যাচ্ছিলাম দেশে। সাথে অসুস্থ এক মুরুব্বী আত্মীয়। জে এফ কে এয়ারপোর্ট থেকে হুইল চেয়ারে তাঁকে প্লেনে তুলে দেয়া হল। দুবাই এয়ারপোর্টে যাত্রা বিরতি। আমরা প্লেন থেকে বের হচ্ছি একে একে। বাইরেই হুইল চেয়ার নিয়ে অপেক্ষায় সেখানে কর্মরত’রা। হুড়োহুড়ি লেগে আছে, কার আগে কে তাঁর হুইল চেয়ারে যাত্রী নিবে। কিছু বখশিশ পাবে সে আশায়। চেয়ে দেখি তাঁরা প্রায় সবাই আমার দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। আমার আত্মীয়কে কোন একটি চেয়ারে বসতে সহযোগিতা করছিলাম। হঠাৎ কানে এলো বিরক্তিমাখা ঝাঁঝালো মেয়েলী কণ্ঠস্বর। হুইল চেয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে অকথ্য বকাঝকা। কেন এমন পথরোধ করে আক্কেলজ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে… ছোটলোক… অশিক্ষিত ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ঘুরে তাকাই। আগের রাতে মিউজিক এ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে আমি যার গান শুনেছিলাম, তিনি সেই গায়িকা। একসময়কার জনপ্রিয় নায়কের কন্যা। আমি অবাক হইনি। কারন, তিনি গান গেয়ে হাসি-আনন্দে দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন দর্শনীর বিনিময়ে। এটি তাঁর পেশা। দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে খুশি করবেন কিসের বিনিময়ে ! হুইলচেয়ারে হুড়োহুড়ি করে যাত্রী নিলে কিছু বখশিশ তাঁরা পায় হয়তো… হাড্ডিচর্মসার মানুষগুলোর একটু একটু করে জমানো টাকায় দেশে তাঁর পরিবারের অনেকগুলো মানুষের অন্নের সংস্থান হয় হয়তো, তাই তাঁরা মুখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে। কোন প্রতিবাদ করেনা। আমি তীব্র ঘৃণায় সেই গায়িকার হেঁটে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকি, যতক্ষণ না তাঁর হাইহীলের ঠক্ঠক্ শব্দ মিলিয়ে যায় শ্রবনসীমা থেকে।
যাবতীয় কাজ সেরে এয়ারপোর্ট ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে বসি যখন, টেবিল মুছে দিয়ে গেল যে নারী, সেও আমার দেশের, আমার ভাষার। কত টাকার বিনিময়ে প্রিয়জনদের ছেড়ে সেদেশে জব করছে, জানার খুব ইচ্ছে হয়। জিজ্ঞেস করাটা শোভন নয়, তাই জানা হয় না। মনে পরে যায়, আমার এক আত্মীয় তাঁর ৫/৬ বছর বয়সী কন্যা আর স্ত্রী’কে রেখে মধ্যপ্রাচ্যে যায় জীবিকার তাগিদে। খুব কম পারিশ্রমিকে কাজ করে দেশে টাকা পাঠিয়েছে নিয়মিত। বেড়ার ঘরটি পাকা করেছেন। কেউ দেশে গেলে এটা সেটা পাঠিয়েছেন পরিবারের জন্যে। খরচ, জব, সীমাবদ্ধতা সহ নানান ভাবনায় দেশে যাননি অনেক বছর। অবশেষে দেশে গেলেন যখন, ততদিনে ছোট্ট মেয়েটি তরুণী। কন্যা’র বিয়ের উপলক্ষ সামনে নিয়ে আসা। জীবন জীবিকার অন্বেষণে’র মাঝে হারিয়ে গেল পিতা-কন্যা’র সুন্দর সুন্দর সময়গুলো।
স্পীকারে এনাউন্স শুনে উঠে দাঁড়াই। ইমিগ্রেশনের টুকটাক কাজ সেরে প্লেনে যখন বসি, সে এক ভিন্ন পরিবেশ। বেশিরভাগই দুবাই থেকে উঠা যাত্রী। পোটলা-পুটলি, কম্বল, পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে উঠা মানুষগুলো। শরীরে হাড়ভাঙা খাটুনির ছাপ স্পষ্ট। ক্লান্ত চোখে মুখে নীড়ে ফেরার, প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে ফেরার স্বপ্ন, আনন্দ। যেন এক একটি বাংলাদেশ। খুশিতে হেসে উঠা বাংলাদেশ। আমি ডানে বাঁ’য়ে তাকাই। শ্রদ্ধায় নুইয়ে আসে ভেতরটা। কানে বেজে উঠে সেই গায়িকার তাচ্ছিল্য মাখা রূঢ় কণ্ঠস্বর। লজ্জিত হই। অপমানিত হই। যেন আমার বাংলাদেশ অপমানিত হল।
ষোল কোটি জনসংখ্যার প্রায় এক কোটি প্রবাসী। মুল রেমিটেন্স কিন্তু নিম্ন আয়ের প্রবাসীরাই পাঠিয়ে থাকে। গতবছরই ১ হাজার ৪২২ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমান অর্থ পাঠিয়েছে প্রবাসী’রা। এটি আজকের একটি জাতীয় পত্রিকার হিসাব।
সবশেষে বলি__ জন্মই কারো আজন্ম পাপ নয়। একটু ভাল থাকার, সচ্ছল থাকার প্রাণপণ চেষ্টা সবাই করে। কারো জীবনে সুযোগ আসে, কারো আসে না। মানুষের প্রতি মানুষের ন্যূনতম সন্মানবোধ থাকা উচিত।
## মানুষের প্রতি মানুষের থাকুক অন্তহীন এক মানবিক অনুভুতি।
১৬টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
উনিও ‘গতর’ খাটিয়েই আয় করেন।
ধিক তাকে।
রিমি রুম্মান
তীব্র ঘৃণা নিয়ে আমি চেয়েছলাম তাঁর চলে যাবার পথটিতে …
ব্লগার সজীব
আপনি যে গায়িকার কথা বললেন তিনি কেবল নেন,কিছুই দেননা দেশকে।দেশকে দিচ্ছেন এই অশিক্ষিত বর্বর খেটে খাওয়া মানুষ গুলোই।আপনাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আপু,এমন ভাবনার জন্য।
রিমি রুম্মান
চলার পথে কত কি-ই দেখি। কিছু আপ্লুত করে , কিছু ঘৃণা করতে শিখায়। এমন মানুষগুলো ঘৃণারও অযোগ্য।
নীলাঞ্জনা নীলা
সেই গায়িকার প্রতি ঘৃণা জানালাম।
রিমি রুম্মান
আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, এমন ঘৃণা থাকবে মনের গহীনে …
খেয়ালী মেয়ে
মানুষের প্রতি মানুষের ন্যূনতম সন্মানবোধ থাকা উচিত..আর যার মাঝে সেটা নেই তাকে মানুষ ভাবতেও ঘৃনা হয়…ধিক সেই গায়িকাকে……….
রিমি রুম্মান
আমরা মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে সন্মান দিতে জানিনা কেন, এটি বড় প্রশ্নবোধক ।
জিসান শা ইকরাম
খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন বিষয়টি
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরনে
রিজার্ভ ব্যাংকে রেকর্ড পরিমান স্তিথি জমায় এইসব তথাকথিত এশ্মার্ট শিল্পীদের কোন অবদান নেই
মুল অবদান এই সব প্র্যা অশিক্ষিত শ্রমিকদের।
রিমি রুম্মান
সেইসব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মুখের ছবি আমার আজো চোখে ভাসে। প্রতিবাদহীন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল কেবল ! ঠিকই তো ! উচ্চশ্রেণীর সাথে তাঁরা তো আর পেরে উঠবে না !
নুসরাত মৌরিন
প্রবাসী এত দূরে থেকেও দেশের জন্য যতটুকু করছেন,সেই গায়িকা তার সিকিভাগও কি করছেন?তবু কি অহংকার!!!
শ্রদ্ধা সেইসব খেটে খাওয়া এদেশের একনম্বর মানুষগুলোকে- যারা দেশ থেকে দূরে আছেন ঠিক কিন্তু শ্রমে-ঘামে-সংগ্রামে দেশকে মুড়ে রেখেছেন কৃতজ্ঞতায়,ভালবাসায়।
রিমি রুম্মান
খেটে খাওয়া সেই মলিন মুখগুলো যেন এক একটি মলিন মুখের বাংলাদেশ ! সেই সময়ের অনুভুতি বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। কিছুটা বুঝানোর চেষ্টা করেছি মাত্র।
লীলাবতী
আপু আপনি কথা গুলো এত সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেন কিভাবে? কত সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিলেন।ঐ গায়িকার প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মালো শুধু।
রিমি রুম্মান
সেই ঘটনা মনে হলে শুধু গুন গুন করি___ মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন
ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি… সোনার বাংলা
আরিফ আরাফাত রুশো
নাম না লিখেও বলে দিলেন! মনে হল আখি আলমগীর।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। শুভকামনা।