প্রকাশিত হয়েছে প্রীণন ফারুকের প্রথম উপন্যাস ‘গোধূলির আকাশ জুড়ে রক্তিম অরুণ’ উপন্যাসটির নামকরণ নিয়েই প্রথমে একটা ধাক্কা খেলাম! গোধূলির আকাশ জুড়ে রক্তিম অরুণ কীভাবে থাকে! গোধূলি তো সূর্য অস্ত যাওয়া কালীন সময়কে বোঝায় আর অরুণ বলতে নতুন সূর্য, সকালের সূর্য অর্থেই বেশি ব্যবহৃত হয়। তাহলে কী সূর্য অস্ত যেতে ভুলে গিয়ে আবার উদয় হয়ে যাচ্ছে!
এক নিঃশ্বাসে বইটি পড়ে শেষ করার পর আমার বিস্ময় কেটে গেলো। ‘গোধূলির আকাশ জুড়ে রক্তিম অরুণ’ গ্রন্থটি আসলে কোন এক মাওলার চরের উপাখ্যান। মাওলার চরের কোন ভৌগলিক পরিচয় নেই গ্রন্থে, কিন্তু বুঝতে বাকি থাকে না, এ মাওলার চর বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া, অন্ধকারে থাকা গ্রামগুলোরই প্রতীক। যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছেনি বরং কিছু ভণ্ড ধর্মান্ধতার বেড়াজালে আবদ্ধ করে প্রজন্মকে শিক্ষার্জনে বিরত রাখতে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়। মাওলার চরের মতো শত শত গ্রাম আছে এদেশে, যেখানে বিরাজ করে ঘোর অন্ধকার। ‘অন্ধকার’ শব্দটি দিয়েই উপন্যাসটির শুরু হয়; কিন্তু শেষটা হয়েছে আলোকিত অবস্থায়।
অন্ধকারকে দূর করতে গিয়ে উপন্যাসের মুল চরিত্র রোদ্দুরের বাবার অর্ধ গলিত কাটা মুন্ডু পড়ে থাকে তাল গাছের নিচে আর মা স্বামী হত্যার রহস্য উম্মোচনে দৌড়ঝাপ করতে গিয়ে একদিন দেখা গেলো রহস্যজনকভাবে নিজ ঘরের ভেতরে রশিতে ঝুলে আছেন। বাবা যে আলোর রশ্মির সন্ধান দিয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্ম রোদ্দুরের হাত ধরে তা মাওলার চর গ্রামটিতে ছড়িয়ে পড়ে। আর তাঁর সহযোগী হিসাবে তাঁকে পথ দেখিয়ে চলে আরেক সংগ্রামী নারী সোনালী।
প্রতিক্রিয়াশীলতার ঘোর অন্ধকার থেকে একটি মাওলার চরকে আলোর পথে ধাবিত করার নিরন্তর সংগ্রাম ও চেষ্টা ফুটে উঠেছে সোনালী, রোদ্দুর, মণি, ইউসুফ প্রভৃতি চরিত্রগুলোর মাধ্যমে। হিল্লা বিয়ে বন্ধ, স্কুল প্রতিষ্ঠা, শহিদ মিনার, বৈশাখী মেলা, বাউল গানের আসর ইত্যাদির মাধ্যমে প্রগতির আলো হাতে তাদের নিরন্তর সংগ্রাম মাওলার চরের মানুষের মাঝে জাগরণ তৈরি করে। সিরাজুদ্দি, সুলু মুন্সীদের পশ্চাদপদতার বিরুদ্ধে নিয়ত সংগ্রাম করে গেছে তারা। আধুনিক শিক্ষা ও প্রগতিবিরোধী মনোভাব, ধর্মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নিয়ত এক সংগ্রামের উপন্যাস ‘গোধূলির আকাশ জুড়ে রক্তিম অরুণ’।
ধর্ম ও প্রতিক্রিয়াশীলতার সবচেয়ে বড় শিকারটির নাম নারী। ধর্মের বুলি আওড়ানো সমাজের প্রতিনিধি সিরাজুদ্দিরা রাতের আঁধার নামলে সবার অগোচরে ব্যাভিচারে মত্ত হয় আবার পরস্ত্রীতে আসক্ত এবং প্রতিশোধের নেশায় প্রগতির পক্ষে নারীর সংগ্রামকে থামিয়ে দিতে তাঁর উপর কলঙ্ক চাপিয়ে হিল্লা বিয়ের মাধ্যমে নিজের কব্জায় আনারও আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।
এ গ্রন্থে লেখক নারীর ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব ও প্রগতিশীলতাকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। একজন সোনালী, একজন মণি আবির্ভূত হয়েছে হাজার হাজার পুরুষের চেয়েও অধিক শক্তি ও ক্ষমতা নিয়ে, নিয়ন্ত্রণ করেছে পুরো মাওলার চরকে। ধর্মান্ধতা ও প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা নেতৃত্ব দিয়ে গেছে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে।
আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদেশের শ্রম বাজারে শ্রম দেয়, গ্রামে পড়ে থাকে তাদের স্ত্রী-সন্তানরা। স্বামীসঙ্গবিহীন নারীদের কঠিন জীবন ও অবাধ যৌনতার নির্মম বাস্তবতাকে অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক এ গ্রন্থে। যৌনতা জীবনের একটি অংশ। জীবনের উপস্থাপন করতে গিয়ে যৌনতারও উপস্থাপন করা হয়েছে কিন্তু কোথাও শিল্পের সীমানাকে অতিক্রম করেন নি লেখক। আবার লেখক তাঁর সুনিপুণ লেখনীশৈলীর মাধ্যমে মাওলার চরের আধারে ঢেকে থাকা রাতের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন “মাওলার চরের দিনগুলো কখনো কর্মমুখর কখনো অলস;কিন্তু মাওলার চরের রাতগুলো সবসময়ই কর্মমুখর!”
বয়ঃসন্ধিকাল নিয়েও লেখকের অসামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা উপন্যাসটিকে বিশেষ মহিমা দান করেছে। সাধারণ পাঠকের কাছে তা একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও একজন লেখক যখন লিখতে বসেন তখন নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকেই তা তুলে আনেন।
উপন্যাসের প্রধান দুটো চরিত্র সোনালী ও রোদ্দুর সম্পর্কে চাচী-ভাতিজা। কিন্তু অনাথ রোদ্দুর ও নিঃসন্তান সোনালী এক সময় পরিণত হয়ে যায় এক পবিত্র সম্পর্ক মা-ছেলেতে। কিন্তু গল্পের আকস্মিক নাটকীয়তায় ও অনিবার্য বাস্তবতায় তাদের সম্পর্কটি পুনর্নির্মিত হয়ে যায়, পরিণত হয় রক্ত-মাংসের চিরন্তন মানব-মানবীতে। উপন্যাসটি পড়লেই এ সম্পর্কের বাঁক-বদলটি উপলব্ধি করা যাবে। দলিলুদ্দির অবমাননাকর আচরণ আর সিরাজুদ্দির সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে সোনালীর এই সিদ্ধান্তটি প্রতিবাদ হিসাবেই ফুটে উঠেছে।
উপন্যাসটিতে লেখকের আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে বেশ মুন্সিয়ানা লক্ষণীয়। ময়মনসিংহের খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেছে অধিকাংশ চরিত্র। মাওলার চরের অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন প্রসঙ্গ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে। যারা গ্রামে থেকেছেন কখনো, তারা যখন গ্রন্থটি পড়বেন তখন মনে হবে এটা যেন তাদেরই গ্রামের প্রতিচ্ছবি। খুবই চেনা ও জানা এসব। লেখক তাঁর অসামান্য দক্ষতায় তা তুলে এনেছেন ‘গোধূলির আকাশ জুড়ে রক্তিম অরুণ’ গ্রন্থে। গ্রাম্য নানা কিংবদন্তি, গ্রাম্য নারীদের ঝগড়া, রাজনীতি-কূটনীতি, প্রতিক্রিয়াশীলতা, ভণ্ডামি প্রভৃতি বিষয়গুলো নিখুঁতভাবে উপন্যাসটিতে তোলে এনেছেন।
‘গোধূলির আকাশ জুড়ে রক্তিম অরুণ’ গ্রন্থটির মূল চরিত্রের নাম মাওলার চর। সিরাজুদ্দি-সুলু মুন্সীদের কারণে অন্ধকারে নিমজ্জিত মাওলার চরকে সোনালী, রোদ্দুর, মণি, ইউসুফ নামক সূর্যদের কারণে আলোকিত মাওলার চরে রূপান্তরের গল্প এ উপন্যাস। আর তাই মাওলার চরের গোধূলিতে রাত্রির অন্ধকার কড়া নাড়ে না; উদিত হয় রক্তিম অরুণ, নতুন সূর্য, নতুন ভোর, নতুন সকাল।
লেখক ও উপন্যাসটির সার্বিক সাফল্য কামনা করি।
বিঃদ্রঃ ফেসবুকে যে ক’জন বন্ধুর লিখা আমাকে মুগ্ধ করে প্রীণন ফারুক তাদের একজন। তাঁর লেখার হাত অসাধারণ! পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অনেক তীক্ষ্ণ। বিশ্লেষণী ক্ষমতাও অনেক নিখুঁত। আরো একটি বিষয় হলো তাঁর ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে অনেক অপ্রিয় সত্যও বেরিয়ে আসে। আলোচ্য উপন্যাসটিতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। “গোধূলির আকাশ জুড়ে রক্তিম অরুণ” তাঁর প্রথম উপন্যাস। কিন্তু উপন্যাসটি পড়তে নিলে মনেই হবে না এটি তাঁর প্রথম উপন্যাস।
অসাধারন এই উপন্যাসটি পাওয়া যাবে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়।
স্টল-দাঁড়কাক
লিটল ম্যাগ চত্ত্বর
ঘরে বসে পেতে বিকাশ নম্বর : ০১৭১৭ ৭১৪৮০৪
১৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
সংক্ষেপে পড়লাম উপন্যাসটি আপনার মাধ্যমে
বই রিভিউ তো ভালোই লিখতে পারেন
নিজের পড়া বিভিন্ন বই নিয়ে রিভিউ আশা করছি আপনার কাছে।
বই মেলায় গেলে বইটি কেনার আশা আছে।
লেখক ও উপন্যাসটির সার্বিক সাফল্য কামনা করি -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
কিছু কিছু উপন্যাস আছে, এখনো হাতের কাছে পেলে গোগ্রাসে গিলতে বসে যাই। এই উপন্যাসটি পড়তে শুরু করে তেমন করেই মুগ্ধতা ভর করে। আর পড়া শেষ করেই ভাবলাম আমার প্রিয় প্রাঙ্গণ ‘সোনেলা’র আঙিনায় সকল বন্ধুদের সাথে শেয়ার করি।
ধন্যবাদ প্রশংসা করার জন্য।
জিসান শা ইকরাম
শেয়ার না করলে এত ভালো একটি উপন্যাস এর কথা অজানাই থেকে যেতো।
নীলাঞ্জনা নীলা
বইটি তো ইচ্ছে করছে পড়তে। আমার নতূন লেখক-লেখিকাদের লেখা টানে।
কিভাবে পাওয়া যেতে পারে?
আর বেশ লিখেছেন কিন্তু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
কিভাবে পেতে পারেন তাতো বুঝতে পারছি না। আপনি তো থাকেন দেশের বাইরে!
অনেক ধন্যবাদ।
নীলাঞ্জনা নীলা
সেটাই অনেক বই পড়তে চাইলেও পারিনা।
অনিকেত নন্দিনী
রুবাপু দেখছি বইয়ের রিভিউ খুব চমৎকার করে লিখতে পারেন! রিভিউর গুণে প্রত্যেকটা চরিত্র যেন জলজ্যান্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
এমন আরো রিভিউ আশা করছি। 🙂
বইটির জন্য শুভকামনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
উপন্যাসটি পড়েছি মুগ্ধতা নিয়ে। মাওলারচরে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে প্রগতির যাত্রায় উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে। একজন লেখক তাঁর প্রথম উপন্যাসেই এমন চমৎকার লিখতে পারেন, না পড়লে বুঝা যেতো না।
বইটির জন্য আমারও শুভকামনা রইলো।
অরুনি মায়া
চমৎকার রিভিউ | কেন যেন লাল শালুর কথা মনে পড়ে গেল |
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক বলেছেন। লালসালু’র মজিদ আর আলোচ্য উপন্যাসের সিরাজুদ্দি-সুলুমুন্সিরা ধর্মীয় লেবাসের আড়ালেই ভণ্ডামি করে যায়।
খসড়া
বইয়ের রিভিউ কিভাবে এত সুন্দর করে লেখেন। সেই ছোট বেলা থেকেই গল্পের সারমর্ম আমাকে দিয়ে লেখা হয় না।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
লিখতে বসলে কখনো কখনো অনেক লিখা হয়ে যায়, আবার কখনো হাজার চেষ্টা করেও দু’লাইন লিখা যায় না। আমার অনেক লিখা দেখা যায় মন্তব্য করতে গেছি আরেকজনের লিখায় কিন্তু লিখতে গিয়ে বড় বিশাল আকার ধারণ করায় নিজেই পরে একটি পোস্ট দিয়ে ফেলি।
এই উপন্যাসটা মূলত পড়ার পরই প্রতিক্রিয়া লিখার নেশা মাথায় চাপে। ভালো লেগেছে সেজন্যে ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
বাহ্ এমন রিভিউ পড়লে বই না পড়ে থাকা যায়? অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। বিষয় নির্বাচন আর সম্পর্কের আস্তে আস্তে রদবদল আগ্রহ জন্মালো বেশ।
বইটির প্রকাশ স্বার্থক হোক, লেখকের জন্য শুভকামনা থাকলো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, বিষয় নির্বাচনটা আমার বেশ লেগেছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, উপন্যাসটি হাতে নিলে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার নেশা জাগে। ঘটনার প্রতিটি বাঁক পাঠকমনে শিহরণ তৈরি করে।
আর সম্পর্কের বাঁক বদল আমার কাছে মনে হয়েছে নারী চরিত্র নিয়ে পুরুষের খামখেয়ালিপনার বিরোদ্ধে চপেটাঘাত, যা দলিলুদ্দি-সিরাজুদ্দির প্রাপ্য ছিলো।
প্রথম প্রকাশেই এমন তীক্ষ্ণ উপস্থাপন অবশ্যই শুভকামনা রইলো।