IMG_20160825_130224

এক সময় ডিভি লটারি নিয়ে এদেশের মানুষ লুটোপুটি খেতো। হুড়োহুড়িতে ফটোস্ট্যাট মেশিনের দোকান আর ফটো ল্যাবগুলো সবসময় বুদ হয়ে থাকতো। তখন আমি পড়াশুনা করছি। সবাইকে দেখতাম প্রতিবছর আবেদনের তারিখ ঘোষনা হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়তো আবেদন করার জন্য। হায়রে, কি অবস্থা চারদিকে! আজকাল মনে হয় সেরকম নেশা কাজ করে না মানুষের মধ্যে।

যাহোক, আমার ছিলো এ ব্যাপারে প্রচণ্ড অনাগ্রহ। প্রতি বছরই অবাক হয়ে দেখতাম মানুষের মাঝে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পাড়ি দেয়ার জন্য কী প্রাণান্তকর চেষ্টা। আমি কেনো যেনো এমনটা চিন্তাই করতে পারতাম না। না, খুব যে দেশপ্রীতি ছিলো তখন তা নয়, কিন্তু অবচেতন মনেই দেশের প্রতি একটা টান অনুভব করতাম। ভাবতাম, নিজের দেশ ছেড়ে ক্যামনে মানুষ অন্যদেশে যাওয়ার জন্য এমন পাগল হয়ে উঠে! মাঝেমধ্যে আত্মীয় পরিজন কারো বিদেশী ছেলের সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে শুনেও এমনটাই মনে হতো। অথচ যাদের ঘরের কন্যাটির এমন বিদেশি ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হতো, তাদের ভাবই ছিলো অন্যরকম। যেনো টাকার খনি আর সুখের রাজ্যের ঠিকানা পেয়েছে। আর হবুবধু মেয়েগুলার মধ্যেও সে কী ভাব!! খুবই আশ্চর্য হয়ে এগুলো অবলোকন করতাম। যাক গিয়ে, ধান ভানতে শীবের গীত গেয়ে লাভ নেই।

বলছিলাম ডিভি লটারির কথা। এরপরও কেনো যেনো একবার ডিভি লটারির জন্য আবেদন করা হয়েই গিয়েছিলো। তখন সবে বিয়ে হয়েছে। ছাত্রাবস্থায় ঘরকুনো ছিলাম না। ঘরে বাইরে সমানে দাপিয়ে বেড়াতাম। যার দরুন বন্ধু বান্ধবও ছিলো প্রচুর। একটু বেশি ঘনিষ্ঠগুলো বাসায় প্রায়ই যাওয়াআসা করতো। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে আমার ছেলেমেয়ে বলে আলাদা কিছু ছিলো না। বিয়ের পরেও যখন ঢাকা চলে আসি, আমার ছোট্ট বাড়িতে, অফিসে তাদের কারো কারো আনাগোনা ছিলো খুব। কেবলই স্টুডেন্ট লাইফ ছেড়ে এসেছি। এমনিভাবে এক সন্ধ্যায় ওরা ৩/৪ জন এসেছে আমার বাসায়। গল্প, আড্ডা এর মাঝে প্রসঙ্গ ডিভি লটারি। ওদেরই একটার পাল্লায় পড়ে ফরম ফিল আপ করে জমা দেই। বাদ বাকি সব কাজ সেরেছে ওরাই। এই খবর একসময় আমার ভাইবোনদের কাছেও চলে যায়।

একদিন অফিসে পোস্টম্যান একটি খাম দিয়ে যায় আমার নামে। খামটা অন্য রকম। তখন চিঠির যুগ ছিলো আর বেশিরভাগ চিঠিই আসতো কুরিয়ারে। ডাক বিভাগের মাধ্যমেও আসতো। একটু অন্যরকম খামে করে আসা চিঠিখানি পোস্টম্যান দিতে দিতে বললো “ম্যাডাম, আমেরিকা থেকে আপনার চিঠি এসেছে।” তখনও মাথায় আসেনি যে আমি ডিভি লটারির আবেদন করেছি। অফিসে বসও উপস্থিত ছিলেন। আমেরিকা থেকে এসেছে শুনে খামের লিখা আমার আগে তিনিই পড়েন। পড়েই তিনি বললেন, তোমার তো কপাল খুলে গেছে। খুলে দেখো, আমেরিকার ইমিগ্রান্ট অফিস থেকে এসেছে। আমার খুব মনে পড়ছে, শুনে আমি স্থির হয়ে গিয়েছিলাম। ক্ষণিকের জন্য হলেও খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ডিভি লটারি সংক্রান্ত চিঠি বুঝতে পেরে কলিগরাই খুলে নেয় দেখার জন্য। পুরোটা পড়ে বস সহাস্যে বললেন, আমেরিকান মানুষ হয়ে যাচ্ছো তুমি। তাড়াতাড়ি বাকি কাগজগুলো যোগাড় করো। এসব কাজে দেরি করতে নেই। আমি সমানে কাঁদছি। কেউ বুঝতে পারছে না কেনো কাঁদছি। অনেকেই ভাবছে খুশিতে। পাশের অফিস থেকেও লোক চলে আসে ডিভি লটারি জিতেওয়ালীরে একনজর দেখতে। এদিকে আমি টের পাচ্ছি আমার পায়ের নিচ থেকে ক্রমশঃ মাটি সরে যাচ্ছে। আমার আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। কিছুতেই মানতে পারছিলাম না, নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও আমাকে যেতে হবে। নুন-ভাত খেয়ে থাকবো, তবুও এ মাটি ছেড়ে যাবো না।

হায়! আমাকে তখন সঙ এর মতো সবাই খুব করে দেখছিলো। আহা! কি ভাগ্যটাই না মেয়েটার, ডিভি লটারি জিতে গেছে! একসময় মুখ ফস্কে আমার বেরিয়ে এলো, “না, যাবো না আমি আমার দেশ ছেড়ে।” সেদিন শরীরের প্রতিটা রক্তকণা আমার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে চেয়েছে। অফিসের সকলেই আমাকে বুঝাতে লাগলো, পাগলামি করো না। এ ভাগ্য সবার হয় না। খবরটা বাতাসের বেগে শাখাঅফিস থেকে হেড অফিসেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। একসময় বাড়িতেও জানাই। যদিও বিদেশ ব্যাপারটাতে আমার পরিবারেরও অনাগ্রহ তবু তারা খুব খুশি না হলেও আমার টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন যেনো তাদের মাঝেও একটু স্বস্তিই এনে দিয়েছিলো। কিন্তু আমি? কিংকর্তব্যবিমূঢ়!!!

ঠিক, দুদিন পরে একইরকম খাম আসে আমার মেজোবোনের নামে। ব্যাপারটা কি?
তারপরই জানতে পারি, এই পুরো ঘটনার পিছনে কাজ করেছে আমার ভাই, যেটি বর্তমানে ব্যাংকে কর্মরত। সে যখন শুনেছে আমি ডিভি লটারিতে আবেদন করেছি, তখনই বাঁদরামির চিন্তাটা তার মাথায় চেপেছিলো। যে ব্যাপারটায় আমার প্রচণ্ড অনাগ্রহ, সেটাই করেছি শুনেই তার এই কর্ম। তার কারিগরিতেই আমি সেদিন নিজের আমিত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম আর অদ্ভুতভাবে উপলব্ধি করেছিলাম ‘দেশাত্মবোধ’ কি জিনিস!

আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ
তোমার বাতাস
আমার প্রানে
ওমা আমার প্রানে বাজায় বাঁশি
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি

ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে
মরি হায়
হায় রে ওমা
ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে
ওমা অগ্রানে তোর ভরা খেতে
কি দেখেছি
আমি কি দেখেছি মধুর হাসি
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোভাসি

কি শোভা কি ছায়া গো
কি স্নেহ কি মায়া গো
কি আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে
নদীর কূলে কূলে

মা তোর মুখের বানী
আমার কানে লাগে সুধার মতো
মরি হায় , হায় রে মা তোর
মুখের বানী
আমার কানে লাগে সুধার মতো

মা তোর বদন খানি মলিন হলে
আমি নয়ন
ওমা আমি নয়ন জ্বলে ভাসি
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি ।

IMG_20160825_131750

স্কুল জীবনে দীর্ঘ ১০টি বছর প্রতিদিন স্কুল শুরুর আগে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে পিটি করার সময় জাতীয় পতাকার সামনে দুহাত পায়ের সাথে চেপে ধরে দুপায়ের মাঝে চারআঙ্গুল ফাঁক রেখে সটান সামনের দিকে তাকিয়ে হেড়ে গলায় জাতীয় সঙ্গীত গাইতাম। জানতাম এটাই নিয়ম। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার নিয়ম। এই নিয়মের কারণ অনুসন্ধানেই হয়তো কোমল মনে দেশ নিয়ে কতো ছবি এঁকেছি। সম্ভবত তখন থেকেই অবচেতন মনে একটা বোধের জন্ম হয়ে গিয়েছিলো। আর সেই বোধই আমার সারা জীবন চলার পথের পাথেয়।

Shonar-bangla-0320131216171901

২০১৪ সালে তাই সেই টান থেকেই ছুটে গিয়েছিলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে।

৭৮২জন ৭৮২জন
0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ