
ডার্ক চকোলেটের কথা শুনলে কার না জিভে জল আসে, আমি এক বসাই বেশ কিছু চকোলেট খাই, চায়নার হুবাই শহরে ঘুরতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলাম কাডবেরির ডাভ (dove) নামে এক ডার্ক চকলেট, কিনে নিয়েছিলাম গোটা বিশেক চকোলেট, কি তার স্বাদ উফ্ বুঝাতে পারবোনা, এই চকোলেট বাংলাদেশ, ভারত কোথাও নেই বা এভেইলেবল না, মুখে লেগে আছে।
জানেন নিশ্চয় এই চকোলেট কোথা থেকে আসে?
কোকো নামে এক ধরণের ফলের বীজ থেকেই তৈরি হয় সুস্বাদু চকোলেট, অর্থাৎ কোকো জাতের বীজই চকোলেটের প্রধান উপকরণ আর এই কোকো কোথায় হয়?
পৃথীবির ফুসফুস খ্যাত আমাজন জঙ্গলে।
এই ডার্ক চকোলেট বা কোকো ফল নিয়ে এক করুণ অধ্যায় রয়ে গেছে যা আমি এক সংগ্রীহিত লেখা থেকে জানতে পেরেছি, আজ সেই লেখায় আপনাদের জন্য তুলে ধরছি।
আসুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক সেই করুণ ইতিহাস।
………. লেখক।
চকোলেট খেতে যতই মিষ্টি লাগুক না কেন, এর উৎপাদনে কিন্তু বহু শিশু শ্রমিকের অশ্রু অনেক কষ্ট মিশে আছে।
কোকো বা কোকোয়া দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন উপত্যকার উদ্ভিদ। যার বীজ থেকে চকলেট তৈরি হয়। কোকোয়ার বৈজ্ঞানিক নাম Theobroma cacao। মধ্য আমেরিকার আরও কয়েকটি দেশে এর চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে ক্রমান্বয়ে। তারপর আফ্রিকার আইভরি কোস্ট, ঘানা, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুনে এর চাষ শুরু হয়। এরপর এশিয়ার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও নিউগিনিতে সূচনা হয় এর চাষ। সাউথ ইন্ডিয়া ও উড়িষ্যা রাজ্যেও এর চাষ দেখা যায়।
কোকোয়া (Cocoa) গাছের ফলের বীজ থেকে চকোলেট প্রস্তুত হয়। ১ কেজি চকোলেট বানাতে ৩০০- ৬০০টি বীজ লাগে।
২০১৫ সালের হিসাবে, পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন শিশুদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে কোকোয়া চাষের কাজে। আইভরি কোস্ট এ প্রায় ১৯,০০০ শিশু শ্রমিককে নিযুক্ত করা হয়েছে। শিশুদে কে দাস হিসাবে, কিংবা অনেক ক্ষেত্রে বেগার শ্রমিক হিসাবে খাটানো হয় এই চাষে। বহু শিশুই বিপন্ন। শিক্ষার অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। তাদের শৈশবেই কোকোয়া চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশকের প্রভাবে নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হলেও শিশু শ্রমিক কিন্তু কমছে না। সমীক্ষায় দেখা গেছে, নেসলে’র মতো বড় বড় চকোলেট কোম্পানি র কোকোয়া ফার্ম এও বহু শিশু কে শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে।
১.৮ মিলিয়ন আফ্রিকান শিশু যারা তাদের শৈশব র্যাপিং পেপারে মুড়ে ঢেলে দিচ্ছে আমার আপনার সন্তানের মুখে। আইভরি কোস্ট আর ঘানা। পশ্চিম আফ্রিকার এই দুটো দেশে পৃথিবীর মোট কোকোর ৭০% চাষ করা হয়। কালো মানুষ, কালো মাটি, কালো চকোলেট। পৃথিবীর সবথেকে পিছিয়ে পরা দশটি দেশের মধ্যে একটি। এক মাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, মায়াবী চোখ। রাত্রে আগুনের পাশে বসে বুড়োবাবা মানে অ্যালির ঠাকুর্দা গল্প বলত। এক দৈত্যের গল্প। যে উত্তরের জঙ্গলে থাকে। বাচ্চা দেখলে তার রক্ত চুষে পুতুল বানিয়ে দেয়। ছোট্ট অ্যালি ভয় পেত। একদিন সেই দৈত্য ওকে ধরে নিয়ে গেল সামান্য ৮০ ডলারের বিনিময়ে। তখন ওর বয়স ৫। চমকে যাবেন না বন্ধুরা। শুধু একবার তাকিয়ে দেখুন আপনার শিশুটির দিকে। যাইহোক…
প্রতিদিন হাজার হাজার বাচ্চা পাচার হয়ে যায় মালি, বুরকিনা ফাসো এইসব প্রতিবেশী দেশ থেকে ঘানা, আইভরির কোকো ফার্মগুলোতে। স্কুল, কাজ, ডলারের লোভ দেখিয়ে বা রাস্তা থেকে তুলে আনা হয় বাচ্চাদের। সকাল ছটা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করানো হয়। খাদ্য বলতে সস্তার ভুট্টা সেদ্ধ আর কলা। রাত্রে জানোয়ারের মত জানলা দরজা হীন কাঠের আস্তাবলে ফেলে রাখা হয়। কখনো শিকল দিয়ে বেঁধে। তার মধ্যে যারা পালানোর চেষ্টা করে তাদের ভাগ্যে থাকে বেধরক মার। মার খেয়ে বা ধর্ষণে মরে গেলে নদীতে বা কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেওয়া হয় শরীর।
ভয় লাগছে…? ঘেন্না লাগছে….? আপনার শিশুটির মুখে লেগে থাকা চকোলেটের খয়েরী দাগের দিকে তাকাচ্ছেন…? তাহলে আর পড়বেন না। কারণ ইন্টারন্যাশনাল লেবার ল এখানে অকেজো। মায়া, ভালোবাসা নেই এখানে। আছে নৃশংসতা, আছে রক্ত। যা শুকিয়ে কালো হয়ে আছে আপনার ফ্রিজে রাখা চকোলেটে…
বিশ্ববিখ্যাত চকোলেট কোম্পানিগুলো যেমন নেসলে, হার্সেস, মার্স এখান থেকে কোকো কেনে। প্রতিযোগিতার বাজারে কোকোর দাম কম রাখার জন্যই শিশু শ্রমিক দরকার। কারণ ৫-১২ বছর বয়সীরা মজুরী পায় না। তার ওপরে তারা কোকো ফিল্ডের দুর্গম জায়গায় যেতে পারে, যেখানে একটু বড়রা ঢুকতে পারবে না। হ্যা, পোকা, সাপ আর বিছের কামড়ে বেশ কিছু বাচ্চা মারা যায়, কিন্তু তাতে মালিকদের কিছু যায় আসে না। দারিদ্র্য থাকবে, বাচ্চার যোগানও থাকবে। বড় কোম্পানিগুলো চুপ করে থাকবে সস্তায় কোকো পাওয়ার জন্য। আমরাও মজে থাকবো বিদেশী চকোলেটের স্বাদে…. চিয়ার্স!
কোকো ফার্মের শিশু শ্রমিকদের ৪০% মেয়ে। তাদের বয়সন্ধি আসে, যৌবন আসে এই কোকো বাগানেই। এদের অধিকাংশই সারা জীবনে তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে পারে না। কারণ এখানে আসা সোজা, বেরোনো কঠিন না, অসম্ভব। মালিক, ঠিকাদার, সুপারভাইজার, পুলিশ এমনকি মজুরদের যৌনতৃপ্তি মেটায় মেয়েরা। ১১ বছরে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে যৌনরোগ। পচে, গলে যায় শৈশব। স্বপ্নে পোকা আসে, বিষাক্ত ভয়ংকর সব পোকা। খুবলে খায় হৃদয়… চকোলেটি হৃদয়!
কাজের নমুনা….? দুর্বল হৃদয়রা পড়বেন না। স্কিপ করে যান। মেছেটে হল এমন একটি ছুরি যা চালালে একটা শিশুকে কিমা বানিয়ে দেওয়া যায় কয়েক মিনিটে। বাচ্চাদেরকে মেছেটে ধরিয়ে দেওয়া হয় কোকো বিন পেড়ে সেটাকে বস্তায় পুড়ে ঝাড়াই বাছাই করার জন্য। কারোর আঙুল কাটা যায়, কারোর গায়ে গভীর ক্ষত। ১০ বছরের বাচ্চাকে পিঠে ১০০ কেজির বস্তা নিয়ে চলতে হয়। একটু বিশ্রামের জন্য চাবুকের বাড়ি পড়ে!
কি ভাবছেন…? মধ্যযুগ…? না স্যার। এই ফেসবুকের যুগেই এই ক্রীতদাস প্রথা চলছে এবং এই অন্ধকার থেকেই বেরোচ্ছে আমার আপনার প্রিয় ডার্ক চকোলেট…
আমি জানিনা এখনো অ্যালি পালাতে পেরেছিল কিনা! কিন্তু বিশ্বাস রাখি, অ্যালি একদিন পালাতে পারবে। পালিয়ে যাবে অনেক দূর। এবেদি পেলের মত ফুটবলার হবে। শুধু ও না, শেকল খুলে যাবে ওর মত লাখ লাখ বন্দী প্রজাপতির…
হ্যা, একটা কথা বলা হয়নি, অ্যালি চকোলেট খায়নি কোনোদিন, স্বাদ জানে না, সান্তা আসেনা কখনো।
COLLECTED.
সমাপ্ত।
ছবিঃ মূল লেখা হতে।
২৬টি মন্তব্য
আরজু মুক্তা
কান্না চলে আসলো। আমরা কতো আরামে থাকি, খাই! হায়, বর্বরতা। এখনও দাস প্রথা!
আধুনিক আল্ট্রা বলে চিল্লাই, তলে সেই ফোরাত নদী।
ইঞ্জা
একদম ঠিক বলেছেন আপু, দুঃখ লাগে যখন শুনি আমাদের জ্বিহবার স্বাদ মেটাতে অসংখ্য মানুষ ধুকে ধুকে মরে। 😢
আরজু মুক্তা
আসলেই
ইঞ্জা
😢😢
শাহানা আক্তার
ইশশ কখনো ভাবিনি এরকম একটি করুণ কাহিনী থাকতে পারে এই ডার্ক চকলেটের পেছনে! ভীষণ কষ্ট লাগলো।
ইঞ্জা
আসলেই কষ্টকর বিষয় আপু। 😢
মনির হোসেন মমি
একটি মজাদার প্রোডাক্ট এর ভিতর যে কত করুণ ঘটনা লুকিয়ে থাকে তা আমরা অনেকেই জানি না যেমনটি লুকিয়ে আছে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা দুনিয়ার রোমান্টিক লগো তাজঁ মহল এর গায়। খুব ভাল লাগল লেখাটি তবে এটাও বলব ও স্বীকার করছি এখনো ঐ সব দেশে শিশুরা অনেক নির্যাতনের উপর দিয়েই বড় হয়।যে কোন মুল্যে হউক শিশুশ্রম বা শিশু দাস ব্যাবসা বন্ধ করা উচিত।
ইঞ্জা
এ বড়ই ভয়ংকর কষ্টকর অধ্যায়, এ থেকে অবশ্যই সেইসব শিশুদের নিস্কৃতি পাওয়া উচিত, জয় হোক মানবতার। 😢
মনির হোসেন মমি
সহমত। জয় হোক মানবতার।
ইঞ্জা
😍
নিতাই বাবু
আশা রাখি একদিন-না-একদিন ওরা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়। যাইহোক, ডার্ক চকোলেটের পেছনে ভয়ানক শিশু শ্রমিকদের করুণ পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার এই পোস্ট, এই লেখা, সত্যি প্রসংশার দাবি রাখে।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ দাদা, যখন প্রথম এই বিষয়ে জানলাম তখন নিজেকেই খুব দোষি মনে হচ্ছিলো। 😢
রেহানা বীথি
এই লেখাটা আগেও ফেবুতে পড়েছিলাম। মনটা বিষাদে ভরে যায়।
ইঞ্জা
জ্বি আপু, আমিও পেয়েছি আমার এক আপু শেয়ার করাতে।
মোস্তাফিজুর খাঁন
এই ধরনের চকোলেট আমার খুব পছন্দ ।
খেতে যে কি মজা !!! আহা,,,
ইতিহাস জানলাম আজকে । 😥
কথায় আছে ” পরিশ্রমের ফল সুমিষ্ট হয় ।”
তারা কৃতদাসরুপে পরিশ্রম করে যাচ্ছে, আর আমরা তাদের সংগ্রহকৃত ও তৈরিকৃত চকোলেটের স্বাদ উপভোগ করছি । জানিই না যে, কত নির্মমতার মধ্য দিতে তা তৈরি হচ্ছে ।
ইঞ্জা
দুঃখ লাগে যখন এর পেছনের করুণ গল্পটা শুনা বা দেখা হয়।
ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
এই বুড়ো বয়সেও চকলেট আমার পছন্দের তালিকায় উপরেই থাকে।
আমার আত্মীয়রা জানে চকলেট পছন্দের কথা, তো বুঝতেই পারছেন।
এখনকার সময়ে এটি কী করে সম্ভব তা ভেবে অবাক হচ্ছি।
পৃথিবী না এগিয়ে যাচ্ছে!! কিন্তু তা কোথায় এগুচ্ছে।
ইঞ্জা
আগেই বলেছি চকোলেট আপনার মতোই আমারও চকোলেট খুব পছন্দের কিন্তু যখন এর পেছনের করুণ ইতিহাসটা জানলাম, তখন থেকেই মনটা গুমরে মরছে, আসলেই আমরা জানি পৃথীবি এগুচ্ছে কিন্তু আসলে এর পিছনেও অনেক করুণ গল্পও নিশ্চয় আছে ভাইজান। 😢
তৌহিদ
ভাইরে, এই চকলেট খাবার প্রতি অনিহা চলে আসলো। সত্যিই জানতামই না এসব করুন কাহিনী। সত্যি কষ্ট পেলাম দাদা। যুগে যুগে নিষ্পেষিত শোষিত মানুষের ঘামের বিনিময়েই সবাই সুখ খুঁজেছি। ততাদের এত কষ্ট আসলেই মেনে নিতে পারিছিনা।
সুন্দর পোষ্ট দাদা।
ইঞ্জা
সত্যিই তাই, এই লেখাটি আজ প্রায় সপ্তাহ খানেক আমার প্রোফাইলে অনলি মি করে রেখে দিয়েছিলাম, কারণ মনটাই বিষিয়ে উঠেছিলো, দুঃখজনক ভাবে এই উন্নত বিশ্বেও এমন করুণ ইতিহাস চিন্তাও কি করা যায়? 😢
দালান জাহান
এখনও আছে এমন বর্বরতা! আশ্চর্য হলাম।
শিশু আর নারী নির্যাতন বোধহয় কোনদিন বন্ধ হবে না।
ইঞ্জা
দুঃখ লাগে ভাই। 😢
সাবিনা ইয়াসমিন
এই চকলেট আগেও খেতাম না, আর এই আর্টিকেল পড়ার পর আর কোনদিন খেতেও পারবো না। আমি এ পর্যন্ত যত অমানবিক শ্রম সমন্ধে জেনেছি, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে হৃদয়-বিদারক। খুব খারাপ লাগছে ভাইজান, মানুষ অর্থের জন্যে কত নির্মম আর নিষ্ঠুর হয় ভেবে।
ইঞ্জা
চকোলেট খাননা শুনে আশ্চর্য হলাম, আমি তো এর জন্য পাগলপারা, বিষয়টা যদিও হৃদয় বিদারক এরপরেও এই অমানবিকতা কখনো থামবে মনে হয়না আপু। 😢
মারজানা ফেরদৌস রুবা
মিষ্টি একটা খাবারের পেছনে তিক্ত একটা করুন ইতিহাস! একই বয়সী বাচ্চা, কেউ খেয়ে তৃপ্ত হয়, কেউ তা আহরণে ধ্বংস হয়! আহারে পৃথিবী! আহারে জীবন! একদিকে আলো আরেকদিকে নিকষ কালো!
ইঞ্জা
দুঃখ হয় ওদের নিয়ে, মানবাধিকার সংস্থা গুলো কি ওদের দেখেনা, হয়ত দেখেও নাদেখার ভাণ করে আছে আপু। 😢