ভর দুপুরের সুনসান নিরব সময়টাতে আচমকা কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই মধ্যবয়সী এক নারী সাথে তাঁর টিনএজ পুত্র, কিছু লাগেজ। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। পাশের রুমের আঙ্কেলের স্ত্রী পুত্র তাঁরা। আমরা বাড়ির অন্য সদস্যরা বিস্মিত ! বলা নেই, কওয়া নেই। হুট করে এসে হাজির ! আঙ্কেলকে কর্মস্থলে ফোনে জানানো হল। তিনি এলেন এক আকাশ কালো মেঘ করে।দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকা প্রতিদিনের হাসি-খুশি, উচ্ছল মানুষটি ভাবলেশহীন, বিষণ্ণ। স্ত্রী পুত্রের আগমনে অসীম আনন্দে এক আকাশ ঝকঝকে রোদ করে আসবার কথা ছিল যদিও…
বেশ অনেকদিন যাবত পরিবারকে এদেশে আনবার চেষ্টা করছিলেন তিনি। নানান কাগজ পত্র পাঠানো, প্রতিনিয়ত ফোন করা, টাকা পাঠানো__ কিছুই কমতি ছিল না। রাতভর সিকিউরিটি জব শেষে ভোরে বাড়ি ফিরে ঘুমাতে গেলেই দেশ থেকে স্ত্রী ফোন করতেন। ঘুমের মাঝে রিসিভার তুলে কথা বলতেন ক্লান্ত, জড়ানো কণ্ঠে। এতে স্ত্রীর সন্দেহ বেড়ে যেত। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে চেঁচাতেন__ রাতে কোথায় ছিল… ড্রিংক করেছে… কিনা… কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ত্রী’কে কাছে এনে সুখে থাকতে চেয়েছিলেন। সেই মোতাবেক কাগজ পত্র পাঠান। যাক্, শেষে ভিসা হল যদিও, কিন্তু তা গোপন রাখা হল আঙ্কেলকে। সন্দেহপ্রবন স্ত্রী আচ্মকা এসে হাজির হয়ে দেখতে চাইলেন আঙ্কেল এখানে অন্য স্ত্রী নিয়ে বসবাস করছেন কিনা !
সেই রাতে দুঃখ, কষ্ট আর ক্ষোভে আঙ্কেল বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসে থাকলেন।পরিবারের মানুষগুলোকে ভাল রাখবার জন্যে দিনে রাতে মিলিয়ে দু’টো জব করা, হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম করা মানুষটি কয়দিন অতি শোকে পাথর হয়ে থাকলেন। পরের মাসের শুরুতে অন্য একটি ভাড়া বাড়িতে উঠলেন তাঁরা।
চলার পথে কালে ভদ্রে আমাদের দেখা হয় যদিও, তাড়াহুড়ায় কথা হয় না। আজ তেমন তাড়া না থাকায় একটু দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ হয়।লম্বা, হ্যান্ডসাম, কর্মঠ মানুষটি এতদিনে অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে। সাদা চুল, দাঁড়ি, পাঞ্জাবী পড়া অন্য এক মানুষ। আত্মীয় পরিজনহীন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে প্রথম পরিচয়ে যে মানুষটি আমায় বলেছিলেন, “আমি তোমার বাবার মত… দেশে তোমার বয়সী আমার দু’টি কন্যা আছে”। কিছু রান্না করলেই যে মানুষটি আমায় ডেকে বলতেন, “বুড়ি, টেস্ট করে দেখো কেমন মজা হয়েছে”।
আজ এতগুলো বছর বাদেও সেই স্নেহমাখা ডাক__ বুড়ি, কেমন আছ?
আমার ভীষণ ভাল লাগে।অনুভুতিরা আকাশ ছুঁয়ে যায়। কেননা, আমায় পিতৃস্নেহে বুড়ি ডাকবার তো আর কেউ নেই পৃথিবীতে।
বলি__ আমি ভাল। আপনি কেমন আঙ্কেল ?
বললেন, “ভালো আছি রে, বুড়ি”।
ছোট্ট একটি শ্বাস নিয়ে দূরে থার্টি সেভেন এভিনিউর দিকে তাকালেন। অতঃপর আকাশের দিকে। আজ দু’দিন যাবত এই শহরে রয়ে সয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। এখানকার আকাশ মেঘলা, অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভীষণ অন্ধকার…
## পৃথিবীতে আমরা মানুষেরা চাইলেই ভাল থাকতে পারি। তবুও অযথাই ছোট্ট এই জীবনটাকে জটিল করে তুলি।বারংবার মরি। বারংবার বেঁচে উঠি।
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ইং
১৮টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
মনটা আদ্র হয়ে ওঠে এসব ভাবলে
প্রবাসে একজন প্রবাসী কত কষ্ট করেন, তা নিজে দেখেছি বিভিন্ন দেশ ঘুরে
আর সে কষ্টের সামান্যই মূল্য দেন দেশে থাকা প্রবাসীর আত্মীয় স্বজন।
আমার দেখা প্রবাসীদের পরিশ্রমের পাঠানো টাকা অধিকাংশই অপব্যবহার করেন তাদের স্বজনরা।
বৃষ্টির সাথে মনের কান্নাকে এনেছেন…… উপমাটি ভাল লাগলো।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
অনেক অনেক ভাল থাকুন, শুভকামনা।
অরুনি মায়া
পৃথিবী টাই এমন হয়ে গেছে আপু | একদিকে সন্দেহ মানুষকে শেষ করে দেয়, অন্যদিকে অন্ধবিশ্বাস মানুষকে প্রতারিত করে | মানুষ করবে তো কি করবে!
রিমি রুম্মান
দুই রকম উদাহরণই আছে আমাদের সমাজে।
অথচ চাইলেই জীবনটা সুন্দর হয়ে উঠতে পারে, তাই না ?
শুভকামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
সন্দেহর মতো আর কিছু নেই। তবে ওই যে “বুড়ী” ডাকটা পাওয়া অনেক ভাগ্য রিমি আপু। -{@
রিমি রুম্মান
এমন করে ক’জনে পারে পিত্রিস্নেহে “বুড়ি” ডাকতে ?
আমার বাবাহীন এই প্রবাসে সে ডাক অমূল্য এক রতন।
ভাল থাকো দিদি।
ব্লগার সজীব
আমরা চাইলেই ভাল থাকতে পারি। জীবনকে জটিল করে ফেলি আমরাই। ভাল লিখেছেন আপু।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা জানবেন। -{@
পারভীন সুলতানা
রিম্মি , বলতে পারেন আমরা এমন কেন ? কেন জটিল হয়ে যাই ? এত যে আবেগ, এত যে ভালবাসা কে চুরি করে নিয়ে যায় ? আমরা হয়ে যাই নিঃস্ব , কর্কশ । কিন্তু কেন ? কেন
রিমি রুম্মান
জীবন এমনভাবেই এগিয়ে যায়, আপু। শুধু দরকার আমাদের সচেতনতা।
ভাল থাকবেন অনেক অনেক।
শুভকামনা।
শুন্য শুন্যালয়
আপু আঙ্কেলের ওয়াইফ ও অনেক মানসিক যন্ত্রণাতেই ছিলেন বলেই মনে হয়। মানুষ দূর থেকে দেখে, শুনে কতটাই বা বুঝবে। তবু বলি আমরা জীবনটাকে এত জটিল না করি। অন্ধভাবে বিশ্বাসেই কিন্তু শান্তি বেশি।
বুড়ি ডাকটা ছুঁয়ে গেলো। আংকেল ভাল থাকুক।
রিমি রুম্মান
খুব কাছ থেকে অনেকগুলো দিন, মাস, বছর আঙ্কেলকে দেখা আমার। পরিবারের প্রতি যত্নশীল, দায়িত্বশীল কর্মঠ একজন মানুষ। এটুকুই আমার দেখা।বাকিটুকু অদেখা। ভাল থাকুক সকলে দূর পরবাসে।
অনিকেত নন্দিনী
দুনিয়াটাই ভারি অদ্ভুত। যারা বিদেশ বিভুঁইয়ে পরিশ্রম করে জান কাবাড় করেন তারা থাকেন একরকম মনোকষ্টে আবার যারা স্বামীকে ছেড়ে দেশে একা সংসার সামাল দেন তারা থাকেন আরেকরকম মনোকষ্টে। কেউ কারোটা বুঝতে চায়না। যারা বোঝে, তারা সুখী হয়। 🙂
বুড়ি ডাকটা শুনলেই তো মন ভালো হয়ে যায়। 🙂
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। যারা বোঝে, তারা সুখী হয়।
সুখে থাকুন, ভাল থাকুন।
অনেক শুভকামনা।
অনিকেত নন্দিনী
আপনিও দূর প্রবাসে অনেক অনেক ভালো থাকুন আপু। -{@
ইলিয়াস মাসুদ
এই সব অসুস্থ মানুষ গুলো খুনির চেয়েও ভয়ংকর,এক জন পুরুষ একসাথে স্বামি,বাবা,ভাই,সন্তান সব, এই সম্পর্ক গুলোর ভার কি এত সহজ ? যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে জীবন যে কি কঠিন ?
স্বপ্ন
জীবনকে জটিল না করে সহজ করে ফেলা উচিৎ। ভালো লিখেছেন আপু।
মিথুন
এভাবে সন্দেহপরায়নতা সম্পর্ক কে আরো দুর্বিসহ করে তোলে। সবার উচিৎ কিভাবে জটিলতা কমিয়ে জীবন কে সহজ সাধারন রাখা যায়। আপনার আংকেলের জন্য খারাপ লাগছে। যেভাবে আপনাকে স্নেহ ভরে ডাকেন, তার তেমন স্নেহই পাওনা। ভালো থাকুন তিনি আর তার পরিবার। ছুঁয়ে যাওয়া লেখা………