
গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, গতরাতে দেখা তাজমহলের রঙ বদলানোর বিষয়টি। জবাবে ও বললো, এর কারণ তাজমহলের ভিন্নমাত্রার টাইলসের কারণেই এমন প্রতিচ্ছবি হয়, এছাড়া সূর্যের অস্তাচলের সময়েও তাজের চেহেরা লালাভ ও কখনো সোনালি হয়ে উঠে (ফিচার ছবি দ্রষ্টব্য) ।
আমরা অবাক হলাম কথাটি শুনে।
গাইড বলছে এই তাজমহল গড়ার অনেক করুন কাহিনী আছে, এই তাজমহল তৈরির জন্য সকল টাইলস ও মূল্যবান রঙ্গিন পাথর সাড়া এশিয়া এবং ভারত থেকে আনা বিভিন্ন উপাদান সামগ্রী দিয়ে, নির্মাণ কাজের সময় ১,০০০ এরও বেশি হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল নির্মাণ সামগ্রী বহন করে আনার জন্য। আলো-প্রবাহী অস্বচ্ছ সাদা মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে, লাল, হলুদ বা বাদামী রঙের মধ্যম মানের পাথর আনা হয়েছেল পাঞ্জাব থেকে।
চীন থেকে আনা হয়েছিল কঠিন, সাধা, সবুজ পাথর, স্ফটিক টুকরা। তিব্বত থেকে বৈদূর্য সবুজ-নীলাভ (ফিরোজা) রঙের রত্ন এবং আফগানিস্তান থেকে নীলকান্তমণি আনা হয়েছিল। নীলমণি- উজ্জ্বল নীল রত্ন এসেছিল শ্রীলঙ্কা এবং রক্তিমাভাব, খয়েরি বা সাদা রঙের মূল্যবান পাথর এসেছিল আরব থেকে।
এ আটাশ ধরনের মহামূল্যবান পাথর সাদা মার্বেল পাথরেরে উপর বসানো রয়েছে।
এই তাজমহল গড়ার আসল কারিগর দিল্লি, আগ্রা, ইরান সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয়েছিলো, যাদের কাজ শেষে সকলের হাতের আঙ্গুল কর্তন করা হয়েছিলো যেন আরেকটি তাজমহল সৃষ্টি যেন করা না যায়।
তাজমহলের ভিতরের প্রবেশ পথের কারুকার্য।
তাজমহল গড়তে ততকালীন আনুমানিক ৩২ মিলিয়ন ডলার খরচা করা হয়েছিলো, পাথর বহন, স্থাপন সহ বিভিন্ন কাজে ১০০০ হাজারের মতো হাতি ব্যবহার করার হয়েছিলো।
তাজমহল ছিলো তখনকার মোগল সাম্রাজের উতকৃষ্ট এক স্থাপত্যকলা, দিল্লির জামে মসজিদও সম্রাট শাহজাহানের আরেক সৃষ্টি, বেগম মুমতাজের অকালমৃত্যুতে শোকাহত সম্রাট গড়েছিলেন তাজমহল যা বিশ্বের ৭ম আশ্চর্য হিসাবে স্বীকৃতি হুসাবে এখনো বিদ্যমান।
তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার উপর, বিশেষ করে পারস্য ও মুঘল স্থাপত্য অনুসারে, নির্দিষ্ট কিছু নকশা তিমুর ও মুঘল ইমারতের মত হুবহু করা হয়েছে, যাদের মধ্যে তিমুরের গুর-ই-আমির, সমরখন্দে মুঘল সাম্রাজ্যের পূর্বসূরী, হুমায়ূনের মাজার, ইমাদ-উদ-দৌলার মাজার (কখনো ডাকা হয় শিশু তাজ নামে), এবং দিল্লীতে শাহজাহানের নিজের তৈরি দিল্লী জামে মসজিদ (আগেই বলেছি)।
ভিতরের কারুকার্য।
তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায়, মুঘল ইমারত পরিমার্জনের এক নতুন স্তরে পৌছায়, যেখানে পূর্ববর্তী মুঘল ইমারতসমূহ তৈরি হয়েছিল লাল বেলে পাথরে, শাহজাহান চালু করেছিলেন সাদা দামি মার্বেল পাথরের প্রচলন।
তাজমহল সংলগ্ন মসজিদের অন্দরের ছবি।
আমরা যমুনা নদীর পার্শ্ব থেকে পশ্চিম দিকে এগুলাম, কিছুদূর এসে তাজমহলের পশ্চিম পাশে পূর্ব পাশের অনুরূপ এক মসজিদ দেখে হতবাক হলাম, এই মসজিদটির কেবলা পূর্বদিকে মুখ করা, একটা মসজিদ তাও পূর্বদিকে কেবলা কি করে সম্ভব?
গাইড বললো, যেহেতু তাজের দুই পাশের জায়গা খালি ছিলো, সেহেতু পূর্ব পাশে নয়াভিরাম মসজিদ বানানো হয়, কিন্তু পশ্চিম পাশের জায়গাটা খালি রয়ে যায়, এতে তাজমহলের সৌন্দর্য্যের হানি হচ্ছিলো বিধায় এর পশ্চিম পাশে পূর্বের মসজিদের ন্যায় এক ডামি মসজিদ বানানো হয়, যেইটাতে কোন নামাজ বা প্রার্থনা করা হয়না।
বুঝে দেখুন, এক সম্পূর্ণ সৌন্দর্য্যমন্ডিত মসজিদের অনুরুপ আরেক ডামি মসজিদ বানানো হয়েছে শুধু মাত্র তাজমহলের সৌন্দর্য্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য, যার কোন কাজ নেই, শুধু সৌন্দর্য্য ধরে রাখা।
আমি এখনো ভাবি, কেমন ব্রেইন আর মেধা ছিলো সেই সময়কার নক্সাবীদদের?
চলবে।
ছবিঃ গুগল।
২৮টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
ছবির সৌন্দরজ্য দেখালাম পড়ে আবার আসব।
ইঞ্জা
অপেক্ষায় রইলাম ভাই। 😊
মোঃ মজিবর রহমান
যেমন সৌন্দুর্য্য তেমনি ব্যায়বহুল। যেমন সুখানুভুতি তেমনি কস্ট ও দুখের।
ইঞ্জা
সত্যি তাই ভাই, একদম সঠিক বাক্যটাই বললেন। 😍
অশোকা মাহবুবা
আগে আশ্চর্য হতাম। এখন মনে হয় কিরকম অর্থের অপচয়! আঙ্গুল কাটার জন্য খামোখাই বৃটিশদের বকি। মুঘল সম্রাটরা কম নাকি? পরের পর্বের অপেক্ষায়।
ইঞ্জা
তা সত্য বলেছেন আপু, আরেকটা বিষয় কি জানেন, সকল সৌন্দর্যের পিছনে কিন্তু কিছু করুন কাহিনী থাকে।
তৌহিদ
এসব তথ্য জেনে সত্যি আশ্চর্য হতে হয়। সে সময়কার ইঞ্জিনিয়ারগন যে করিৎকর্মা দেখিয়েছেন তার প্রশংসা করলেও ছোট করা হবে তাদের।
কিন্তু শ্রমিকদের আঙুল কেটে দেবার ঘটনা সেই সব মহান কর্মকে ম্লান করে দেয় সত্যি।
অনেক কিছু জানলাম দাদা, আপনার লেখার মাধ্যমে। সত্যিই অসাধারণ লাগছে ধারাবাহিক ভ্রমণ গল্পটি।
ইঞ্জা
সত্যি আমি অবাক হই কেন এমন নির্দয় আচরণ, দুঃখ লাগে।
ধন্যবাদ ভাই। 😊
নাজমুল আহসান
তাজমহল নির্মাণের পর শ্রমিকদের হাত/আঙ্গুল কেটে নেওয়া সংক্রান্ত যে ঘটনা প্রচলিত আছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। এমনকি পুরনো কোনো দুর্বল সূত্রেও পাওয়া যায়নি। এগুলো লোকমুখে প্রচলিত কাল্পনিক গল্প মাত্র।
“দ্য টোয়েন্টীয়েথ ওয়াইফ” আর “বেনীথ দ্য মার্বল স্কাই” বই দুটো পড়ে দেখতে পারেন।
ইঞ্জা
আমি যা শুনেছি গাইডের মুখে তারই বর্ণনা করলাম ভাই, এর বেশি কিছু নয়। 😊
নিতাই বাবু
মনটা ঘৃণায় ভরে উঠলো দাদা। কী করুণ কাহিনী? কোনদিন এই তাজমহল দেখার ভগ্য হলেও দেখবো না।
ইঞ্জা
করুন ও ঘৃণিত বটেই যা হয়েছিলো প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশি সময় আগে, সেই ঘৃণা থেকে তাজমহল দেখবেননা এ কিন্তু ঠিক না দাদা। 😊
ছাইরাছ হেলাল
খুব সুন্দর বর্ণনা, পড়তে ভালই লাগে।
আপনার তোলা কিছু ছবি দিতেন।
চলুক এ ভ্রমণ বৃত্তান্ত।
ইঞ্জা
ভাইজান এইখানে বলে রাখি, তখন স্মার্ট ফোন ছিলোনা, ছিলো ডিজিটাল ক্যামেরা যা আমার বন্ধু নিয়ে গিয়েছিল, আমি গিয়েছিলাম বিজনেস ট্রিপে, ফলশ্রুতিতে আমার ছবি তোলা হয়নি৷ আবার তাজের বাইরে আপনি ছবি তুলতে পারবেন কিন্তু তাজের ভিতর কোন ছবি তুলতে পারবেননা, এ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সাবিনা ইয়াসমিন
আজকের পর্বটাকে চুম্বকীয় পর্ব বলা যেতে পারে। যদিও তাজমহলেরর সবটাই মানুষকে চুম্বকের মতোই আকর্ষন করে। তবে আজকের অংশ সমৃদ্ধ হয়েছে বর্ননা আর ছবি গুলোর জন্যে।
কিছু ইতিহাস আছে শত জানার পরেও জানার আগ্রহ ফুরায়না। একই কথা, একই ঘটনা তারপরেও মানুষ প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে দেখতে চায়, শুনতে-জানতে চায়। তাজমহল তেমনি এক মহা আশ্চর্য হয়ে আছে জগতে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় 🙂 🌹
ইঞ্জা
সত্যিই তাই আপু, তাজের রহস্য জানার পরও জানার বাকি থেকে যায়, বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটা তাজমহল, স্বাভাবিক ভাবেই একে জানার আগ্রহ প্রবল হওয়ার কথায়।
ধন্যবাস প্রিয় বোন। 😊
মনির হোসেন মমি
ঐতিহাসিক তাজমহল মানুষের আনন্দের এক স্থাপত্য যেখানে পরতে পরতে লুকিয়ে আছে কষ্টের বীজ।প্রতিটি পর্বই চমকপ্রদ।চলুক।
ইঞ্জা
সত্যই বলেছেন, এর পরতে পরতে যেমন রহস্য লুকিয়ে আছে, তেমনি এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে করুণ অধ্যায়। 😢
রেজওয়ান
ভাবতেও অবাক লাগে সেই সময়কার ইঞ্জিনিয়ার ও ডিজাইনাররা কতটা ব্রিলিয়ান্ট ছিলো!❤পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ভাই!
একমুঠো ভালবাসার পর্বগুলোও দিয়েন মাঝেমধ্যে😜
ইঞ্জা
এক মুঠো ভালোবাসা আজই দেবো। 😊
আরজু মুক্তা
ভালো লাগলো।
ইঞ্জা
আপু এতদিন পর এলেন, কেমন আছেন?
রেহানা বীথি
সত্যিই অদ্ভুত। অবাক হতে হয় তখনকার কারুকার্য দেখে।
ইঞ্জা
এ তো খুবই অল্প, এর কারুকার্যের বিশালতা অনেক আপু, এই জন্যই বলছি একবার দেখে আসুন। 😊
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সুন্দর সাবলিল বর্ণনা। অনেক ভালো লাগছে।
ইঞ্জা
আন্তরিক ধন্যবাদ ভাই।
শাহরিন
দেখার অনেক শখ কিছুটা কমেছে আপনার লেখাটি পড়ে। অনেক কিছু জানলাম।
ইঞ্জা
আনন্দিত হলাম আপু, ধন্যবাদ।