বারংবার মরে বেঁচে উঠা জীবন

রিমি রুম্মান ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, শুক্রবার, ১১:৪৫:৩০পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৮ মন্তব্য

ভর দুপুরের সুনসান নিরব সময়টাতে আচমকা কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই মধ্যবয়সী এক নারী সাথে তাঁর টিনএজ পুত্র, কিছু লাগেজ। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। পাশের রুমের আঙ্কেলের স্ত্রী পুত্র তাঁরা। আমরা বাড়ির অন্য সদস্যরা বিস্মিত ! বলা নেই, কওয়া নেই। হুট করে এসে হাজির ! আঙ্কেলকে কর্মস্থলে ফোনে জানানো হল। তিনি এলেন এক আকাশ কালো মেঘ করে।দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থাকা প্রতিদিনের হাসি-খুশি, উচ্ছল মানুষটি ভাবলেশহীন, বিষণ্ণ। স্ত্রী পুত্রের আগমনে অসীম আনন্দে এক আকাশ ঝকঝকে রোদ করে আসবার কথা ছিল যদিও…  

বেশ অনেকদিন যাবত পরিবারকে এদেশে আনবার চেষ্টা করছিলেন তিনি। নানান কাগজ পত্র পাঠানো, প্রতিনিয়ত ফোন করা, টাকা পাঠানো__ কিছুই কমতি ছিল না। রাতভর সিকিউরিটি জব শেষে ভোরে বাড়ি ফিরে ঘুমাতে গেলেই দেশ থেকে স্ত্রী ফোন করতেন। ঘুমের মাঝে রিসিভার তুলে কথা বলতেন ক্লান্ত, জড়ানো কণ্ঠে। এতে স্ত্রীর সন্দেহ বেড়ে যেত। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে চেঁচাতেন__ রাতে কোথায় ছিল… ড্রিংক করেছে… কিনা… কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ত্রী’কে কাছে এনে সুখে থাকতে চেয়েছিলেন। সেই মোতাবেক কাগজ পত্র পাঠান। যাক্‌, শেষে ভিসা হল যদিও, কিন্তু তা গোপন রাখা হল আঙ্কেলকে। সন্দেহপ্রবন স্ত্রী আচ্‌মকা এসে হাজির হয়ে দেখতে চাইলেন আঙ্কেল এখানে অন্য স্ত্রী নিয়ে বসবাস করছেন কিনা !

সেই রাতে দুঃখ, কষ্ট আর ক্ষোভে আঙ্কেল বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসে থাকলেন।পরিবারের মানুষগুলোকে ভাল রাখবার জন্যে দিনে রাতে মিলিয়ে দু’টো জব করা, হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম করা মানুষটি কয়দিন অতি শোকে পাথর হয়ে থাকলেন। পরের মাসের শুরুতে অন্য একটি ভাড়া বাড়িতে উঠলেন তাঁরা।

চলার পথে কালে ভদ্রে আমাদের দেখা হয় যদিও, তাড়াহুড়ায় কথা হয় না। আজ তেমন তাড়া না থাকায় একটু দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ হয়।লম্বা, হ্যান্ডসাম, কর্মঠ মানুষটি এতদিনে অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে। সাদা চুল, দাঁড়ি, পাঞ্জাবী পড়া অন্য এক মানুষ। আত্মীয় পরিজনহীন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে প্রথম পরিচয়ে যে মানুষটি আমায় বলেছিলেন, “আমি তোমার বাবার মত… দেশে তোমার বয়সী আমার দু’টি কন্যা আছে”। কিছু রান্না করলেই যে মানুষটি আমায় ডেকে বলতেন, “বুড়ি, টেস্ট করে দেখো কেমন মজা হয়েছে”।

আজ এতগুলো বছর বাদেও সেই স্নেহমাখা ডাক__ বুড়ি, কেমন আছ?

আমার ভীষণ ভাল লাগে।অনুভুতিরা আকাশ ছুঁয়ে যায়। কেননা, আমায় পিতৃস্নেহে বুড়ি ডাকবার তো আর কেউ নেই পৃথিবীতে।

বলি__ আমি ভাল। আপনি কেমন আঙ্কেল ?

বললেন, “ভালো আছি রে, বুড়ি”।

ছোট্ট একটি শ্বাস নিয়ে দূরে থার্টি সেভেন এভিনিউর দিকে তাকালেন। অতঃপর আকাশের দিকে। আজ দু’দিন যাবত এই শহরে রয়ে সয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। এখানকার আকাশ মেঘলা, অন্ধকারাচ্ছন্ন। ভীষণ অন্ধকার…

## পৃথিবীতে আমরা মানুষেরা চাইলেই ভাল থাকতে পারি। তবুও অযথাই ছোট্ট এই জীবনটাকে জটিল করে তুলি।বারংবার মরি। বারংবার বেঁচে উঠি।

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ইং

 

৫৭৯জন ৫৭৯জন
0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ