
সুদীপ্ত আজ দীর্ঘ বিশ বছর প্রবাস জীবন যাপন করছে। ঘরে সুন্দরী, শিক্ষিতা স্ত্রী আর ফুটফুটে দুই সন্তান রেখে প্রবাসে একাকী জীবন পার করছে। ষোলো বছরের সংসারে ভালোবাসা, সুখের কোনো অভাব সে পায়নি। তবুও বুকের পাঁজরের কোথায় যেন লুকিয়ে আছে একটা চিনচিনে ব্যথা, শূণ্যতার বাসা।
সুদীপ্তের ও একটা বাল্যপ্রেম ছিল। ওর ই এক কাজিনের সাথে। আত্নীয়তার সূত্রে ছোট বেলা থেকেই একসাথে জীবনের অনেক ঘটনা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সুদীপ্ত তখন মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। লেখাপড়ায় সে বরাবরই ভালো। মামার বাড়িতে থাকতে গিয়ে বাবার বাড়ীর আত্নীয়দের সাথে তেমন একটা ওঠাবসা ছিল না।
মেয়েটি সুদীপ্তের খালাতো বোন। শ্যামাঙ্গিণী বলতে যা বুঝায় মেয়েটি ঠিক তাই। তবুও সুদীপ্ত কেন জানি ওর শ্যাম বর্ণের প্রেমে পড়ে যায়। আকারে ইঙ্গিতে ওকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করে ওর দুর্বলতা বা ভালোবাসার কথা। কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই যেন ধরা দিচ্ছে না। মেয়েটিকে সে মাঝেমধ্যেই পড়া দেখিয়ে দিতো। পড়া দেখানোর চেয়ে ওকে কাছ থেকে দেখা আর কাছাকাছি থাকাটাই ওকে অনেক বেশি আনন্দ দিতো। এভাবেই একদিন মেয়েটিকে একলা পেয়ে জোর করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। মেয়েটি ভয়ে , লজ্জায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার বৃথা চেষ্টা করে গেলো। সুদীপ্ত শুধু বললো,’আমি তোমাকে খুউব ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারিনা’। মেয়েটি বললো সে সুদীপ্ত কে ভালোবাসেনা। সুদীপ্ত কষ্ট চেপে রেখে শুধু বললো,’তোমাকে ভাবার সময় দিলাম । ভেবে তারপর জবাব দিও।’ এই বলে সুদীপ্ত ওকে ছেড়ে ঘরের দরজা খুলে দিল। যথারীতি মেয়েটি তৎক্ষণাৎ ঘরের বাইরে চলে গেল । সুদীপ্ত ওর চলে যাওয়াটা অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে দেখলো। ওর বুকের একটা চাপা কষ্ট দূর হলো এতো দিনের না বলা কথাটা বলতে পেরে। কিন্তু মেয়েটির কথায় নিজেকে যেন অপরাধী বানিয়ে দিল। সুদীপ্ত এখনো ওকে পড়া দেখিয়ে দেয় কিন্তু চোখের দিকে আর তাকাতে পারেনা।
এমন করেই অনেক দিন পার হয়ে গেল হঠাৎ একদিন সুদীপ্ত বইয়ের ভাঁজে একটি চিরকুট পায়।বাজে কাগজ ভেবে ফেলতে গিয়েও সে কি মনে করে যেন কাগজটি খুলে ফেলে। খুলেই তো ওর হার্টবিট বেড়ে গেল। এযে ‘ভালোবাসি তোমায়’লেখা একটি চিরকুট। লেখাটি দেখে ওর বুঝতে অসুবিধা হয় না এটি তার ভালোবাসার মানুষটির লেখা চিরকুট। তখনই সে দৌড়ে গিয়ে মেয়েটিকে খুঁজে নিয়ে হাত ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে গেল।
শুরু হলো শ্যামাঙ্গিণী আর সুদীপ্তের প্রেম কাহিনী। এভাবেই দু’বছর কাটিয়ে দিল ওরা হেসেখেলে। হঠাৎ মেয়েটির মা মারা গেলো। পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেলো, মানুষিক ভাবে পরিবারের সবাই ভেঙ্গে পড়লো। মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিল সে আর পড়াশোনা করবেনা। সুদীপ্ত অনেক বুঝালো কিন্তু শ্যামাঙ্গিণী কিছুতেই শক্ত হতে পারছিল না। এরমধ্যে সুদীপ্ত উচ্চ শিক্ষার্থে শহরে চলে গেল। মাঝে মাঝে চিঠিপত্র দেয়া নেয়া চলছিল। হঠাৎ মেয়েটি জানায় তার বড় বোনের এক ব্যবসায়িক বন্ধু তাকে প্রোপোজ করেছে। সুদীপ্ত বললো,’তুমি বলোনি আমাদের সম্পর্কের কথা?’ মেয়েটি বললো বলেছি। ছেলেটি নাকি তাকে বলেছে ,’কখনো যদি তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায় বা তার প্রয়োজন হয় তাহলে সে যেন তাকেই খুঁজে নেয়। সে মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করবে। সুদীপ্ত শহরে থাকাতে ঐ ছেলেটি মেয়েটির অনেক কাছাকাছি চলে আসে। মেয়েটিও কেমন করে যেন ছেলেটিকে এড়াতে পারে না। আস্তে আস্তে সময় গড়ায়, সুদীপ্ত ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর একদিন এক বন্ধুর কাছে জানতে পারে মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়েছে ঐ ছেলেটির সঙ্গেই। যেহেতু সুদীপ্তের পড়াশোনা শেষ করে কিছু করতে আরো কিছুটা সময় লাগবে তাই মেয়েটি বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। সুদীপ্ত ভালোবাসার মানুষটির মর্যাদা দিতে গিয়ে কাউকে কিছু না বলে শুধু শ্যামাঙ্গিণীর কাছ থেকে সত্যি টা জানতে চায়। শ্যামাঙ্গিণী স্বীকার করে যে হ্যাঁ সে ঐ ছেলেটিকেই বিয়ে করছে। সুদীপ্ত নীরব হয়ে যায় , শুধু ‘ভালো থেকো’বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসে। বিয়েতে সুদীপ্তকে দাওয়াত পাঠানো হয়। সুদীপ্ত সবকিছু বুকে চেপে রেখে হাসিমুখে ভালোবাসার মানুষটির অন্যের হয়ে যাওয়াটা অপলক ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখে। এরপর সুদীপ্তের জীবন পাল্টে যায়। লেখাপড়ায় ছন্দপতন ঘটে। কোনো রকমে পাশের সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। তারপর বাবা-মায়ের পীড়াপীড়িতে অচেনা অজানা একটি মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের দু’বছরেও মেয়েটির সাথে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না। যদিও বিয়ের রাতেই সুদীপ্ত তাকে সব জানিয়ে দেয়। ওর বউ সব হাসিমুখে মেনে নেয়। ওর বউ ভালোবাসা দিয়ে ধীরে ধীরে সুদীপ্তের মনে জায়গা করে নেয়। তাই সুদীপ্তের আজ সবই আছে। টাকা-পয়সা , বাড়ি-গাড়ি , ভালোবাসা কিছুরই অভাব নেই। শুধু একদিন নিজের কিছু ছিল না বলে তার একমাত্র ভালোবাসাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়ে ছিল। আজ সবই আছে, শুধু যাকে নিয়ে তার সব ভালোবাসা, স্বপ্ন, চাওয়া-পাওয়া ছিলো আজ সেই শ্যামাঙ্গিণী ই তার পাশে নেই। শ্যামাঙ্গিণী ও নাকি সুখেই আছে তার সংসার নিয়ে। সুদীপ্ত আজো তার খবর নেয়। আত্নীয়তার সূত্রে এখনো ওদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক বিরাজমান। সুদীপ্ত ওকে ভালোবাসতো তাই সে মনে প্রাণে শ্যামাঙ্গিণীর সুখই চেয়ে এসেছে।
২৮টি মন্তব্য
নুর হোসেন
“শ্যামাঙ্গিণী স্বীকার করে যে হ্যাঁ সে ঐ ছেলেটিকেই বিয়ে করছে। সুদীপ্ত নীরব হয়ে যায় , শুধু ‘ভালো থেকো’বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসে”
-প্রতারক প্রতারনা করে, প্রকৃত প্রেমিকরা ক্ষমা করে দেয়।
পরিপাটি সাজিয়ে গুছিয়ে চমৎকার উপস্হাপন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ আপনাকে
জিসান শা ইকরাম
কিছুটা দুরত্ব দুজনকে এক হতে আর দিলনা,
কাংখিত নারীকে না পেয়ে সুদীপ্তর জীবন কিছুটা অপুর্ন থেকেই গেলো।
একান্ত অনুভুতির মোড়কে গল্প ভালো লেগেছে খুব।
শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ দাদা
ইসমাইল জসীম
বাহ । আপনিও পারেন? বেশ ভালো লাগলো আপনার গল্প পড়ে। প্রেম মানে কেবল কাছে পাওয়া নয়, দূরে থেকেও ভাল বাসা যায়। যাকে ভালোবাসে তার সুখ চাওয়াটাই প্রকৃত প্রেমিকের কাজ।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
ডিজাইনার সূপর্ণারও এ আরেক সত্ত্বা, তাইনা ইসমাইল ভাই? যত পড়ছি, ততই অবাক হচ্ছি।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সত্যিই তোমাদের মন্তব্যে আমি আবারও ধন্য হলাম
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হুম ঠিক। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য
জাকিয়া জেসমিন যূথী
অসাধারণ লেখনী তোমার। নিয়মিত লেখো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ঠিক আছে বন্ধু লিখবো
শাহরিন
সময় মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব করে কিন্তু সে মানুষের জায়গাটি খালিই রয়ে যায়। অনেক সুন্দর গল্প।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ আপনাকে
সুরাইয়া পারভিন
চমৎকার লিখেছেন।
শ্যামাঙ্গিণী স্বীকার করে যে হ্যাঁ সে ঐ ছেলেটিকেই বিয়ে করছে। সুদীপ্ত নীরব হয়ে যায় , শুধু ‘ভালো থেকো’বলে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসে”
কতোটা মহৎ আর সত্যিকারের ভালোবাসা হলে এতো সহজেই ক্ষমা করে দেওয়া যায়!
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভালবাসার মানে তো ভালবাসাই, প্রিয় মানুষটির ভাল চাও্য়া, তার সুখ চাওয়া, তাকে সুখী দেখা । সেখানেই ভালবাসার জয়। প্রিয় মানুষটি যেখানে সুখ খুঁজে পায়, তাকে সেখানেই যেতে দেয়াই উচিত। কারণ তার সুখই তো প্রেমিকের সুখ। আপু আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার লেখাটা পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন। আপনাদের উৎসা্হ পেলে সামনে এগিয়ে যাবার ইচ্ছে ।
কামাল উদ্দিন
এতো জীবনের গল্প। এমন সুদীপ্ত আর শ্যামার অভাব নেই আমাদের সংসারে। গল্পটা পড়ে মনটা নষ্ট্যালজিক হয়ে পড়লো, ভালোলাগা জানিয়ে গেলাম আপু।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ আপনাকে
ছাইরাছ হেলাল
কিছু স্মৃতি মানুষ আমরণ ধারণ করে,
ভালোবাসার স্মৃতিপনা লেখাটিতে ভালই ফুটে উঠেছে।
লিখুন নিয়ম করে, নিয়মিত।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ আপনাকে । আপনাদের অনুপ্রেরণায় আশা করি নিয়মিত লিখবো
নিতাই বাবু
যেন নিজের জীবনের গল্প পড়লাম। আমিও একজন অপদার্থ সুদ্বীপ্ত!
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সত্যিই এমনটা কম বেশি সবারই জীবনে ঘটেছে। ধন্যবাদ দাদা
এস.জেড বাবু
যখন কিছু থাকে না তখন ভালোবাসা থাকে
যখন সবই হয়- তখন ভালবাসা থাকে না-
হয় এমন’ – হচ্ছে এমন
হাজার জীবনের গল্পের নায়ক সুদ্বীপ্ত।
সুন্দর লিখেছেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ ভাইয়া।
মাহবুবুল আলম
প্রেম আসলে েএমনই হয়!
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হুম ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ
প্রদীপ চক্রবর্তী
প্রেম প্রতিমূর্তি স্বরূপ।
তাকে যতো সাজাবে ততো রূপ ও মনের মিলন ঘটবে।
তাই তো প্রেমের নানান রঙ।
বেশ ভালো অনুভূতি দিদি।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ দাদা
সঞ্জয় মালাকার
যখন কিছু থাকে না তখন ভালোবাসা থাকে।
চমৎকার লিখেছেন ভালো লাগলো খুব ।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ দাদা ।