সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা । তার উপর রাস্তায় গাড়ী-ঘোড়াও কম । এইরকম একটা সকালে হাবিব রিকশায় অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে । নানান ঝামেলা, চিন্তা মাথায় থাকা সত্ত্বেও সে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই অফিস যাচ্ছে । আকাশের মেঘ দেখে এমনকি বর্ষার কিছু গানের লাইনও তার মাথায় গুণ গুণ করছে । অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এমন সময় হাবিব দেখল রাস্তায় একটা পাখির বাচ্চা পড়ে অসহায় ভাবে চিৎকার করছে । সে তার রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল । তারপর পাখিটাকে হাতে তুলে নিয়ে কি করবে তা নিয়ে ভাবতে লাগলো । আশে পাশের গাছ গুলোতে উঁকি-ঝুকি দিয়েও সে কোনও পাখির বাসা দেখতে পেলনা । পাখিটাকে অফিসে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কিনা এ নিয়ে কিছুক্ষন দোটানায় ভুগে শেষ পর্যন্ত আপাতত অফিসে নিয়ে যাওয়াই ঠিক করল ।
অফিসে পৌঁছানোর পর হাতে পাখির ছানা দেখে সহকর্মী শামিম বেশ অবাক হয়েই জানতে চাইল, কি ব্যাপার হাবিব ভাই, পাখির বাচ্চা কেন হাতে? হাবিব বেশ বিব্রত হয়েই বলল, না, মানে ইয়ে, রাস্তায় পড়ে ছিল । ভাবলাম কখন গাড়ীর নিচে চাপা পড়ে মারা যায় । তাই নিয়ে এসেছি । কিন্তু এখন কি করব বুঝতে পারছিনা । শামিম পরামর্শ দিল, এক কাজ করেন, কিচেনের পাশে যে বারান্দাটা আছে, ওখানে রেখে দেন । পিওনকে বলে দিলে আপাতত তারা দেখে রাখবে । পরে ভেবে দেখা যাবে কি করা যায় । হাবিবের পরামর্শটা বেশ মনে ধরল । সে কিচেনে গিয়ে পিওন আলমকে ডেকে বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে । কিছু ঝুট কাগজ দিয়ে একরকম একটা পাখির বাসাও বানিয়ে দিল হাবিব নিজেই । তারপর নিজের ডেস্কে এসে কাজে ডুবে গেল ।
দুপুরে কিচেনে খেতে এসেই তার আবার মনে পড়লো পাখিটার কথা । ভাবল, ইশ! পাখিটার তো কিছুই খাওয়া হয়নি । পাখি কি খায়, তাও তো সে জানেনা । নিজের প্লেট থেকে কিছু সাদা ভাত নিয়ে একটা বাতিল বাটিতে করে পাখির ছানাটাকে দিল । একটু ইতস্তত করে পাখিটা তা ঠুকরে ঠুকরে খাওয়া শুরু করল । পাখিটার খাওয়া দেখে হাবিব একটু চিন্তামুক্ত হল । সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরুবার আগে পিওন আলমকে রাজি করাল পাখিটাকে বারান্দাতেই রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করতে । কি না কি ভেবে বসে, এই ভয়ে বাসায় ফিরে স্ত্রী-কন্যাকেও হাবিব কিছুই জানালো না পাখিটার ব্যাপারে ।
এরপর দিন গড়ায়, অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাবিবের সময় কাটে পাখিটাকে নিয়ে । আলমেরও বেশ মায়া পড়ে যায় পাখিটার উপর । আলম যেহেতু রাত্রে অফিসে থাকে, সেহেতু পাখির রাতের খাওয়াটা সেই তো দেখভাল করে । পাখিটার ভাবনা হাবিবের চিন্তা জুড়ে প্রায়ই থাকে । অনেক সময় রাত্রে ঝড়-বৃষ্টি হলে হাবিব আলমকে ফোন করে বলে পাখিটাকে ভেতরে নিয়ে রাখতে, আলম হেসে উত্তর দেয়, “স্যার, আপনে কওয়ার আগেই আমি পাখিডারে ভিতরে আইন্না রাখসি” । আলম স্বাস্তির নিঃশ্বাস ফেলে । মাঝে মাঝে হাবিব পাখিটাকে উড়ানোর চেষ্টা করে । পাখি বাতাসে ভাসতে পারে কি পারেনা ।
এভাবেই পাখি নিয়ে হাবিবের দিন কাটে । একদিন পিওন আলম হন্তদন্ত হয়ে হাবিবের ডেস্কের পাশে এসে উত্তেজিত স্বরে বলে “স্যার, পাখিডা উড়তাসে, দেইখা যান………!” হাবিব দৌড়ে যায় । দেখে পাখি কিচেনের এক কোন থেকে অন্য কোনে ওড়া-উড়ি করছে । হাবিবের কেন জানি কান্না পায় । হাবিব হাত বাড়াতেই, পাখিটা হাবিবের হাতে এসে বসে । হাবিব পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় পাখির গায়ে । সেই দিন দুপুরে হাবিব কিচেনে গিয়ে পাখিটাকে হাতে নেয়, তারপর নয়তলার জানালা গলিয়ে পাখিটাকে উড়িয়ে দেয় আকাশে । পাখি একটু উড়ে আবার এসে বসে হাবিবের হাতে । কান্না চাপতে চাপতে হাবিব আবারও উড়িয়ে দেয় পাখিটাকে । পশুপাখির চোখে কোনও আবেগ দেখা যায়না । কিন্তু হাবিবের স্পষ্ট মনে হয়, পাখিটা একরকম আহত বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে উড়ে যায় আকাশে । সেইদিন মন খুব খারাপ হয়ে থাকে হাবিবের । বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আগেই অফিস থেকে বাসায় ফিরে যায় সে ।
পরদিন সাপ্তাহিক ছুটি । এই দিনগুলোতে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে জাগে হাবিব । কিন্তু সেদিন খুব ভোরে হাবিবের তিন বছরের মেয়ে সুপ্তি কন্ঠে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে তাকে জাগিয়ে তোলে । বলতে থাকে “বাবা! বাবা! দেখ একটা পাখি জানালায় বসে আছে !” হাবিব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে তার পাখি বসে আছে জানালায় । হাবিব বুঝে পায়না কিভাবে পাখিটা তার বাসা চিনে এল, কখন থেকেই বা বসে আছে জানালায় । সব ভাবনা একপাশে সরিয়ে জানালা খুলে দিতেই পাখি এসে হাবিবের হাতে বসে । সুপ্তির এইটুকু জীবনে এর থেকে অবাক করা আর কিছুই ঘটেনি । সুপ্তি পাখিটাকে একটু ছুঁতে চায় । হাবিব পাখিকে সুপ্তির হাতে দেয় । নিষ্পাপ মানব সন্তানের হাতে হাবিব দেখতে থাকে নিষ্পাপ পাখিকে আর চোখের পানি লুকাতে লুকাতে ভাবে “পাখির ভালবাসার কাছে আজ হেরে গেল মানুষের ভালবাসা………………!”
২০টি মন্তব্য
শিশির কনা
অসাধারণ লাগলো ভাই । পশু পাখির প্রতি মমতা তাঁরাই দেখাতে পারেন , যাদের অন্তরটা ভীষন রকমের নরম । খুব ভালো লেগেছে ভাই।
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ 🙂
জিসান শা ইকরাম
স্বাগতম সোনেলায় -{@
পাখিকে নিয়ে সুন্দর গল্প এবং গল্পের মাঝে উচ্চারিত কিছু মুল্যবান কথা অনেক ভালো লাগলো ।
সোনেলা সমৃদ্ধ হবে আপনার মুল্যবান লেখায় – এটি নিশ্চিত।
শুভ কামনা ।
বোকা মানুষ
আমাকে সোনেলায় যোগ দিতে অনুপ্রানিত করার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
খসড়া
পাখি রে তুই রইলি খাঁচায় বন্দী
শিরনাম ও গল্প দুটো ই অসম্ভব সুন্দর।
বোকা মানুষ
অনেক ধন্যবাদ 🙂
আদিব আদ্নান
জ্যান্তব অনুভুতি নিয়ে প্রথমেই সুন্দর লেখার জন্য অনেক
ধন্যবাদ ।
পাখিদের ভালবাসার কাছে আমরা অনেক সময়ই হেরে যাই ।
বোকা মানুষ
সুন্দর কমেন্টের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ 🙂
মিথুন
অসাধারন লেখা ভাইয়া।। অজানা এক পাখির প্রতি মায়া পরে গেলো।।
বোকা মানুষ
পাখিটা আমারও অজানা ছিল। অফিসে আসার পথে একজন মানুষকে রাস্তায় পরে থাকা পাখির ছানা তুলে নিতে দেখে ভাবনাটা মাথায় এসেছিল। ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
লীলাবতী
মায়া যে কখন কিসে লেগে যায় বলা কঠিন । পাখিটি ঠিকই খুজে চলে এসেছে তার প্রিয় মায়াময় স্থানে । সুন্দর গল্পের জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া ।
বোকা মানুষ
অবোধ পাখি আর পশুরাই ফিরে ফিরে আসে ভালবাসার কাছে, বুদ্ধিমান মানুষ কি আসে!? 🙁 ধন্যবাদ
নীহারিকা
জীবে দয়া করে যেই জন
সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
…… খুব ভালো লেগেছে আপনার লেখা।
বোকা মানুষ
ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। ধন্যবাদ 🙂
মা মাটি দেশ
একদম অসাধারন গল্প।মানুষের মাঝে ভালবাসা যে ভাবে দিন দিন ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে তাতে ভালবাসা বলে কিছু নেই আছে ভাঙ্গা বাসা।কিন্তু পাখিরা এখনও তার আপন মনে সেই সুর তুলে মানব জাতিকে বুঝিয়ে দেয় ভালবাসা এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
বোকা মানুষ
ঠিক তাই। তবে মানুষের মধ্যেও ভালবাসা আছে। না থাকলে কি পাখিটা পেত ওই আশ্রয়! প্রত্যেকটা মানুষই ভালবাসা দিতে ও নিতে পারে এবং চায়ও। কিন্তু ওই দেয়া নেয়ার জন্য ঠিক মানুষটা খুঁজে পায়না বলেই যত গোল বাঁধে। গল্পটা ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। ধন্যবাদ।
প্রজন্ম ৭১
অসাধারণ । শেখার আছে অনেক কিছু ।
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ আপনাকে। আপনাদের ভাল লাগা অনুপ্রেরণা যোগাবে।
রাইসুল জজ্
ভালো হয়ছে । চালিয়ে যান ।
বোকা মানুষ
অনুপ্রাণিত করার জন্য ধন্যবাদ 🙂