এই সময় একটা ঘটনা হয়ে গেল। হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটু আড়াআড়ি চলছিল। গোপালগঞ্জ শহরের আশেপাশেও হিন্দু গ্রাম ছিল। দু’একজন মুসলমানের উপর অত্যাচারও হল। আবদুল মালেক নামে আমার এক সহপাঠী ছিল। সে খন্দকার শাসসুদ্দীন সাহেবের আত্মীয় হত। একদিন সন্ধ্যায়, আমার মনে হয় মার্চ বা এপ্রিল মাস হবে, আমি ফুটবল মাঠ থেকে খেলে বাড়িতে এসেছি: আমাকে খন্দকার শামসুল হক ওরফে বাসু মিয়া মোক্তার সাহেব (পরে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন)ডেকে বললেন, “মালেককে হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানারজীর বাড়িতে ধরে নিয়ে মারপিট করছে। যদি পার একবার যাও। তোমার সাথে ওদের বন্ধুত্ব আছে বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আস।“ আমি আর দেরি না করে কয়েকজন ছাত্র ডেকে নিয়ে ওদের ওখানে যাই এবং অনুরোধ করি ওকে ছেড়ে দিতে। রমাপদ দত্ত নামে এক ভদ্রলোক আমাকে দেখেই গাল দিয়ে বসল। আমিও তার কথার প্রতিবাদ করলাম এবং আমার দলের ছেলেদের খবর দিতে বললাম। এর মধ্যে রমাপদরা থানায় খবর দিয়েছে। তিনজন পুলিশ এসে হাজির হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, “ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নাহলে কেড়ে নেব।” আমার মামা শেখ সিরাজুল হক (একই বংশের) তখন হোস্টেলে লেখাপড়া করতেন। তিনি আমার মা ও বাবার চাচাতো ভাই। নারায়নগঞ্জে আমার এক মামা ব্যবসা করেন, তার নাম শেখ জাফর সাদেক। তার বড় ভাই ম্যাট্রিক পাস করেই মারা যান। আমি খবর দিয়েছি শুনে দলবল নিয়ে ছুটে এসেছেন। এর মধ্যেই আমাদের সাথে মারপিট শুরু হয়ে গেছে। দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়। আমরা দরজা ভেঙে মালেককে কেড়ে নিয়ে চলে আসি।
শহরে খুব উত্তেজনা। আমাকে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। সেদিন রবিবার। আব্বা বাড়ি গিয়েছিলেন। পরদিন ভোরবেলায় আব্বা আসবেন। বাড়ি গোপালগঞ্জ থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে। আব্বা শনিবার বাড়ি যেতেন আর সোমবার ফিরে আসতেন, নিজেরই নৌকা ছিল। হিন্দু নেতারা রাতে বসে হিন্দু অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে একটা মামলা দায়ের করল। হিন্দু নেতারা থানায় বসে এজাহার ঠিক করে দিলেন। তাতে খন্দকার শামসুল হক মোক্তার সাহেব হুকুমের আসামী। আমি খুন করার চেষ্টা করেছি, লুটপাট দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগিয়ে দিয়েছি। ভোরবেলায় আমার মামা, মোক্তার সাহেব, খন্দকার শামসুদ্দীন আহমেদ এমএলএ সাহেবের মুহুরি জহুর শেখ, আমার বাড়ির কাছের বিশেষ বন্ধু শেখ নুরুল হক ওরফে মানিক মিয়া, সৈয়দ আলী খন্দকার, আমার সহপাঠী আবদুল মালেক এবং অনেক ছাত্রের নাম এজাহারে দেয়া হয়েছিল। কোনো গণ্যমান্য লোকের ছেলেদের বাকি রাখে নাই। সকাল ন’টায় খবর পেলাম আমার মামাও আরও অনেককে গ্রেফতার করে ফেলেছে। আমাদের বাড়িতে কি করে আসবে-থানার দারোগা সাহেবদের একটু লজ্জা করছিল! প্রায় দশটার সময় টাউন হল মাঠের ভিতর দাঁড়িয়ে দারোগা আলাপ করছে, তার উদ্দেশ্য হল আমি যেন সরে যাই। টাউন হলের মাঠের পাশেই আমার বাড়ি। আমার ফুফাতো ভাই, মাদারীপুর বাড়ি। আব্বার কাছে থেকেই লেখাপড়া করত, সে আমাকে বলে, “মিয়াভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না।” বললাম, “যাব না, আমি পালাব না। লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি।”
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-১১ ও ১২)
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (পর্ব-০৭)
১৬টি মন্তব্য
খসড়া
ভাল লাগল।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
নিয়মিত পড়ছি আবার।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
নিয়মিত পড়ছেন আবার!
অবশ্যই জানাবেন ওবারের পড়া আর এবারের খণ্ডখণ্ড পড়ার মাঝে তফাৎ কি?
নীলাঞ্জনা নীলা
জীবনের সাদা-কালো অংশটাকে এখন রঙ দিয়ে সাজাচ্ছি। এই হলো পার্থক্য। 🙂
শুন্য শুন্যালয়
এমন বলিষ্ঠ আর সাহস গুনেই তিনি অনন্য একজন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
কি কি গুণাবলী একজন মানুষকে কিংবদন্তীর নায়কে পরিণত করে তুলেছিলো, এই আত্মজীবনীটি পড়লে তাই অনুধাবন করা যায়।
জিসান শা ইকরাম
পড়ছি আর জানছি বঙ্গবন্ধুকে
শত ব্যস্ততার মাঝে নিয়মিত লিখছেন, ধন্যবাদ আপনাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপনাদেরকেও সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য।
অনিকেত নন্দিনী
এই পোস্টের বদৌলতে অনেক কিছুই জানছি।
সাথেই আছি আপু, লিখতে থাকুন। 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এমন প্রেরণা দানকারী সহব্লগার থাকলে লিখতে অধৈর্য লাগার কথা না।
অনেক ধন্যবাদ।
অনিকেত নন্দিনী
এই সিরিজের কোন পোস্ট থেকে বাদ পড়তে চাইনা আপু। একেকটা পোস্ট পড়েই পরবর্তী পোস্টের অপেক্ষায় থাকি। 🙂
শুভ্র রফিক
অনেক ভাল লাগল।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ ভাইয়া।
ব্লগার সজীব
আপু নিয়মিত শেয়ার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ ভাইয়া, পাশে থাকার জন্য।