পরিবার এবং সিদ্ধান্ত …..

মুহাম্মদ আরিফ হোসাইন ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুধবার, ০৭:৪০:৫২অপরাহ্ন গল্প ২৬ মন্তব্য

রাত শেষ হওয়ার পূর্বেই ফোন আসলো। প্রেমের ফাঁদে পড়া সেই মেয়েটার ফোন। যাকে বলা হয়েছিলো -তোমাকে আজকের রাত সময় দিলাম। আমাকে ভালোবাসার বলে তুমি পরিবার ছাড়তে পারবা কিনা সিদ্ধান্ত নিবা। নাহলে কাল থেকে আমার সাথে আর তোমার কোন সম্পর্ক থাকবে না।

‘এই কঠিন কথাগুলো যে বলেছে তার নাম আবির। গায়ের রং ফর্সা, লম্বাটে। এক কথায় গুড লুকের অধিকারী। ফেসবুকে তার একটা ফেক আইডি আছে। আইডির নাম লাভার বয়। স্কুল জীবন থেকেই সে খেলা বিমুখ। তবে একটি খেলা সে খুব ভালো খেলে। আর সেটা লাভ লাভ খেলা।’

আবির ফোনের দিকে তাকিয়ে একটি মুছকি হাসি দিলো। এই হাসি বিজয়ের হাসি। এই হাসিতে লেখা থাকে অন্যের সর্বনাশ।
– হ্যালো…
– আবির আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।
– অবশ্যই বলবে। তারআগে বলো তোমার জবাব কি। হ্যাঁ নাকি না?
– আমি যে কথাগুলা বলবো তার ভিতর থেকেই তুমি উত্তর পেয়ে যাবে।

আবির একটু চিন্তায় পড়ে গেল। তার সিক্স সেন্স বলছে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। নীরা কখনো এমন গম্ভীর স্বরে কথা বলে না।

– আচ্ছা বলো শুনি তোমার কথা।
– আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা যেমন সত্য তারচেয়েও কঠিন সত্য হলো আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। আমার মাকে ভালোবাসি। বাবাকে ভালোবাসি।
– অবশ্যই বাসো। ভালোবাসতে তো আমি নিষেধ করি নি।
– যাকে ভালোবাসা হয় তাকে কখনো কষ্ট দিতে হয় না। আমি তোমাকে ভালোবাসি আবার পরিবারকেও ভালোবাসি। আমার গড়ে উঠার পিছনে আমার পরিবারের অবদানটাই সবচেয়ে বেশি।
– আচ্ছা।
– তোমার প্রস্তাবটা আমি অনেক ভেবে দেখেছি। তোমার সাথে আমার পরিচয় /সম্পর্ক ১ বছরের। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। আবার আমার পরিবারকেও হারাতে চাই না।
– দুটা তো এক সাথে পাওয়া যাবে না।
– আমার তো এখনো বিয়ের বয়স হয় নি। তাহলে কেন পালাবো!!
– কারন আমি চাই তুমি আমার পাশে পাশে থাকবে। আমার চোখের সামনে। আমার চারপাশ জুড়ে থাকবে তোমার গন্ধ। যে গন্ধে আমি মাতাল হয়ে থাকবো।
– কিন্তু…
– কোন কিন্তু না। আচ্ছা তোমাকে দুপুর পর্যন্ত সময় দিলাম। ফাইনাল সিদ্ধান্ত নাও।
– আচ্ছা।

দরজার ওপাশ থেকে দাঁড়িয়ে মেয়ের সব কথা শুনেছেন শাহেলা। তিনি মেয়েকে কিছু বলেন নি। গিয়ে তার স্বামীকে বিষয়টা জানালেন। মতিন সাহেব অনেক ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। তিনি শান্ত গলায় বললেন তুমি এখন ঘুমাও। সকালে দেখবো বিষয়টা। শাহেলা একটু ঘ্যানঘ্যান করলেও ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালে মতিন সাহেব মেয়ের রুমে গেলেন। তিনি এক পলকে মেয়েকে দেখে নিলেন। নীরার চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। চেহারায় গভীর চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট।

– বাবা তুমি এখানে?
– হুম। এলাম।
– কিছু বলবে?
– না। তোকে দেখতে এলাম। পড়াশোনার কি খবর?
– ভালোই।
– তুই কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত?
– উমমম…. না।
– কিন্তু আমি যে তোর চেহারা দেখে মনের খবর পড়তে পারছি।
– কি বলছো? কি পড়তো পারো বলো তো।
– তুই একটা গভীর চিন্তায় আছিস। চিন্তাটা আমাকে নিয়ে। আমি হার্টের রোগী। তুই কোন এক অজানাতে হারানোর সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছিস। কিন্তু পারছিস না। যদি আমার কিছু হয়ে যায়। তারপরই ভাবনাটা তোর মাকে নিয়ে। তোর মায়ের কি হবে! যে তোকে এত আদর যত্নে কোলে পিঠে করে মানুষ করছে। তারপর তোর আদরের ছোট ভাইটা। যে তোকে ছাড়া কিছু বোঝে না। তার কি অবস্থা হবে। এসব ভেবে ভেবে তোর পেশার বেড়ে গেছে। চোখের নীচে কালচে দাগ পড়েছে।

নীরা হা করে তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাকি সত্যিই মনের খবর পড়তে পারে? সে চিন্তা করছিলো ঠিক। কিন্তু এমনভাবে চিন্তা করে নি। বাবা যে হার্টের রোগী। বাবার কিছু হলে মায়ের কি হবে? ছোট ভাইটা! যে আমাকে না পেলে কিছু খায়ই না। তার কি হবে!!

– বাবা?
– বল মা।
– আমি কি সত্যিই কোন ভুল করছি?
– শোন মা, পৃথিবীতে নানানরকম মানুষ আছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ মানুষ হলো যারা অন্যের ইচ্ছা, পছন্দ, অপছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের পছন্দ, অপছন্দ চাপিয়ে দেয় ব্লেকমেইল করে। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার দুইটা বোধ কাজ করে। ভালোবাসাবোধ আর অভিমান বোধ। এছাড়া কোন সেন্স সঠিকভাবে কাজ করে না। তোর চিন্তার বিষয়টা আমাকে খুলে বল।
– বাবা আমি আবির ছেলেটাকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। সে বলছে আমি যেন তারকাছে চলে যাই।তার চারপাশ সে আমাকে দেখতে চায়।
– ছেলে কি করে?
– একটা অফিসে জব করে।
– কিসের অফিস?
– তা জানি না।
– ছেলের বাবা মা কে কি করে? কোথায় থাকে?
– জিজ্ঞেস করেছিলাম বলে নি।
– সে কেমন কথা!! ছেলের বন্ধু বান্ধবদের জিজ্ঞেস করিস নাই?
– ওর কোন বন্ধু বান্ধব নেই।

মতিন সাহেব ব্রু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকালেন। কত সাধাসিধা একটা মেয়ে। প্রেম পিরিতির এই এক সমস্যা বিবেচনাবোধ নষ্ট হয়ে যায়। মেয়েটা একটা ফ্রডের খপ্পরে পড়েছে আর মেয়েটা এখনো তা বুঝতেই পারছে না।

শোন মা নীরা, তোকে কিছু বিষয় আমি বলে দিচ্ছি।
১. তুই যে ছেলের কথা বলছিস। তাকে তুই নিজেই ঠিকমতো চিনিস না।

২. ছেলের মতলব খুব একটা ভালো না। আমি এখানে কোন ভালোবাসা দেখছি না মা।
– হয় ছেলে তোর সাথে কোন খারাপ কাজ করতে চাচ্ছে।

– কিংবা ছেলে তোকে ঘর ছাড়া করে অন্য কোথাও বিক্রি করে দিতে পারে। তুই সুন্দর একটা মেয়ে। তোকে খারাপ উদ্দেশ্য খুব সহজেই ব্যবহার করা যাবে।

– অথবা ছেলেটা সাইকোটাইপ কিছু। যে অন্যের সর্বনাশ করে পৈশাচিক তৃপ্তি পায়।

৩. তুই আমার আদরের মেয়ে। তোর সম্পর্ক যদি ঠিকঠাক হতো আমি নিজেই তোর বিয়ে দিতাম। কিন্তু এখানে কোন কিছুই ঠিক না। তুই বরং আরেকটু ভেবে দেখ।

মতিন সাহেব রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। নীরা বাবার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আয়নায় নিজেকে তার দেখতে ইচ্ছে করছে। নিজের সাথে কথা বলার জন্য আয়নাই সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
– আচ্ছা আমি কি ভুল কিছু করতে যাচ্ছি?
– জানি না।
– তোমাকে জানতে হবে। বলো কে তোমার সবচেয়ে আপন? নিজেকে লুকিয়ে রাখা আবির নাকি উদারহৃদয়ের অধিকারী বাবা।
– জানি না।
– তোমাকে জানতে হবে। আবির কেন এই পাগলামি করছে? তার উদ্দেশ্য কি?
– জানি না। তবে তুমি ভুল করছো।

মানুষ যখন নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে এবং একজন বিবেকবানের কাছ থেকে গাইড পায় কি প্রশ্ন করা উচিৎ তখন তার কাছে সত্য মিথ্যা, ভুল করছি নাকি ঠিক করছি তা ক্লিয়ার হয়ে যায়।

নীরার কাছেও ক্লিয়ার হয়ে গেছে। আবির তাকে ঠিক ভালোবাসে না। তাকে নিয়ে খারাপ কিছু একটা করার ধান্ধায় আছে। আর সেটা আবিরকে কিছু প্রশ্ন করলেই ক্লিয়ার হবে যাবে। নীরা আবিরকে ফোন দিলো।
– হ্যালো……?
– আবির তোমাকে আমি ক্লিয়ার করে একটা প্রশ্ন করছি উত্তর দাও।
– কি প্রশ্ন?
– তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?
– বাসি।
– তাহলে তুমি তোমার বাবা মাকে নিয়ে আমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসো। আমি বাবার সাথে কথা বলেছি। তিনি বিয়ে দিবেন।
– বিয়ে?!
– হুম। বিয়ে। অবাক হলে যেন!!!
– না।
-তাহলে? কখন আসছো?
– আচ্ছা, আমি তোমাকে জানাবো।
– আমি। অপেক্ষায় রইবো।

আবিরের মন কু করে উঠলো। শিকার হাত ছাড়া হয়ে গেছে। দাবার গুটি অসময়ে চাললে যেমন ধরা খেতে হয় তেমনি অবস্থা হয়ে গেছে। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করলে হয়তো এমন হতো না। তবে আবির তা নিয়ে চিন্তিত না। একটা শিকার মিস হয়েছে তো কি হয়েছে। সবাইকে সঠিক পরামর্শ দেয়ার কেউ থাকে। এই সমাজে আরো অপরিপক্ক নীরা আছে। তাদের সাথে লাভ লাভ খেলাটা জমে উঠবে।

নীরা গিয়ে তার বাবার পাশে বসলো। মতিন সাহেব নীরার দিকে তাকালো। তার চোখমুখ থেকে চিন্তার সে ছাপটা কেঁটে গেছে। সঠিক সিন্ধান্ত নিয়েছে নীরা। সাপ ও মরলো লাঠিও ভাংলো না।

৮৭৮জন ৮৭৮জন
0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ