
তৌহিদ
হ্যা চলে আসুন ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
বছর দুয়েক হল খাওয়া হইনা। সুস্বাধু। আমার বন্ধুরা এনেভাগ করে খায়।
তৌহিদ
আহারে, রংপুর এলে এবার অনেক করে নিয়ে যাবেন সাথে ভাই। তারপর বন্ধুদের সাথে ভাগ করে খাবেন কেমন?
মোঃ মজিবর রহমান
আমার একবন্ধু মেডিকেলের পাশে বাসা, আরেকজন মুন্সিপাড়া অন্যজন বেগম রোকেয়া কোলেজের দিকে। অরাই আনে ভাগ করে খায় তৌহিদ ভাই।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বাহ্!
বেশ ভালো লাগলো।
তৌহিদ
ভালো থাকবেন দাদা।
আরজু মুক্তা
এই আম খেলে কেউ রংপুরের কথা ভুলবেনা।।
আহ্ কি সুস্বাদু!!
তৌহিদ
কথা কিন্তু সত্য আপু। দারুন টেস্টি আম।
আরজু মুক্তা
জি ভাইজান!!
সাবিনা ইয়াসমিন
নতুন নামের একটি আমের সাথে পরিচিত হলাম। এতদিন হীমসাগর আমটি আমার প্রিয় তালিকায় ছিলো। হাঁড়িভাঙা খেয়ে দেখতে হবে। আশা করছি ঢাকায় এই আম পাওয়া যাবে। না পেলেও সমস্যা নেই। আপনার কাছ থেকে নিয়ে নিবো। 🙂
শুভ কামনা তৌহিদ ভাই। ভালো থাকবেন। 🌹🌹
ইঞ্জা
আপু হীমসাগর টক মিষ্টি জাতীয় কিন্তু লেংড়া আম প্রকৃতই মিষ্টি জাতের আম।
তৌহিদ
সবচেয়ে মিষ্টি আম রাণীপছন্দ, এরপরে আম্রপালি।
ইঞ্জা
আহা কতু কতু আম, আমার ইচ্ছে করছে আম বাগানে গিয়েই শুয়ে পড়ি। 😆
তৌহিদ
আহেন দাদা, বিছানা পেতে দেবো আপনাকে। মন ভরে যাবে।
ইঞ্জা
ভাই আম পেলে বিছানার দরকার পড়বেনা, এমনিতেই শুয়ে শুয়ে আম খাবো। 😄
তৌহিদ
হা হা হা, গাছের তলে শুয়েও আরাম!! ☺☺
ইঞ্জা
একদম। 😃
তৌহিদ
হ্যা ঢাকায় হাড়িভাঙ্গা আম পাওয়া যাবে আপু। তিবে আরো পরে। রংপুরেই এখনো নামেনি। আম্রপালি আমার নিজেরো খুব পছন্দ।
শুভকামনা রইলো।
তৌহিদ
তবে।
ইঞ্জা
ভাই দেখি এইবার খুঁজে দেখবো। 😁
নাজমুল হুদা
দারুণ তথ্যবহুল লেখা। আমের সাথে ইতিহাস জড়িত ।
এই লেখাটি আরেকটি ইঙ্গিত দেয়-পরিশ্রম কখনও হারায় না ।
তৌহিদ
সুন্দর বলেছেন ভাই, ধন্যবাদ।
ইঞ্জা
ভাই জিভে জল এলো, এমন আম না খেলেই যেন জীবনটা বৃথা হয়ে যাবে। 😢
তথ্যবহুল লেখাটি বেশ ভালো হয়েছে ভাই।
তৌহিদ
হ্যা দাদা, এই আমের বেশ নামডাক হচ্ছে ইদানিং চারপাশে। ঢাকায় পাওয়া যায়তো এই আম।
ভালো থাকবেন দাদা।
ইঞ্জা
কি বলেন, ঢাকাতে পাওয়া যায়, কখনো শুনিনি বা দেখিওনি।
তৌহিদ
হ্যা দাদা, পাওয়া যায়। সময়টা আরও মাসখানেক পরে।
মনির হোসেন মমি
আমার প্রিয় এই আম।বাজারে এলে আমি যথাসাধ্য ক্রয় করে থাকি।এতোদিন কেবল ভক্ষণ করেছি এবার এর বিস্তারিতও জানলাম।ধন্যবাদ।
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাইজান।
রেহানা বীথি
গাছটি লাগানোর পর নাম শুনে হতাশ হই, কারণ আগে কখনও এই আম সম্পর্কে শুনিনি। কিছুটা ভয়ে ভয়েই ছিলাম, না জানি কেমন আম! কিন্তু আপনার লেখা পড়ে সেই ভয় দূর হলো।
চমৎকার তথ্যবহুল লেখাটি ভালো লাগলো খুব।
তৌহিদ
আপু, আমটি আসলেও ভালো। ধন্যবাদ জানবেন।
শাহরিন
আমি আম্রপালি ও হাড়িভাংগা আম গাছ ছাদে লাগিয়েছিলাম, একবার আম ও হয়েছিল। খেতে খুবই সুস্বাদু কিন্তু গাছ গুলো রাখতে পারিনি। এখন গাছ গুলো ইতিহাস😓।
ধন্যবাদ পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য আর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।
তৌহিদ
আহা! গাছগুলি কি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আপু? যদি সম্ভব হয় তাহলে আবার আমগাছ লাগাবেন। পরিবেশের জন্যেও ভালো।
শুভকামনা জানবেন।
শাহরিন
আমাদের যৌথ পরিবার। অনেক জটিলতার জন্য গাছ গুলো নিজের কাছে রাখতে পারিনি। একজনকে উপহার দিয়ে দিয়েছিলাম ১২০ টি গাছ।😥
ইনশাআল্লাহ স্বপ্ন আছে যদি কখনো পূরন হয়!!! দোয়া করবেন।
তৌহিদ
নিজের পছন্দের লালন করা জিনিস অন্যকে দিতে কতটা বড় মনের প্রয়োজন তা আপনার কথায় কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি।
ভালো থাকবেন আপু।
শামীম চৌধুরী
হাড়িভাঙ্গা আম সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম। যেহেতু সোনেলায় হাড়িভাঙ্গার হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন এখন আমাদের হাড়িভাঙ্গা আম খাওয়াবেন।
তৌহিদ
ইনশাআল্লাহ ভাই।