ড্রাইভারের ইন্টারভিউ…… [রম্য]
শহর এলাকার ‘বাস সার্ভিস মালিক সমিতি’র অফিস।
অফিসের সামনে অনেক লোক জড়ো হয়ে আছে।
লোকগুলোর চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অফিসের ভিতরে মালিক সমিতির কর্মকর্তাবৃন্দকে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে।
উনারা টেবিলের একপাশে চেয়ার এবং অতিরিক্ত আরো প্লাষ্টিকের চেয়ার নিয়ে বসেছেন।
দু’একজন কর্মকর্তা গায়ের জামায় আতর গোলাপ চন্দন মেখে আসায় রুমটা খুশবো আর লোডসেডিং এর বরকতে ফ্যান বিহীন গরমের ভ্যাপসা আবহাওয়া আর ঘামের গন্ধ এক প্রকার সোঁদা সোঁদা গন্ধের সৃষ্টি করেছে।
কর্মকর্তাদের টেবিলের অপর পাশে শুধু একটা প্লাষ্টিকের খালী চেয়ার দেওয়া আছে।
রুমের দরজার পাশে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিক্যাল টিমকে প্রস্তুত দেখা যাচ্ছে।
কর্মকর্তাদের টেবিলে একজন মেহমান আছেন যার নাম ঠান্ডা মিয়া ওরফে ডান্ডা মিয়া । উনি পান বেশী খান বলে অনেকে পান-ডান্ডাও বলে থাকেন।
উনি হচ্ছেন মালিক সমিতির কেয়ার টেকার যার কাজ হচ্ছে- তেড়িমেড়ী করলে ড্রাইভার ও হেলপারকে ডান্ডা দিয়ে পিঠানো। ঠান্ডা মিয়ার হাতে সবসময় ডান্ডা একটা থাকবেই।
আজকে সমিতির অফিসে এসে পান-ডান্ডা একটি সমস্যায় পড়েছেন। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না ড্রাইভার নিয়োগ দেয়ার ইন্টারভিউতে মেডিক্যাল টিম কেন!
সে একটার পর একটা পান চিবুচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর পিছন দিকে ফিরে ওয়াক থু করে পানের পিছকারী ফেলছে। অফিসের রং এ চিড়ধরা দেয়ালের স্থানে স্থানে পানের পিছকারীর লালছে দাগ দেখা যাচ্ছে।
যাই হোক, যথা সময়ের একঘন্টা সাইত্রিশ মিনিট পর ইন্টারভিউর কার্যক্রম শুরু হল।
বাইরে অপেক্ষমান লোকগুলো থেকে একজন একজন আসতে বলা হল।
প্রথম জনকে রুমে ঢুকিয়ে অফিসের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল। তারপর লোকটিকে মেডিক্যাল টিমের সামনে বসানো হল।
অত:পর মেডিক্যাল টিমের একজন একটি বই সেলার সুই নিয়ে লোকটির বাম হাতের কনুই ও কব্জার মাঝামাঝি মাসের ভিতর সুইটি আমূলে বসিয়ে দিল।
লোকটি কিছু বুঝে উঠার আগেই মেডিক্যাল টিমের অপারেশান শেষ।
লোকটি অতর্কিত এরকম আচরণে ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠল, ভয়ে শিউরে উঠল! মেডিক্যাল টিমের অন্য লোকটি তাড়াতাড়ি এসে লোকটির গাল চেপে ধরল যাতে লোকটির চিৎকার বাইরের অপেক্ষমান লোকেরা শুনতে না পায়।
কিন্তু প্রথম চিৎকারই বাইরের লোকেরা শুনে ফেলে। ফলে ওদের মাঝে কানাঘুষার গুঞ্জন ধ্বনী পরিলক্ষিত হয়।
এদিকে লোকটির হাতে আস্ত একটা বই সেলার সুই ঢুকিয়ে দেওয়ার ফলে ওর হাত দিয়ে দর দর করে রক্ত ঝরছে।
মেডিকেল টিমের মহিলা সদস্য আহত ব্যক্তির ক্ষতস্থান পরিস্কার করে ওষুধ লাগিয়ে সিম্পল বেন্ডেজ করে দিল।
এরপর লোকটিকে অফিসের পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে বলল।
লোকটি যেতে যেতে বলতে লাগলো- এসেছি ড্রাইভারের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আর হাতে ঢুকিয়ে দেয়া হল একটি জুতা সেলার সুই…… কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না!
বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বললেন- তোমার ইন্টারভিউ হয়ে গেছে। ফলাফল পরে জানানো হবে।
এরপর একজন একজন করে লোক ঢুকিয়ে একই পদ্ধতিতে ওদেরকে আহত করে রক্ত ঝরানো হল।
আর আহত হওয়ার পর লোকটির নাক মুখের অবস্থা নিয়োগ বোর্ডের কর্মকর্তাবৃন্দ ভাল করে লক্ষ্য করতে লাগলেন। পর্যবেক্ষনের পর প্রত্যেকের সামনে রাখা খাতায় যার যার নামের পাশে নাম্বার দিতে লাগলেন।
এভাবে কাউকে বই সেলার সুই, কাউকে বস্তা সেলার সুই কাউকে কাঁচি, কাউকে ছুরি দিয়ে প্রত্যেকের শরীর থেকে রক্ত ঝরানো হল।
৩৫ জন প্রার্থী থেকে বেচে বেচে ২ জনকে নেওয়া হল ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য।
এদিকে পান-ডান্ডা মিয়ার অবস্থা কাহিল! সে তো মেডিকেল টিমের অবস্থা দেখে রীতিমত ভড়কে গেছে। ইতিমধ্যে পান-ডান্ডা পান খাওয়া ভুলে গিয়ে কয়েকবার টয়লেটে গেছে।
পরিশেষে পান-ডান্ডা সমিতির সভাপতিকে জিঙ্গেস করল- আমাদেরকে এভাবে কলাগাছের মত বসিয়ে রেখে কী লাভ হল? আমরা তো কারো কাছ থেকে কিছুই জিঙ্গেস করলাম না!
সভাপতি বললেন- আমরা কোন কিছু জিঙ্গেস করার জন্য এখানে বসিনি।
তাহলে কি জন্য বসেছি ?
আমরা পর্যবেক্ষনের জন্য বসেছি।
কিন্তু আসরা কি পর্যবেক্ষন করলাম!
গন্ডারের চামড়া।
গন্ডারের চামড়া? সেটা আবার কী? এখানে ড্রাইভার নিয়োগের ইন্টারভিউর জন্য সবাইকে আসতে বলা হল। আর আপনি বললেন পর্যবেক্ষন করছি। তাও আবার গন্ডারের চামড়া ! আমার মাথায় তো কিছুই খেলছে না।
সভাপতি বললেন- শোন পান-ডান্ডা। তোমার কাজতো শুধু পান চিবানো আর ডান্ডা পিঠানো। এর বাইরে তো তুমি কিছুই বুঝ না।
আমরা ঐ ড্রাইভারদের থেকে এমন লোক চাচ্ছিলাম যাদের শরীরের চামড়া গন্ডারের চামড়ার মত শক্ত মোটা ও ভোঁতা।
কিন্ত কেন? পান-ডান্ডার প্রশ্ন।
কারণ শহর এলাকার বাস যখন সে চালাবে তখন পথে ঘাটে রাস্তায় স্টেশনে বাস যাত্রী নেবার জন্য দাঁড়াবে। বাস দাঁড়ালেই গাড়িতে বসা যাত্রীরা হৈচৈ করে চিল্লাতে থাকবে বাস তাড়াতাড়ী চলে যাওয়ার জন্য। যাত্রীরা চাইবে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস স্টেশন ছেড়ে চলে যাক। কিছু যাত্রী আছেন যারা মনে করে ৫/১০ টাকা দিয়ে বাসটাই কিনে ফেলেছেন। কিন্তু আমাদের যাত্রীর কথা শুনলে চলবে না। আমরা চাইবো বাসে যেন মুড়ির টিনের মত ঠাসাঠাসী করে যাত্রী উঠুক। রাস্তায় যেখানে যাত্রি সেখানেই দাঁড়িয়ে যাত্রি তুলতে হবে আর গন্ডারের চামড়ার মত ড্রাইভারের গায়ের চামড়া না হলে এমনটি করা সম্ভব নয়। এবার বুঝেছো ডান্ডা মিয়া?
বুঝলাম আপনার সব কথা, বলল পান-ডান্ডা। কিন্তু বুঝলাম না শুধু ‘গন্ডারের চামড়া’।
শোন- সভাপতি বলল। যাদের চামড়া পাতলা তারা অল্পতেই কাহিল হয়ে যায়। নার্ভস হয়ে পড়ে। ওরা যাত্রীদের কথা মতই চলে।
সভাপতি বলতে লাগল, যদি যাত্রীদের কথায় অল্প যাত্রী নিয়ে টিপ শেষ করে তাহলে আমাদের ব্যবসায় তো লালবাতি জ্বলবে! তাই যাত্রীদের গালাগালি শোরগোল সহ্য করে যে অনেকক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী নিয়ে বাস ভরপুর করতে পারবে এমন ড্রাইভার আমাদের দরকার। আর সেই ড্রাইভারের চামড়া গন্ডারের মত নাহলে সে সফল হতে পারবে না।
সেই জন্যই গন্ডারের চামড়ার মত শক্ত মোটা ভোতা চামড়া বিষিষ্ট ড্রাইভার আমাদের খুবই জরুরী।
সভাপতির কথা শুনে পান-ডান্ডা আবারো টয়লেটের দিকে দৌড় দিল……..
১৬টি মন্তব্য
নিতাই বাবু
দেখুন দাদা, এটার চামড়া হলে চলবে কিনা!
চাটিগাঁ থেকে বাহার
পাক্কা!
ছাইরাছ হেলাল
ড্রাইভার সাহেবদের অবস্থা সত্যি খারাপ।
তবে এক হাতে তালি কিন্তু হয় না।
রম্য ভালই, তবে আর ও মন দিয়ে লিখুন।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
পড়ে মন্তব্য করার জন্য এবং পরামর্শ দেয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
ড্রাইভারদের চামড়া গন্ডারের মতই হতে হয়,
রম্য লিখলেও এটি বাস্তবতা।
ভালো লেগেছে লেখা।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সুন্দর উৎসাহমূলক মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। জিসান ভাইয়া।
তৌহিদ
এমন রম্য আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি পড়তে যেখানে পাঠক সমাজের উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ থাকে, সমাজের জন্য শিক্ষণীয় কিছু বিষয় থাকে। রম্যের মূলভাব এখানেই বিরাজমান। আপনি তা পেরেছেন। এমন গন্ডারের চামড়াদের জন্যই দূর্ঘটনা বেশী ঘটে। যা মোটেই কাম্য নয়।
রম্য ভালো লেগেছে ভাই।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
অত্যন্ত সুন্দর ও গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য আপনাকে প্লাসিত ধন্যবাদ।
আগেও লক্ষ্য করেছি আপনার মন্তব্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকে। লেখার মান উন্নত করার দিক নির্দেশনা থাকে।
আপনার জন্য শুভ কামনা।
সুরাইয়া পারভিন
হা হা হা,,, করুন হলেও দারুণ হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন। গণ্ডারের চামড়া পরিহিত বলেই বোধহয় এতো এতো দূর্ঘটনার স্বীকার হয় সাধারণ মানুষ
চাটিগাঁ থেকে বাহার
লোকাল বাসের ড্রাইভারগুলো এতো তেদরামি করে যে মনে হয় ওদের গায়ের চামড়া গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরী।
মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি
হা হা হা দারুণ রম্য। রম্য হলেও বাস্তবতা আছে। রোডে ড্রাইভার এর সহ্য ক্ষমতা অসম্ভব কত মানুষ কত কথা যে কয়।সবগুলো ধরতে গেছে বাস রেখে নেমে যেতে হবে ড্রাইভারকে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
যাত্রীদের শত কথা যেন তাদের কানেই যায় না এমন ভাব করে ড্রাইভারগুলো।
লোকাল বাসের ড্রাইভারগুলো এতো তেদরামি করে যে মনে হয় ওদের গায়ের চামড়া গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরী।
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
ড্রাইভার অষ্টম আশ্চর্য। কেমনে যে চালায়। কতো লোকের কথা যে হজম করে। এদের ড্রাইভিং বিষয়ে পড়াশুনা দরকার।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
কতো লোকের কথা যে হজম করে।
আপনার এই কথার মাঝেই লুকিয়ে আছে ‘গন্ডারের চামড়া’ রহস্য!
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
সাবিনা ইয়াসমিন
অদ্ভুত ব্যাপার তো! আসলেই কি এভাবে বাস ড্রাইভার নিয়োগ করা হয়!!
চাটিগাঁ থেকে বাহার
গন্ডারের চামড়ার বিষয়টি উপমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
লোকাল বাসের ড্রাইভারগুলো এতো তেদরামি করে যে মনে হয় ওদের গায়ের চামড়া গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরী।
আপনার মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।