
আলো ঝলমলে বিয়ে বাড়ি। জামান সাহেবের একমাত্র মেয়ে শ্রেয়ার আজ বিয়ে। দেখতে দেখতেই কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। এই তো সেদিন ছোট্ট মেয়েটি ছিল সে। বাবার কাঁধে উঠে কান ধরে ঘুরে বেড়াত।
সবাই যার যার বয়সী থোকায় থোকায় আনন্দ করছে। মধ্যবয়সীরাও অনেকদিন পর পুরোনো বন্ধুদের পেয়ে গল্পে মেতে উঠেছেন।
শ্রেয়ার বাবা জামান সাহেব অস্হির হয়ে পায়চারী করছেন। বারবারই ফোনে খোঁজ নিচ্ছেন কোথায় , কতদুরে। তার ছোটবেলার বন্ধু ইন্জিনিয়ার ওয়াহেদ এখনও এসে পৌঁছায়নি।
– এই কে, কোথায় আছিস এদিকে আয়। আমার বন্ধু এতবছর পর আমার বাসায় এসেছে।
এরকম ডাকহাকে বিয়ে বাড়ির পরিবেশ এক ঝটকায় বদলে গেল। চেয়ার,পানীয়,পাখা এসব নিয়ে দৌঁড় ঝাপ শুরু হয়ে গেল। সাদা পাঞ্জাবি পাজামা, মুখে কাঁচা পাকা দাঁড়ি একজন পবিত্র মানুষের আগমনে সবাই তাকেই দেখতে এবং আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দীর্ঘ সময় তিনি বিদেশে ছিলেন। গতবছর হজ্জ্ব পালনের পর দেশেই থেকে গেছেন। ঈদানিং কোথাও তেমন যাননা। বাড়িতেই নামাজ কালাম করেন। জামান খুব কাছের বন্ধু, না এলে মন খারাপ করবে বলেই আসা। শ্রেয়াও মেয়ের মতো।অনেকদিন দেখাও হয়নি তাই আসা।
শ্রেয়া কেন যেন একটু অন্যরকম হয়ে গেল। নিমিষেই ওর কনে লাবন্যে ফ্যাকাশে ভাব চলে এল। হাত পা কেমন কাঁপছে, শীতবোধ হচ্ছিলো । পাশের মেয়েদের হাসি ঠাট্টা, কোন কথাই যেন তার কানে ঢুকছে না।
কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই যথাসময়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল। পরিচিতি পর্বে মোটামুটি কাছের আত্মীয়- স্বজন বন্ধু-বান্ধব দাড়িয়েছেন। জামান সাহেব বর কনেকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন । বর কনে পা ছুঁয়ে সালাম করে দোয়া নিচ্ছে। ইন্জিনিয়ার ওয়াহেদ সাহেবের কাছে এসে শ্রেয়ার হাত,পা,চেয়াল সব শক্ত হয়ে গেল। সালাম না করে সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জামান সাহেব বলছেন,- মা আঙ্কেলকে সালাম করে দোয়া নাও। ছোটবেলায় দেখেছে তো তাই চিনতে পারছে না হয়ত।
অনেকটা জোর করে তাকে সালাম করতে নিচু করাল। ইন্জিনিয়ার মাথায় হাত দিয়ে দোয়ার বদলে বুকে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তার কান্নায় উপস্থিত সবার চোখ ছলছল করে উঠল। আহ্! কি ভালোবাসা। বন্ধুর মেয়ে নয় যেন নিজের মেয়ে বিদায়।
সবার চোখে পানি তাই কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছেনা শুধু শ্রেয়ার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। দুহাত পিঠের নরম অংশে এমনভাবে চাপড়ে ধরেছেন যে, শ্রেয়ার বক্ষযুগল তার শরীরের সাথে মিশে গেছে। কান্নার সাথে মেশা গরম নিঃশ্বাস তার গায়ে পড়ছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। ইন্জিনিয়ার তার দুই বগলের পাশ দিয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে।
শ্রেয়ার চোখ লাল হয়ে বহুবছর আগের ঘৃনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুই গালে কষে চড় লাগাল।গায়ের পান্জাবী একটানে ছিঁড়ে ফেলল। দাঁড়ি ধরে এক টানে মাটিতে ফেলে দিল। এবং অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
উপস্থিত সবাই হতবাক। হলটা কি? জ্বীনে ভর করেনিতো? একটা মানুষ সব বুঝতে পারল। সে শ্রেয়ার সদ্যবিবাহিত স্বামী শুভ।কারন সে তার এ ঘটনাটি শুনেছে।
জামান সাহেব আর ইন্জিনিয়ার ছোটবেলার বন্ধু একদম গলায় গলায়। যে কোন প্রোগ্রাম তো আছেই, পারিবারিক সকল বিষয়েও তিনি উপস্থিত থাকেন এবং সমাধান টানেন খুব সুন্দর করে। সেবার শ্রেয়ার বাবা মা খুটখাট খুনসুটি ঝগড়া করে, দুদিন খাওয়া দাওয়া এমনকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে বসে আছেন। ইন্জিনিয়ার এ সংবাদ পেয়ে রান্না বান্না করে নিয়ে ছুটে এলেন। দুজনকে মিটমাট করিয়ে, হাতে তুলে খাইয়ে তারপর ক্ষ্যান্ত হলেন।
এসবে বেশ রাত হয়ে গেল। শ্রেয়া মাত্র সাত বছরের বাচ্চা মেয়ে। আর কতক্ষনই বা জাগবে। তাই সে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ল। হঠাৎ নিচে তীব্র ব্যাথায় ঘুম ভেংগে গেল। প্যান্টের ভেতর কে যেন হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। চোখ মেলে ঝাপসা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেল জ্বলজ্বলে কামুক একজোড়া চোখ। লম্বা লম্বা কুমিরের ধারালো দাঁত ,জীব বের করে তার গাল চাটছে। আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। লোকটা কেউ না যাকে সে এতদিন বাবার মতো জানত , তার বাবার বন্ধু জামান সাহেব।
ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে সে উঠে বসল। দাঁতাল শুয়োরটা মুহূর্তে অন্ধকারে কোথায় যেন মিশে গেল। কিছুক্ষন পর সে পাশের ঘর থেকে হি হি হা হা হাসির শব্দ শুনতে পেল। অশ্লীল বাক্যব্যয়ে ইন্জিনিয়ার তার বাবা-মায়ের সাথে হাসছে।বোকা বাবাটাও হেসেই চলছে।
বিঃ দ্রঃ- বাবার বন্ধু বাবার মতো, স্থুল-কলেজ, মাদ্রাসা শিক্ষক বাবার মতো, অন্যান্য গুরুজনও বাবার মতো।মতো যেখানে, সেখানে কিন্তু বাবা না! সুতরাং যে কোন সম্পর্কে নিশ্চিত ভাব ছেড়ে, নেগেটিভ শব্দটাও সাথে রাখুন। একেবারে ছেড়ে না দিয়ে চোখ কান খোলা রাখুন! কারন আপনার স্ত্রী- সন্তানের যে কোন দুর্ঘটনার দায়ভার আপনার একার!!!!!
২৯টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাবার মতো, বাবা নয় এ এক অমোঘ কঠিন, তিক্ত বাণী। এ বাণীর সত্যতা যার সাথে ঘটেছে সেই জানে এর নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা। ধন্যবাদ আপু। শুভ কামনা রইলো
রোকসানা খন্দকার রুকু
বাবা এবং তার বয়সী লোকরা ভীষন ভয়ংকর হয়। সবার কম বেশি এ তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়ে থাকি কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনা।
ধন্যবাদ দিদিভাই প্রথম মন্তব্যের জন্য।
শুভ কামনা নিরন্তর।
সুপায়ন বড়ুয়া
একমত আপু।
“বাবার বন্ধু বাবার মতো, স্থুল-কলেজের শিক্ষক বাবার মতো, অন্যান্য গুরুজনও বাবার মতো।মতো যেখানে সেখানে কিন্তু বাবা না! সুতরাং যে কোন সম্পর্কে নিশ্চিত ভাব ছেড়ে নেগেটিভ শব্দটাও সাথে রাখুন। একেবারে ছেড়ে না দিয়ে চোখ কান খোলা রাখুন! কারন আপনার স্ত্রী কন্যার যে কোন দুর্ঘটনার দায়ভার আপনার একার!!!!!”
এই মতোরাই সমস্ত নষ্টের মুল। সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনাদের মন্তব্য আমার অনুপ্রেরনা দাদা।
শুভ কামনা। ভালো থাকবেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমি একজন শিক্ষক। পুরুষ শিক্ষকরা কিভাবে ছাত্রীদের হয়রানি করে বুঝতে পারি। মহিলা হিসেবে প্রতিবাদ করতে গেল উল্টা বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই অধিকাংশ ঘটনায়ই ধামাচাপা দেয়া হয়।
সুপায়ন বড়ুয়া
ঠিক তাই আপু।
সমাজে ধরেছে পচন
যা করেছে বপন।
শুভ কামনা।
ফয়জুল মহী
ছবিটা সুন্দর লেখাটাও
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া।
ছবিটা দুজন সুন্দর মানুষের। সোনম কাপুর ও তাঁর বাবা ।আমার ভীষন পছন্দের।
শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
কুরুচিসম্পর্ণ মনমানষিকতার লোকের কো বয়স নেই,নেই কোন সম্পর্কের বন্ধন।আজকাল যা শুনছি দেখছি তাতে আপণ বাবা ভাই ব্রাদারদেরও উপর বিশ্বাস রাখতেও কষ্ট হচ্ছে তাই সাবধানের কোন মাইর নাই। খুব ভাল লাগল
রোকসানা খন্দকার রুকু
অনেক সময় ভাইয়ের ও বিশ্বাস নেই॥ এটা একদমই সত্যি কথা।
মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
শুভ কামনা।
রেজওয়ানা কবির
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছো।একটা মেয়ে শিশু ছোটবেলায় আত্নীয় পরিচিত, আপনজন দ্বারা এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়।তখন বাবা মাকেও বললে তা বিশ্বাস করে না, তাই সন্তানকে মূল্যায়ন করুন আর এসব থেকে উদ্ধার করুন।বাবা বাবাই।মত কখনোই বাবা হয় না।শুভকামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সন্তানকে মূল্যায়ন করুন- এটা সুন্দর বললে।
শুভ কামনা রইলো আপুনি।
ভালো থেক।
মোঃ মজিবর রহমান
সুন্দর একটি সামাজিক ব্যাধি লেখায় তুলে এনেছেন। বাবার মত কিন্তু বাবা নয়। অতিব সত্য কথন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ঘুনে ধরা সমাজের যে দিকে তাকাই শুধুই সমস্যা॥
মুক্তি যে কবে মিলবে।
মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
বাস্তব বলেছেন বাবার মতন। কিন্তু বাবা নয়। দারুন কিছু সামাজিক অবক্ষয় ফুঁটিয়ে তুলেছেন লেখায়।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অসাধারণ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।
শুভ কামনা। ভালো থাকবেন।
আরজু মুক্তা
সব বাবা, বাবা নয়!
এভাবে মেয়েদেরকে সচেতন করা জরুরি।
ধন্যবাদ আপি
রোকসানা খন্দকার রুকু
কি কি ভাবে পুরুষরা মেয়েদের হ্যারেজ করে। এসব আসলে মা হিসেবে আমাদের ই দায়িত্ব। নেগেটিভ টাচ্ যেটাকে বলে আরকি?
শুভ কামনা রইলো আপুনি।
ভালো থাকবেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
মোটামুটিভাবে বুঝতে শেখার পরেই তাদের সাথে এ কাউন্সিলিং করে নেয়া খুব জরুরি।
আরজু মুক্তা
একদম। সব বলা উচিত
হালিম নজরুল
আমার কাছে এটি অসাধারণ একটি ছোটগল্প মনে হল।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ছোট গল্প হবে! বুঝলাম॥
ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ কামনা।
আলমগীর সরকার লিটন
মোটামোটি ভাল লাগল রুকু আপু
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা তাও তো মোটামুটি লেগেছে।
শুভ কামনা লিটন ভাই॥
খাদিজাতুল কুবরা
ধন্যবাদ রুকু আপু সচেতনতামূলক গল্প লেখার জন্য।
কথায় বলে না! মাঁইয়া মাইনষের খালু নাই।
এখন তো এমন অবস্থা বাবার মতো কী কারো কারো বাবা ও নিরাপদ জীব নয়।
আল্লাহ সহায় হোন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
একদম ঠিক কথা বলেছেন।
শুভ কামনা আপু।
তৌহিদ
আজকাল আর কাউকে বিশ্বাস নেই। সন্তান লালনপালনে সচেতন হতে হবে বাবা মায়েদের সকলকে। হায়েনারা মুখে সন্তান ডাকে আর কাজ করে নরপশুদের মত। সন্তানকে কারো কোলে দেয়ার আগে অবশ্যই ভাবতে হবে আমাদের।
বাবা শব্দটিকে কলুষিত করেছে এইসব কুলাঙ্গাররাই। দারুন শিক্ষণীয় গল্প আমাদের জন্য। গল্পে আপনার লেখার হাত অসাধারণ।
শুভকামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পাই। কলম ছাড়া আর কিছুই করার নেই ভাইয়া আমাদের।
ভালো থাকবেন। শুভ কামনা।
সুরাইয়া পারভীন
শিরোনামেই মনে হয়েছে গল্পটা এমনই হবে। পুরোটা এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে নিজের বাবার কাছেই মেয়েরা সুরিক্ষিত নয় সেখানে বাবার মতো কাউকে বিশ্বাস করা নেহাত ই মুর্খতা। চমৎকার এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ সচেতন মূলক গল্প লিখার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে আপু