
ঈদ করেছি বহুকাল আগে বাবার হাত ধরে। তারপর তাকে ছাড়া ১৫টি ঈদ; অন্যদিনের মতোই। তোমরা বাবারা কেন বুঝতে চাও না বিশেষ দিনগুলোতে মেয়েরা সবচেয়ে বাবাকেই মিস করে, ফিল করে। ভীষন ইচ্ছে করে তোমাদের সাথে স্পেশাল মোমেন্ট কাটাতে। অন্যের বাড়িতে বউ, অমুকের মা হয়ে থাকতে ভালো লাগে না।
ঈদ আসার আগে আগে আমি অজুহাত খুঁজতে থাকি। কিভাবে অসুখ বাধিয়ে ফেলা যায়। তারপর কি আনন্দ; উপভোগ্য একাকিত্বতা। আর আবদারের মানুষটা বুঝতে পেরেছে এ জিনিস কন্ট্রোলের বাইরে তাই সে আমাকে সাহায্য করতে তার বাবা- মায়ের সাথে ঈদ আনন্দ উপভোগ করে।
অন্য কারণেও ঈদ আমার ভালোলাগে না। মহা সমারোহে গরু-ছাগল কিনে এনে জবাই করে গরীবদের হাড়, গোর, ফ্যাপডা দিয়ে বাকি সব ফ্রিজিং করে রাখার নাম মুসলমানের কুরবানী। আর এতেই দীর্ঘ প্রত্যাশা বেহেস্ত লাভের। আমার বাপু এমনিতেও বেহেস্ত লাভের সম্ভাবনা নেই, তাই ঘুমিয়ে নেয়াই ভালো।
-বাবা নীল কেন?
-নীল হলো সেরা রং! এটাই নাও তোমাকে মানাবে।
শিক্ষক বাবার সাইকেলে চেপে পাশের হাঁটে যেতাম ঈদের জামা কিনতে। নীল তার পছন্দ তাই কিনে দিতেন। অভাব ছিলো না তবু মাঝারি দামের জামাকাপডই তার পছন্দ ছিলো। শিখিয়েছেন মিতব্যয়ি হতে।
ঈদের রাতে ঘুমই আসতো না পাছে কেউ নতুন জামা দেখে ফেলে। সকালে সে কি উত্তেজনা সেটি পরে মাঠে যাবার? বাবা কখন যাবে? বাবা আগের বছরের পান্জাবী পরে আমাকে নিয়ে যেতেন ঈদগাহ মাঠে। কারন জৌলুস দেখানোর জিনিস নয়। কতো মানুষ ঈদে নতুন জামা পায় না, তাদের তিনি কষ্ট দিতে চান না। এমনি আমার অসাধারণ বাবা। আর আমি তার কুডিয়ে পাওয়া মেয়ে!!
আমি সবেমাত্র অনার্সে পড়ি। এমনই এক কুরবানী ঈদের আগে বাবা অসুস্থ হলেন।লিভার সিরোসিসে একদমই খারাপ অবস্থা। হাসপাতালে তার সাথে আমি,অতোসতো বুঝি না। বাবা ঈদের আগের দিন বললেন, তিনি বাঁচবেন না। তাকে যেন বাড়িতে নিয়ে আসি। আমি হেসেছিলাম, তা হয় নাকি? এখনও তোমার সাথে আমার কাটানোর কতকিছু বাকি। সে সব না করে যাও কই?
চারিদিকে ঈদের পটকা, আতশবাজি। আমি ছুটছি ডাক্তারের কাছে, বাবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পালস্ কমে গেছে। রাত ১২.৪৫ এ বাবা চুপ হয়ে গেলেন। আমার বুকফাটা চিৎকারে হাসপাতাল ভারী হলো, কে শুনবে? সবাই ঈদের আনন্দে অস্থির।
ঈদের দিন বিকেল পাঁচটায় তার মাটি হলো। ভয়ংকর মৃত্যু কেড়ে নিলো আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে যা আমি অনেক পরে বুঝেছি। মেয়েদের জীবনে বাবা অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্ট যা আমি হাডে হাডে টের পেয়েছি।সবাই সবার মতো স্যাটেল। আমি আর মা অনিচ্ছায় পরে রইলাম।
মা তার ছেলেদের ভীষন ভালোবাসেন কিন্তু আমাকে ব্যবহার করেন এটা বুঝলাম, আমি যখন কুড়িগ্রাম চলে এলাম। বিবাহিত মেয়ে বাসায় থাকবে এটা অসহনীয়, অসম্মানের নানা আচরনে তিনি বুঝিয়ে দিলেন। বাবা হারিয়ে আমি মায়ের এমন আচরনেও তাকে ছাড়লাম না। শুধু আশ্রয় চেন্জ করলাম। ওটা ভাইদের বাসা, আমার মায়ের ছেলেদের বাসা। আমার অধিকার নেই, কারন আমার বাবা নেই।
মামার বাসায় উঠে গেলাম। আমি অবাধ্য, ঘাড় তেরা, অগোছালো বাজে একটা মানুষ। বিছানায় ঘুমাই একদিকে উঠি অন্যদিকে। যাদের কাছের আমার আশ্রয় হবার কথা তারা ’ সাত ঘা ছুলে পাপ- এমন ভাব করে দুরে থাকলেই বাচেঁন।
মামা-মামীমা এই দুটো মানুষ আমার সকল আবদার, অনিয়ম, অনাচার সহ্য করে অভাব পুরন করছেন আজ ৭ বছর ধরে। এই দুজন মানুষের কাছেও আমার অনেক ঋন। বোনটা অষ্ট্রেলিয়ায় থাকে তারা হয়তো আমাকে দিয়েই সন্তানের অভাব পূরণ করতে চান। কিংবা অনেক বেশি ভালোও বাসেন।
বাবা মারা যাবার পর থেকেই আমার ঈদ করা হয় না। মাকে ঈদে ছেলের সাথে দিই। আমি মধ্যদুপুরে ঘুম থেকে উঠি। মামীমা নিয়ম করে প্রতি ঈদে আমাকে ডেকে তোলেন, ট্রে ভর্তি খাবার পাঠান। আমি অবাক হই উঠবো না বলে ফোন অফ কিংবা সাইলেন্ট করে রাখি। তারপরও এ মানুষটা বিরক্ত হন না কেন? যতক্ষন উঠে খাবার না খাই, কাজের মেয়ে নিচে পাঠাতেই থাকেন। খুব অনিচ্ছায় উপরে গিয়ে খাই, না হলে মামীমা বসেই থাকেন। এটাই আমার কাছে ঈদ
শশুরবাডীতে কুরবানী দেয়, আমার নামও থাকে। আমরা মানুষই ছয়জন। বাবাকে( শশুর) বলি আমার বাবারও নামটা দিতে কারন গরু-খাসি দুটোই থাকে। বোঝা গেল মৃত মানুষ মূল্যহীন হয়, তাদের নাম দেয়ার নিয়ম নেই। তখন থেকে আমি বাবার কোরবানীর নাম দেই মামার সাথে। মামার কাছে হয়তো তিনি মৃত না। ১২ টার পর উঠে মাংস ভাগ করে বিলিবাট্টা করি। বিলিয়ে দিয়েই মনে হয় বাবার স্পর্শ পাচ্ছি। কারন তার জন্য কিছুই করতে পারি নি।
বহুবছর আমি বাবার গেন্জি কিনি না। ঈদে আমারও কিছু কেনা হয়না। নীল পছন্দের হলেও পরি না, ব্যথায় কুকডে যেতে থাকি। তবুও ঈদ আসে হাসতে হয়, চলতে হয় নিয়ম- অনিয়মের মধ্যেই!!!
ছবি- নেটের।
২০টি মন্তব্য
সুরাইয়া পারভীন
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। অজান্তেই চোখের পাতা ভিজে গেলো। বাবারা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন সবসময়। যার যার বাবা তার তার কাছে সেরা আর অসাধারণ মানুষ। আমি ভাগ্যবতী এখনো বাবার স্নেহের ছায়ায় আছি। পৃথিবীর সকল বাবার জন্যই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
পৃথিবীর সকল বাবাই সেরা। তারা বেঁচে থাকুক আমাদের সবার মাঝে হাজার বছর।
ফয়জুল মহী
খুব সুন্দর লিখন !
অনবদ্য সৃজন ।
ঈদ মোবারক 💐
রোকসানা খন্দকার রুকু
ঈদ মোবারক ভাইয়া
সাবিনা ইয়াসমিন
একটা সময়ে কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো আমার পছন্দের রঙ কোনটা, বলতে পারতাম না। লাল, হলুদ, নীল, সবুজ সব রঙের পোশাকেই মানিয়ে যেতাম, সেসবই ছিলো বাবার কিনে আনা।
বাবার পছন্দের জামা গায়ে দিয়ে ঈদ করি না বহুদিন হয়ে গেলো। প্রবাসে আছেন। ঈদের দিন ফোনে দেখা হয়। পোশাক কিনতে টাকা পাঠিয়ে দেন তারও অনেক আগে, কিন্তু নিজের জন্য কেনা হয় না। বাবাও জিজ্ঞেস করেন না কেন কিনি নাই। তিনি জানেন তার মেয়ে এখনো বুঝতে পারে না তার পছন্দের রঙ কোনটা। তার মেয়ের ঈদ গুলো তার অপেক্ষায় আছে।
বাবা এমন হয় কেন!
কেন প্রতিটি মেয়ের কাছে তার বাবা-ই পৃথিবীর সেরা মানুষ হয়!
আপনার বাবার আত্মার জন্য দোয়া রইলো।
ভালো থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু
বাবারা যে মেয়েদের সকল আশ্রয়-প্রশয়। সে আমরা যতো খারাপই হই না কেন? তাই বাবারা সবসময় সেরা ও প্রিয়।।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার বাবা ভালো থাকুন, যেখানেই থাকুন না কেন। এ কামনা করি।
সবার ইদ আনন্দ-ইদ না লেখা পড়ে তা বুঝতে পারি, তারপর ও জীবন চালু থাকে জীবনের নিয়মে।
তবুও ইদের শুভেচ্ছা আপনাকে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
দোয়া রাখবেন। আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা।
আরজু মুক্তা
বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না।এখনও পাঞ্জাবির দোকানের সামনে গেলে, নাবা বা ওর বাবাকে বলি, একটু দাঁড়াও। ঐ যে আব্বার পছন্দের কালার পাইছি। কিনে আনি। কিন্তু….
তবুও জীবন চলে। মনের গহীনের ব্যথাটা শুধু মোচড়ায়
রোকসানা খন্দকার রুকু
এ ব্যথা শুধু মেয়েই বোঝে। সকল বাবার জন্যই দোয়া রইলো।
হালিমা আক্তার
এক নিঃশ্বাসে পড়ে নিলাম। কি মন্তব্য করব বুঝতে পারছি না। পৃথিবীর সকল বাবারা ভালো থাকুন। শুভ কামনা অবিরাম।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভালো থাকুক সকল বাবারা।
তৌহিদুল ইসলাম
বাবা ছাড়া আমার ২৬ টি ঈদ কেটে গেলো! নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। তবে আমার মা, আপনার ভাবী, ভাইবোনেরা আমরা সবাই সম্পর্কগুলির বন্ধনে আটকে ফেলেছি বলে বাবার অনুপস্থিতির কষ্টটা কম হয়। এটা আমি ছেলে বলেই। তবে আমার বোনেরা, শবনম, এরা আব্বাকে মিস করে প্রচন্ড। তাই আপনার অনুভূতি কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি।
আপনার পরিবারের সকলেই আপনাকে খুব ভালোবাসেন যা আপনার লেখাতেই উঠে এসেছে। এটাই আল্লাহর নেয়ামত। বাবাকে আল্লাহ জান্নাত দান করুন। ভালো থাকুন আপু।
শুভকামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
মেয়েদের শত কষ্টের আশ্রয়স্থল বাবা। আপনি ছেলে বলেই হয়তো কিছুটা কম।
ভালো থাকুক সকল বাবারা!!!
জিসান শা ইকরাম
আপনার বাবা ও ইদ নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক লেখা পড়লাম। ইদ সবার জীবনে আনন্দ বয়ে আনে না, বিষাদও আনে।
আপনার বাবা ভালো থাকুন ওপারে।
আমাদের নারীদের নিজস্ব কিছু নেই,
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
দোয়া করবেন সবসময়। আপনিও ভালো থাকুন।।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অনেক গুলো কঠিন সত্য তুলে ধরলেন। মায়েরা কেন জানি বিবাহিত মেয়েদের কাছে রাখতে চায়না হয়তো সামাজিকতার ভয়ে। ছেলেদের জন্য মায়েদের অগাধ ভালোবাসা। মৃত ব্যক্তির কোনো মূল্য থাকেনা এ পৃথিবীতে। লেখাটি পড়ে চোখে জল চলে আসলো । আপনার বাবার জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো। তবে আপনি যে ঘাড়ত্যাড়ামি করেন, আবার ঘুম ছাড়া কিছু বুঝেন না এটা ভালোই বুঝতে পারলাম 🤪🤪। ঈদের শুভেচ্ছা রইল
রোকসানা খন্দকার রুকু
সন্তান গোল্লায় যাক সামাজিকতাই আসল।
আর ঘুম হলো আমার ফাষ্ট লাভ। ওর জন্যই বেঁচে থাকা।
ধন্যবাদ দি ভাই।
নার্গিস রশিদ
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম! চোখ ভিজে গেলো । যেন আমার গল্প এটা। এই লেখাটার সাথে আমার জীবনের বেশ কিছু মিল পড়ে যায়। আমি এতো সুন্দর করে লেখতে পারবোনা । অনেক কঠিন সত্য আছে। থাক সেটা আমার মনের গভীরে।
অনেক ধন্যবাদ।
দালান জাহান
বিয়ে দিতে পারলেই মেয়েরা পর হয়ে যায় এটা আমি দেখেছি। বাবা শব্দটার সাথে আপনার অনুভূতিযে কতোটা তীব্র এবং দুঃখের হতে পারে , তা হয়তো আমি বুঝতে পারবো না। তবে এতটুকু বলতে পারছি আপনার লেখা পড়ে , বাবা চলে যাবার পর আপনার সব সুখ আহ্লাদ মিলিয়ে গেছে বাবার মতো। পৃথিবী বড়ো দুঃখের জায়গা কখন যে কোন মানুষ আকাশ হয়ে যায় তা বুঝাই মুশকিল , তারপর আকাশের রঙ ধরা মেঘ মেঘ বৃষ্টি পড়া আরও কতো কী!
বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মিনার অই মিনারের উপরে হয় তো আর কোন পাখি ওড়ে না।
ভালো হোক আপনার অনুভূতি শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।