
লিফট যতোই নীচে নামছে ততোই আমার মাথা চেপে বসছে কর্পোরেট অফিস, ব্যস্ততা, শহরের টান পোড়নের নানা অধ্যায়। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম জানান দিচ্ছে অতীতের পাতার নীরবতা। কি যেনো গলা পেঁচিয়ে আসছে! উফ! কী যন্ত্রণা! মুক্ত বাতাসের স্পর্শ পেতে দ্রুত ফার্স্ট ফ্লোর থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামছি।
” ড্রাইভার গাড়ি বের করো। ”
আজ বোর্ড মিটিং বসবে। কথা হবে আমাকে নিয়ে। যার সততার আড়ালে সবকিছু চাপা পরে যাবে কালকের ঘটনা। কেমনে পারলাম আমি? একটা রাত! না না। মাত্র কয়েক ঘণ্টা। নিমিষেই সবকিছু ওলট পালট। কতো স্বপ্নের কবর রচিত হবে! অথচ এই স্বপ্নের জন্যেই সাদা মনের বাবা ভাই ভাবি —– তাদের অনুরোধ ছেড়ে নগরে প্রবেশ।
গাড়ি আজ কোথায় এসে থামলো। চেনা লাগছে পরিবেশটা, ঝুল বারান্দা, বাহারি পাতাবাহার, ফুল গাছ। আমি তো ড্রাইভারকে এখানে আসতে বলিনি। আবৃত্তির কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
” কমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো। ”
আস্তে আস্তে পা ফেলে চলে আসি লিভিংরুমে। বা দিকের ঘরটার চৌকাঠে পা রেখে দেখি, আমার বড় ভাই আবৃত্তি শেখাচ্ছেন। কতো যে ভরাট কণ্ঠ ! ছেলে মেয়ে গুলো সমস্বরে বলছে তার সাথে সাথে। ঘরে কেমন জানি একটা প্রশান্তির ভাব। ফুলের সুবাস মৌ মৌ করছে। পাখির কলতান। পাশের বাসা থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্র সংগীত, ” তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার!”
আহা, কী অপূর্ব, কী মায়া!
” কী হলো তোমরা আবৃত্তি করছো না কেনো? ”
ভাইয়ার কথা শুনে একটি মেয়ে দরজার দিকে ইশারা করে।
” ভাইয়া বললো, আমার ছোট ভাই। আমাদের খোকা। ”
” কী রে তুই কখন এলি? ”
আমি কথা বলছি না দেখে ; ভাইয়া বললো, “আজ ছুটি। কবিতাটা সবাই চর্চা করবে।”
বড় ভাই গায়ে হাত দিয়ে বলে, কী রে হাঁপিয়ে গেছিস! চল ছাদে যাই। নির্মল বাতাসে মন জুড়াবে।
এক একটা সিঁড়ি পেরুচ্ছি আর জীবনের মলাটের পাতা আওড়াচ্ছি। আমরা চার ভাই বোন। বড় ভাই ১ ম শ্রেণি থেকে এম, এ সবখানেই ফার্স্ট। দু বোনও ভালো চাকরি করে। আমার তাদের ভাষা, সেকেলে চলাফেরা ভালো লাগতো না। কেমন জানি বাড়াবাড়ি। সকালে ওঠো, হেঁটে আসো, সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করো। কোথাও যেতে হলে বাবা মায়ের আশীর্বাদ নাও। এক সঙ্গে খেতে বসো। খাওয়ার আগে প্রার্থনা করো, আবৃত্তি শিখো। এতো সব মানতে ভালো লাগতো না। আমার চোখ ঐ দূরের ১৫ তালাতে আটকে থাকতো। মনে হতো উপর থেকে জীবন উপভোগ করা সহজ।
” কী রে কি ভাবছিস? আমার জীবন? আমি হয়তো অনেক বড় চাকরি পেতাম। কিন্তু এই যে সকালে উঠে রোদমাখা, একটু বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখা, গাছের পাতা চেনা, আনমনে গুনগুন করে গান করা। এটাই বা কম কীসে? কলেজ যাই। ক্লাস নিই। ছাত্র ছাত্রীরা আমার কথা প্রাণ ভরে শোনে। এই ভালো লাগাটা কি তুই পেয়েছিস? ”
ভাইয়ার কথা শুনে, শুধু তাকাই।
” বাবা, আমি শহরে যাবো। কলেজের চাকরি, আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া ব্যাংকের এই লোভনীয় অফারটা মিস করতে চাচ্ছিলাম না।”
বাবা বলে, ” তুমি অনেক পড়ালেখা শিখেছো। আমার থেকে বেশি বোঝ। তুমিই সিদ্ধান্ত নাও। ”
“রুমে এসে দরজা লাগিয়ে সজোরে চেয়ারে একটা লাথি দেই। এদের কথা ভাবলে উপরে ওঠা যাবে না। কালকেই লাগেজ গোছাতে হবে।”
রোদ মেখে দেখছিস তোর কতো ভালো লাগছে। দেখবি সব বিষাক্ত পদার্থ কিছুক্ষণের মধ্যে তোর গা থেকে চলে যাবে।
ভাইয়ার কথা শুনে, আমার চোখ বেয়ে পানি আসতে চাইলো। আমি কাঁদতে পারছিনা। কণ্ঠরোধ।
স্মৃতি শুধু টানছে। পরদিন গাড়ি ডেকে লাগেজ উঠিয়ে চলে গেলাম। চাকরিতে জয়েন করলাম। আট তলার ফ্ল্যাট বরাদ্দ। কর্পোরেট জব। স্যুট টাই!! টাকা আসে। ফার্ণিচারও বদল হয়। জীবন ঘুরতে থাকে বৃত্তের বাইরে গিয়ে। জীবন সঙ্গিনী বাসায় থাকে। তবুও খুঁজি কর্পোরেট ভালোবাসা। এখানে লোডশেডিং হয় না। নীল লালচে রঙিন আলোর ঝলকানি।
আমার স্ত্রী রুবা, ও থেমে নেই। সুন্দরি, সপ্রতিভ, মার্জিত, নিখুঁত ইংরেজি ফ্রেন্স বলার কারণে প্রতিটি অনুষ্ঠান ফিরে পায় সজীবতা। সবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পুরুষদের চোখে অবশ্য প্রশংসা ছাড়া অন্য কিছু থাকে। আর রুবা সেটা বোঝে। সেই অহংবোধটা সে ললিপপের মতো চুষে খায়। আমিও কিছু বলি না। নিজেই তো সময় দেই না।
এখন বুঝি, ভাবী বা মা আমাদের জন্য কেনো অপেক্ষা করতো ভাতের প্লেট নিয়ে। কর্পোরেট দুনিয়ায় আন্তরিকতা হচ্ছে টাইমবারড। দুজনের দুই পার্টি। নাইট ক্লাব। ফিরি রাত ১/২ টায়। যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে যাই। সকালে সেই কুক, দারোয়ান, ড্রাইভার। আমি নিঃশেষ।
“ভাইয়া বলছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি হবে। ঈষাণ কোণে মেঘ জমেছে। তোর গায়ের সব কলুষতা পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে যাবে। নতুন ঘ্রাণ পাবি। ”
আমিও চাই বৃষ্টি। বৃষ্টি হলে আমি কাঁদতে পারবো। কান্না লুকাতে পারবো।
আজ রুবার জন্মদিন। পি এ কে দিয়ে উপহার কিনে আনলাম। রাতে জমজমাট পার্টি থাকছে। বাড়ি ফিরে বললাম, আমি নিজে পছন্দ করে কিনেছি। ইন্টারকমে ফোন। “স্যার আপনার বাবা, ভাই, ভাবি এসেছেন। ফোনটা দাও। ওহহো! কতোদিন বলেছি, ফোন করে তারপর আসবে! ভাবি বললো, আমাদের মনে ছিলো না। তোর বাসায় অনুষ্ঠান না? আমরা আর একদিন আসবো! ”
নেশায় বুঁদ আমরা। আত্মার টান এখানে কাজ করে না। নির্দয় কলুপ আটা, বন্দি খাঁচার পাখি আমরা।
বৃষ্টিটা এসে শান্তির প্রলেপ দিয়ে গেলো। বুঝলাম, কী ভুল করেছি। কতো কষ্ট দিয়েছি তাদের! অথচ কঠিন মুহূর্তে ওরাই পাশে।
ভাইয়া……
বল।
আমি বড় অন্যায় করেছি।
তুই যে নিজেই বুঝতে পারছিস এটাই বড়। মানুষের একান্ত অনেক বিষয় থাকে। বিবেকের সামনে দাঁড়াতে যেনো পারি : এটা খেয়াল রাখতে হয়। বিবেকের কাছে ছোট হতে নেই।
২৩টি মন্তব্য
নবকুমার দাস
সুন্দর লেখা দিদিভাই । ভালো লাগলো ।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ অশেষ।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
আত্মায় গড়া সম্পর্কের অবহেলা
ঠিক একদিন অনুতাপ হয়ে ফিরে আসে।
গল্পটি পড়ে আন্তরিকতায় সিক্ত হলাম।
ভীষণ মুগ্ধতায় শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রেখে গেলাম অন্তহীণ।
আরজু মুক্তা
ভাই আমার লেখার কলম গতি পেলো।
শুভকামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমরা ভুলেই যাই নিজেদের অস্তিত্ব। যেখান থেকে এসেছি তা। জীবনের কর্পোরেট কোলাহল আর বিলাশিতা ভালো লাগে। বাস্তব বলে মনে হয়। তারপরও সব সাঙ্গ করে একসময় ফিরতেই হয় সেই বাস্তবতায়।
অসাধারণ গল্প । মুগ্ধতা রেখে গেলাম🥰🥰
আরজু মুক্তা
রুকু আপনিও কিন্তু অসাধারণ লিখেন। আমার দুনিয়ার কাজের মাঝে এই ছোট ছোট লেখাগুলো আপনারা পড়েন বলেই আমি ধন্য।
ভালো থাকবেন সবসময়
স্বপ্ন নীলা
কর্পোরেট দুনিয়ায় আন্তরিকতা উধাও হয়ে যাচ্ছে। এটা যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা মনে করছি এটা হলো পিছনের ধারনা। অথচ এটারই দরকার এখন সবচেয়ে বেশি — আপু গল্পটা এত সুন্দর হয়েছে যে পাঠে মন ভরে গেল — শুভকামনা রইল নিরন্তর
আরজু মুক্তা
এমন সুন্দর মন্তব্য পেলে কলম চলতেই থাকবে। যারা লিখে বা নির্মাণ করে তারা যদি লেখায় মেসেজ দিতে পারে, তখন সমাজের ১০ জন থেকে একজন তো অনুসরণ করে। লেখার সার্থকতা ওখানেই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
কর্পোরেট আলেয়ায় চোখ ধাঁধিয়ে সবকিছু নিঃস্ব করে শেষপর্যন্ত ফিরে যাই জীবনের আসল সুখের নীড়ে। অসম্ভব ভালোলাগার একটি গল্প কিন্তু এটাই বাস্তবতা ইদানিং কালে। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
আরজু মুক্তা
ঐটাই যে আমাদের আসক নীড়। ডানা মেলার জায়গা।
আপনার মন্তব্য পেলে ভালো লাগে।
শুভকামনা দিদি
আরজু মুক্তা
আসল
শামীনুল হক হীরা
বাহঃ কি অপূর্ব লিখেছেন।। জবাব নেই। শুভকামনা রইল।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকবেন
শুভকামনা সবসময়
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর লেখেছেন মুক্তা আপু
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকবেন।
শুভকামনা
তৌহিদ
নিজের ক্যারিয়ারের ভাবনায় ভুলে যাই রক্তের বন্ধন। এ জগতজীবনে পরিবারের আপনজনেরাই অনেকের কাছে উপেক্ষিত বর্তমানে।
আপনার লেখায় সমাজের বাস্তব প্রেক্ষাপট দেখলাম। লেখার মুন্সিয়ানা অসাধারণ। এক নাগারে প্রথম থেকে পড়ে গেলাম।
শুভকামনা আপু।
আরজু মুক্তা
আপনাদের ভালো লাগাটাই আমার লেখার গতি। আমি চেষ্টা করি সবসময় আমার আগের লেখাটার থেকে এই লেখা ভালো হোক। আর পাঠকের ভালোবাসা আমার মাথার মুকুট।
আপনার জন্য শুভকামনা সবসময়
জিসান শা ইকরাম
কর্পোরেট জীবন কোনো জীবনই না,
এ জীবনে থেমে যাওয়া নেই,
প্রাণহীন মরুভূমির মাঝে কৃত্রিম গাছের জীবন।
উচ্চাকাক্ষী মনে আরো উচুতে উঠতে চায়, কত উচুতে উঠতে চায় তা সে জানেই না।
অথচ এ জীবনের পিছনে ছুটি আমরা। একসময় অনেক ফিরে আসতে পারে নিজের মাঝে। অনেকেই পারে না ফিরতে।
এসব কারনেই আমি নিজে থেমে গিয়েছি ২০১০ এ। বাদ দিয়েছি উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
ভালো আছি এখন।
চমৎকার গল্প, সুন্দর উপস্থাপনা।
শুভ কামনা, শুভ ব্লগিং।
আরজু মুক্তা
একদম। অল্প কিছুর মাঝে সুখ খুঁজে নেয়া বেটার। আপনাদের কমেন্ট আমার পরম পাওয়া।
শুভ ব্লগিং।
আপনি কেমন আছেন?
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের সময়কার বাস্তবতা তুলে এনেছেন। ভাইয়ের চোখ দিয়ে।
তবে গল্পের শেষ বোধের জায়গাটিতে আমাদের ফিরে যাওয়া হয় না ।
আমার পছন্দ আপনার অনুগল্প, সেটি চাচ্ছি।
আরজু মুক্তা
আসলেই ফিরে যাওয়া হয় না।
অনুগল্প আসিতেছে।
পপি তালুকদার
সমস্ত দিন শেষে শান্তি ফিরে নীড়ে।আসলে যত উপরে যাই না কেন প্রকৃত সুখ সুন্দর সম্পর্কে মাঝে। কর্পোরেট দুনিয়ার আলোর মাঝে মানুষ চেনা যায় না।সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আসলেই প্রকৃত সুখ আমরা বুঝতে পারিনা।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
ভালো থাকবেন