পিতামাতার ভরণপোষণ বিধিমালা খসড়া: পুত্রবধূও বাধ্য সেবা দিতে।”

সম্প্রতি এই শিরোনামে পত্রিকান্তরে জানা গিয়েছে যে পিতা-মাতার ভরণপোষণ সংক্রান্ত একটি খসড়া বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

পরবর্তী অংশ-

আজ আসি, খসড়ার আরো একটি বিষয় প্রসঙ্গে।
খসড়ায় কিন্তু বলা হয় নাই, সন্তান লায়াবল। বলা হয়েছে পুত্র ভরণপোষণ দেবে। আর সেবার ক্ষেত্রে পুত্রবধূর উপর আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পুত্র সন্তানই কি পিতা-মাতার সন্তান? কন্যা সন্তান সন্তান না? একই প্রক্রিয়ায় কন্যা সন্তানকে লালনপালন করে তার উপর কী তাদের কোনই অধিকার বর্তায় না? জন্মদায় কী শুধুই পুত্র সন্তানের? কন্যা সন্তানেরও তো জন্মদায় আছে। তাহলে সে লায়াবল নয় কেনো? জন্মদায়গ্রস্ত কন্যাকে বাদ দিয়ে সেবার ক্ষেত্রে আইনি কাঠামোতে লায়াবল করা হচ্ছে পুত্রবধূকে যার জন্মদায় নেই, আছে বৈবাহিক সূত্রে দায়বদ্ধতা! বৈবাহিক সূত্রে দায়বদ্ধতা তো জামাতারও (কন্যার স্বামী) আছে। আর যদি জন্মদায়হীন পুত্রবধূকে লায়াবলই করা হয়, তবে জামাতা নয় কেনো?
এই যে আইনি কাঠামোতে পুত্রবধূকে দায়বদ্ধ করা হচ্ছে এর ফল হিসেবে গিট্টুটা আরেকটু জটিল আকার ধারণ করবে। জাস্ট ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী একটা গিট্টু।

অথচ যদি বলা হতো, ভরণপোষণের জন্য উপার্জনকারী সন্তান আর সেবা সন্তানসন্ততি সকলেই দিতে বাধ্য, তাহলে হয়তো ঝামেলার বদলে সমঝোতার মাধ্যমেই পরিস্থিতিটা সামাল দেয়া হতো। আমরা জানি এবং মানি, নাড়ীরটান বড় টান। পৃথিবীর শ্রেষ্ট টান। বয়সী পিতামাতার বিশেষ করে চলৎশক্তিহীন অবস্থায় তাদের দায়িত্ব পুত্রের পাশাপাশি কন্যাও কিছুটা নিলে নাড়ীর টান থেকেই সেবাটা পারফেক্ট হতো। যে যেভাবে পারে। দায়িত্ব তো কেবল আর্থিক নয়, বয়সকালে পিতামাতাকে সেবাশুশ্রূষা দেয়াটাও একটা বিশাল দায়িত্ব। সেসময়টায় তারা থাকে অবোধ শিশুর মতো। নাড়ীর টানে কন্যা যতোটা দিতে পারবে দায়বদ্ধতা থেকে পুত্রবধূ তার কতোটাইবা দিতে পারবে!
আবার অন্যদিকে কন্যা কোনকারণে না দিতে পারলে ভাইবউয়ের প্রতি তার এক ধরণের কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করতো। এই বোধ থেকেই সম্পর্কটা মধুর থাকতো। কিন্তু এখন ছেলেবউকে বাধ্যবাধকতায় ফেলে একটা জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আমাদের পিতা-মাতা বা দাদা-দাদীর আমলে প্রথাগত নিয়মের ব্যাপারটা কাজ করতো সুচারুরূপেই। তখনের সময় আর এখনের সময় ভিন্ন। এখন মানুষ তুলনামূলকভাবে বাস্তবমুখী। এখন নারীরা ঘরে-বাইরে কাজ করছে। বাস্তব প্রেক্ষাপটে দেখেছি, বৃদ্ধাবস্থায় মেয়েদের কাছে থাকা বাবা-মায়ের যত্নে ঘাটতি পড়লে কেউ আঙুল তুলে না। না পরিবার, না সমাজ কিন্তু ছেলের কাছে থাকাবস্থায় সামান্য এদিকওদিক হলেই নানান কথা চলতে থাকে সমাজ-সংসারে। প্রথাগত আচারের কারণেই এটা হয়। তখন পরিবারের বউটি হয় কোণঠাসা। সে খাটেও আবার কথাও শুনে।

ইদানীং সম্পত্তির বিষয়েও একটা খবর বেরিয়েছে দেখেছি, পৈতৃক সম্পত্তিতে সমান অধিকার। তো, অধিকারের বেলায় সমভাগ আর দায়িত্বের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব থাকবে না কেনো? দুটোই হোক বাস্তবভিত্তিক।
আমি অনেক মেয়েকে দেখেছি প্রথাগত নিয়মের অজুহাতে দায় এড়াতে। পিতামাতার কঠিন সময়েও উছিলা খুঁজে এড়িয়ে যেতে। দেখেছি, পান থেকে চুন খসলে ভাইবউয়ের উপর চটে যেতে। আবার এটাও দেখেছি, অধিকারের বেলায় কোন ছাড় না দিলেও দায়বদ্ধতার বেলায় ষোলআনা দায় বউয়ের দিকে ছুড়ে দিতে। এমনকি, মা? যিনি পরিবারের মূল কর্ত্রী, তিনিও আদর-যত্নে প্রায়োরিটি মেয়ে থাকলেও, দায়ের বেলায় বউয়ের দিকেই আঙুল তুলেন। কারণ, প্রথাগত আচার।
অন্যদিকে দেখা যায়, বর্তমান সময়ের কর্মজীবী নারী তাদের বাচ্চা লালনপালনের বেলায় শ্বাশুরীমায়ের সাপোর্টের থেকেও নিজ মায়ের উপর নির্ভরশীল বেশি। শ্বাশুরীমা বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে চলেন। আবার কেউকেউ নিতে চাইলেও সাতপাঁচ ভেবে নেন না। এখানেও নাড়ী সম্পর্কটি অদৃশ্যে কাজ করে।

আমি খুব করে চাই, প্রতিটা পিতামাতা বয়সকালে তার মেয়ের কাছে থাকুক। বিশেষ করে শয্যাশায়ী হলে। ঠিক যেমনভাবে শিশুকালে মা-বাবা সন্তানকে আগলে রাখতেন। ওই যে, প্রথমে একটি কথা বলেছিলাম না? ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ’ অর্থাৎ নাড়ীর টানের চেয়ে বড় সম্পর্ক আর দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু সামাজিক কাঠামোয় প্রথাগত আচারের কারণে মেয়ের সেবা পাওয়াটা সেসময় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কখনোকখনো মেয়ের পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আবার কখনো সমাজ। আমরা জানি, প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষ সেবামূলক কাজে একেবারেই জিরো। সেক্ষেত্রে পিতামাতার সেবা শুশ্রূষায় পুত্রকে বউয়ের উপরই নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে দায়টা কন্যা নিলে পুত্র যেমন স্বস্তি পেতে পারে, তেমনি বৃদ্ধাবস্থায় মা-বাবাও অপার শান্তিতে বৃদ্ধ বয়সটা সন্তান জন্মদানের আনন্দ উপভোগ করেই শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করতে পারেন। অথচ, আমরা গিট্টু লাগিয়ে তাদের সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি। হ্যাঁ, শিশুকালে মা-বাবা যেমন মিলেমিশে সন্তানকে বড় করেছেন অর্থাৎ একজন যত্ন দিয়ে আরেকজন ভরণপোষণ দিয়ে লালনপালন করেছেন, তেমনি সন্তানরাও দেবে। পুত্র ভরণপোষণ দেবে, কন্যা সেবাশুশ্রূষা দেবে। তাহলেই তো হয়ে যায়। গিট্টুও লাগে না। সামাজিক বিধিব্যবস্থাও ন্যায়সঙ্গতভাবে কন্যাকে জন্মদায় মেটানোর সুযোগ দেয়। আর বৃদ্ধাবস্থায় মা-বাবাও অপার শান্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করতে পারেন।
একটু ভেবে দেখা যায় কী?

*এটা একান্তই আমার অভিমত। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখার ভিত্তিতে এ অভিমত। আমার এ ভাবনায় ভুলও থাকতে পারে। কারণ ব্যাপারটা আসলেই ক্রিটিক্যাল। এটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে পারে।

*আমার আগের লেখায় একজন মন্তব্য করেছেন, “অনেক নারী অধিকার নিয়ে সভা,সেমিনার,টকশো করে যান, খুঁজে দেখবেন, উনাদের ঘরেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বেশি উপেক্ষিত। কারণ, উনারা বাইরেই তো নারী অধিকার আদায়ে ব্যস্ত,ঘর দেখার সময় কই? আর তাদের ডেফিনেশনে মনে হয় শ্বাশুড়িরা নারী কাতারে পড়ে না।”
আমার বক্তব্য,
১। সভা,সেমিনার,টকশোতে নারীর ভূমিকা(ব্যস্ততা) কী থাকতে নেই?
২। ঘর সামলানো কী নারীর একার দায়িত্ব? (দুজনে মিলেমিশেই দেখতে পারেন। ঘর তো দুজনেরই)
৩। যে মা’কে দেখভাল করতে পারে, সে শ্বাশুরীকেও পারবে কিন্তু কথা হলো মা’কে চাইলে রাগ হয়ে দু’কথা শুনানোও যাবে, শ্বাশুরীকে পারা যাবে না। মা চেষ্টা করবেন মেয়ের সমস্যাটাকে মূল্যায়ন করতে, প্রথাগত নিয়মের কারণে শ্বশুর পক্ষের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ থাকবে না। বরং প্রথাগত নিয়মের কারণেই খুঁত ধরতে মুখিয়ে থাকবে। কাজেই বাস্তবতার নিরিখেই চলৎশক্তি হারানো মা-বাবাকে সেবার দায়টা মেয়েদের কাঁধেই থাকা যৌক্তিক। সময় বদলেছে, পারিপার্শ্বিক অবস্থাও বদলেছে। এখন মেয়েরা আবদার করে সম্পত্তিতে সম অধিকার। যৌক্তিক ভিত্তিতে যেমন এটা অন্যায় আবদার নয়, তেমনি যৌক্তিক ভিত্তিতেই দায় কাঁধে নেয়াও দায়িত্ব।

৬৭৮জন ৬১৭জন
0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ