যে প্রথায় হীনতা আছে, দীনতা আছে তাকে বদলালে সমাজ এগোবে। ভাঙ্গতে না পারলেও, পরিবর্তন তো আনাই যায়! শুদ্ধিকরণ তো করাই যায়!

একটা সময় ছিল যখন বিবাহিত মেয়ে মানেই হররোজ তাকে শাড়ি পরতেই হতো! যত কম বয়সেই বিয়ে হোক না কেনো, বউ বলে কথা! শাড়ি না পরলে কি চলে? শাড়ি সামলাতে পারুক আর না পারুক তবুও তাকে শাড়ি পরতেই হবে!

মূলতঃ বাঙালী মেয়েরা শাড়িতেই সুন্দর! বিয়ে পরবর্তী নতুন বউও শাড়িতেই আকর্ষনীয়া! সে… ঠিক আছে। কিন্তু বিয়ে পরবর্তী হররোজ শাড়িই পরতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা কতোটা সহনীয়? এটা কি চাপিয়ে দেয়া নয়?

অথচ বিবাহিত পুরুষদের বেলায় কিন্তু তেমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই, মেয়েদের বেলায় সেটি বাধ্যবাধকতায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য সময়ের সাথেসাথে এখন সে জায়গাটিতেও পরিবর্তন এসেছে। একই বাড়িতে মেয়ে আর ছেলেবউ বলে এখন আর আলাদা করে কাউকে চিহ্নিত করার উপায নেই, বিবাহিত অবিবাহিত বলেও আলাদা করা যায়না। এমনকি অজপাড়াগাঁয়েও এখন শাড়ি পরার বাধ্যবাধকতা নেই বললেই চলে।

তারও আগে মেয়েরা শিশুকাল অতিক্রম করেই শাড়িতে শরীর পেচাতো। এমনকি ২৫/৩০ বছর আগেও আমি আমার শিশুবয়সে দেখেছি খালারা স্কুল ছেড়ে কলেজে পা রাখা মাত্রই শাড়ি গায়ে জড়িয়েছেন।

নিয়মের মধ্যে আরেকটি ছিলো, বিয়ের সময় বউয়ের নাকে পরিয়ে দেয়া নাকফুল (কারো কারো ক্ষেত্রে হাতের চুড়ি), সারাজীবন পরে থাকতে হবে। যদি খুলে ফেলা হয় তাহলে স্বামীর অমঙ্গল হবে। আদৌ কি তাই?
এখনো অনেক শিক্ষিত মেয়েকে দেখা যায় এই নিয়মগুলোকে আকড়ে থাকতে। কিন্তু যারা বুঝে, যারা এর অসারতা উপলব্দি করে তারা মানে না। যেমন আমার ক্ষেত্রে এমন ঘটেছিলো।

আমার বিয়ের পরদিনই শ্বাশুড়ীমা দেখলেন আমার হাতে চুড়ি নেই, তড়িঘড়ি করে তিনি চুড়িগুলো নিয়ে এসে আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন নতুন বউ; দেখতে খারাপ লাগে। তার পরের দিনও একই ঘটনা। বুঝে গেলেন এই মেয়ের অভ্যাস খারাপ, সে অলংকার গায়ে রাখেনা। তৃতীয়দিন তিনি বলেই বসলেন এতে তোমার স্বামীর অমঙ্গল হবে, শুধুতো আমার ছেলেই নয়; তোমারও স্বামী। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম, হাসি পেয়েছিলো আমার! কিন্তু কি করবো? আমি তখন নতুন বউ। বলেছিলাম ঠিক আছে আর খুলবো না। সেদিন কিন্তু উনি আমার উপর তা চাপিয়ে দেননি, বুঝিয়ে বলেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলাম এটা উনার সংস্কার, আমার কাছে যা কুসংস্কার। কারন আমার মাকে আমি প্রায় সময়ই চুড়ি ছাড়া থাকতে দেখেছি। প্রিয়জনের অমঙ্গল আশংকায় সংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে শ্বাশুড়ীমা তা মানতেন এবং চাইতেন আমিও মেনে চলি। বরাবরই অলংকার আমার এলার্জি। প্রয়োজনমতো পরে আবার খুলে ফেলাই অভ্যাস। কিন্তু শ্বাশুড়ীমা‘র জীবদ্দশায় কোনদিনই তিনি আমায় চুড়ি ছাড়া দেখেননি। উনি যখনই আমার বাসায় আসতেন, আমার অফিস কলিগরা আমার হাতে চুড়ি পরা দেখে বুঝে যেতো যে তিনি এসেছেন। শুধুমাত্র উনার প্রতি সন্মান আর সন্তানের প্রতি উনার দুর্বলতা মনে রেখেই আমি তা মেনটেন করতাম। তবে শেষের দিকে আমি তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে এটি একটি কুসংস্কার।

আবার আরেকদিকে দেখা যায়, যখন কোন নারীর স্বামী মারা গেলো তখন তাঁকে আরেকরুপে আর্বিভুত হতে হয়েছে। তাঁর বৈধব্যকে ফুটিয়ে তুলতে তাঁকে সাদা শাড়িতে শরীর মুড়াতে হতো। শোকে মূহ্যমান নারীর শরীর থেকে সাথেসাথে সকল প্রকার অলংকার খুলে ফেলা হতো। এখনো এসকল প্রথাগত নিয়ম সমাজে বহু জায়গায় সুযোগ পেলেই চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলে।

আজ থেকে প্রায় ৫/৬ মাস আগে আমার এক সময়ের প্রতিবেশি এক ভদ্রলোক মারা গেলে আমি তাঁর বাসায় যাই সমবেদনা জানাতে। সেখানে বসে আছি এমন সময় এক ভদ্রমহিলা এসে সদ্য স্বামীহারা মহিলাটির মনের অবস্থা কি তা জানার আগেই তিনি প্রশ্ন রেখে বসলেন ‘ওমা, একি! এখনো নাকফুল খোলা হয়নি? একটু পরেই তো লাশ নিয়ে যাবে।’ বলেই তিনি এগিয়ে এলেন তাঁর নাকফুল খুলতে। স্বামীহারা মহিলাটি তখনো শোকে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলো। অন্য মহিলারাও তেমন কিছু বলছিলেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে আমিই প্রশ্ন রাখলাম ‘এখনই খুলতে হবে কেনো?’ তিনি আমাকে হাদীসের দোহাই দিলে আমার পাল্টা জবাব হাদীসের কোথাও এমন কিছু আছে বলেতো আমার জানা নেই! আমার কথা শুনে রুমটিতে আগত বাকী মহিলারাও যেনো একটু সরব হয়ে উঠলেন। অবস্থা সুবিধার না দেখে সে মহিলা আর কথা বাড়ালেন না।

আমার মতো অনেকেই জানেন এরকম অনেক নিয়ম সমাজে চালু আছে, যা সমাজের কোন কল্যানে আসে না কিন্তু যে নারীটির উপর তা চাপিয়ে দেয়া হয়, একমাত্র সে নারীটিই এর যন্ত্রনা অনুধাবন করেন। খুব সুকৌশলে তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয় তোমার হাসতে মানা, সাজতে মানা, উচ্চস্বরে কথা বলতে মানা। অথচ কেউ মুখ ফুটে বলার চেষ্টা করেন না যে এটি অনিয়ম। জানতে চান না কোন কারনে এটি মানতে হবে?

কোথাও কোথাও যে এক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসেনি, তা নয়। একটু সাহসী, শিক্ষিত যে নারী, সে কিন্তু এখন বিধবা হলেও গয়না ও রঙিন পোশাক পরছে। এই বদলে যাওয়া কিন্তু প্রয়োজনের কারনেই হয়েছে।

আরও আগে মুসলিম বিধবারা জীবদ্দশায় চুলে তেল-চিরুনি দিতে পারতেন না। হিন্দু বিধবাদের মাথার চুল ন্যাড়া করে দেয়া হতো। কখনই আমিষ খেতে দেয়া হতো না।
তারও আগে হিন্দু সমাজে সহমরণ প্রথা প্রচলিত ছিলো। স্বামী মারা গেলে স্বামীর সাথে জীবিত স্ত্রীকেও চিতায় উঠতে হতো। মরে যাওয়া স্বামী আর জীবিত স্ত্রীকে নিয়মের দোহাই দিয়ে একসাথে দাহ করা হতো। রাজা রাম মোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে এই অমানবিক প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।

কিন্তু বিপত্নীক পুরুষের বেলায় কখনোই এমন কোন নিয়মের প্রয়োজন পড়েনি। আগেও পড়তো না, এখনো পড়েনা। চলনে-বলনে আহার গ্রহণে কোন ব্যতিক্রম দরকার হয়না। তাদের শরীরে কোন চিহ্ন বহন করতে হয়না। তাদের দেখে কখনো বুঝার উপায় নেই অবিবাহিত, বিবাহিত না বিপত্নীক। সকল কাল তাদের একই রকম। কিন্তু নারীদের অবিবাহিত, বিবাহিত ও বিধবা এই তিন রুপ তার শরীরে বহন করতে হতো। এখন এই বিশ্বায়নের এই যুগে নারীদের পোষাকে, চলনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আবার এখন সকল বয়সের সকল রূপের নারীই ইচ্ছেমতো পোষাক পরে।

অন্যদিকে অফিস আদালতে একসময় পুরুষের বেলায় লেখা হতো মিস্টার অমুক কিন্তু নারীর বেলায় অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে মিস আর বিবাহিতদের ক্ষেত্রে মিসেস ছিলো। এখন সেখানেও পরিবর্তন এসেছে। এখন বলা হয় মিজ, যার অবিবাহিত/বিবাহিত বলে আলাদা কোন রুপ নেই।

সমাজে নারীদের উদ্দেশ্যে চাপিয়ে দেয়া প্রথাগুলো ভাঙতে অথবা তাতে পরিবর্তন আনতে গেলে নারীকেই নারীর জন্য হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। হ্যাঁ, চাপানোর কাজটিও কিন্তু নারীদের দ্বারাই ঘটে, তার কারন বছরের পর বছর মস্তিষ্কে যে সংস্কার ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, তা যে সংস্কারের নামে কতোটা কুসংস্কার তা বুঝানোর জন্য নারীদেরই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রচলিত একটা কথা প্রায়ই লোকমুখে শুনা যায় ’মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু!’ হয়তো বংশ পরম্পরায় কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ নারীরা তাঁদের বাবা, ভাই, সন্তানের মঙ্গল কামনায় উত্তরসুরীদের উপর সংস্কারের নামে কুসংস্কার চাপিয়ে দিতে গিয়েই সম্পর্কের টানাপোড়নে জড়িয়ে যান, যার ফলশশ্রুতিতে কথাটা চলে এসেছে। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে যে নিয়মগুলো জগদ্দল পাথরের মতো নারীর জীবনে প্রথা হিসাবে চেপে বসেছে সে নিয়মগুলো সৃষ্টিতে নারীর ভূমিকা কতোটুকু ছিলো, তাই আজ প্রশ্নসাপেক্ষ!!!

৭৫৫জন ৭৫৫জন
0 Shares

৪০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ