চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং প্রখ্যাত পরমানুবিজ্ঞানী এপিজে আবুল কালাম (আবুল পাকির জয়নাল আবেদিন আবদুল কালাম)। গতকাল সন্ধা আনুমানিক ৮-০ ঘটিকায় ভারতের শিলংয়ে সেখানকার তরুনদের এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেয়ার সময় অনুষ্ঠানস্থলেই ঢলে পড়েন তিনি। সাথে সাথে স্থানীয় এক বেসরকারী হাসপাতালের আইসিইউতে তাঁকে স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানে চিকিৎসকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ৮৪ বছর বয়ষ্ক শ্রদ্ধাভাজন এই ব্যক্তি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
ভারতীয় রাজ্য তামিলনাড়ু–র এক দরিদ্র মৎস্যজীবি পরিবারে ১৯৩১ সনের ১৫ই অক্টোবর জন্মগ্রহন করেন জনাব আবদুল কালাম। সংসারে দারিদ্রতার কারনে মাত্র আট/নয় বছর বয়সেই তিনি খাবার জোটাতে ও সংসারে সহায়তা করতে কাগজ বিক্রি করতে বাধ্য হন। তিনি বাল্যকালে স্বপ্ন দেখতেন পাইলট হবেন। কিন্তু পরে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে পারেননি বলে পাইলট হতে না পেরে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে এক সাধকের। সাধক সবকিছু জেনে বলেন, ঠিক আছে, যখন আত্মহত্যা করতেই চাও, করো। তবে যদি না করো, তবে আমার সাথে দেখা করিও। তিনি আত্মহত্যা না করে দেখা করেন সেই সাধকের সাথে, যিনি তাঁকে বলেন, ইশ্বর তোমাকে দিয়ে পাইলট অপেক্ষা আরো বড় কিছু করাবেন বলে তোমার আত্মহত্যা করা হয়নি। অতএব সেপথে আর না গিয়ে বড় কিছু ভাবো। এভাবে বড় কিছু ভাবনায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি। তিনি ছিলেন অবিবাহিত এবং সহজ, সরল ও অনাড়ম্বরপূর্ন জীবন যাপন করতেন।
তাঁকে বলা হতো মিসাইলম্যান। বিমান প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশুনা করে তিনি ভারতে মহাকাশযান তৈরীতে বড় ভূমিকা রাখেন, যে মহাকাশযান দিয়ে পরবর্তীতে তাঁর দেশ প্রথম ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে। একারনে তাঁকে ভারতের মিসাইলম্যান বলা হয়। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীতেও তিনি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। ভারত সরকার তাঁকে দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ভারতরত্ন-এ ভূষিত করে। এছাড়াও তাঁকে ’পদ্মভূষণ’ এবং ’পদ্মবিভূষণ’ খেতাবেও ভূষিত করা হয়। ভারতের তৃতীয় মুসলমান রাষ্ট্রপতি পদ তিনি ২০০২ হতে ২০০৭ সন পর্যন্ত অলংকৃত করেন। পরবর্তী টার্মেও তাঁকে রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাব দেয়া হয়, তবে বিনয়ের সাথে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। ২০০২ সালে যখন তিনি রাষ্ট্রপতিভবনে আসেন, তখন অতোবড় বাড়ী দেখে শিশুর মতো বলে উঠেছিলেন, এতোবড় বাড়ী দিয়ে আমি কী করবো? রাষ্ট্রপতি ভবনের সীমানা সেখানে কর্মরতদের সন্তানদের জন্য তিনি অবারিত করে দিয়েছিলেন এবং এই নির্দেশ যাতে পালিত হয়, সেব্যাপারেও সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
সম্মানিত এই মানুষটির আরেকটা বিরাট গুন হচ্ছে তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যক্তি এবং নিজে শুধু তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তা নয়। অন্যকেও দেখাতেন। তরুন সমাজকে তিনি বড় স্বপ্ন দেখতে বলতেন এবং ছোট স্বপ্ন দেখা অপরাধ বলেও তাদেরকে ছোট স্বপ্ন দেখতে মানা করতেন। তিনি বলতেন, জীবনে তোমাদেরকে আকাশে উড়তে হবে। এটা তিনি এজন্য বলতেন যে, তিনি মনে করতেন, জীবনে সর্বোচ্চ সুখ পেতে হবে প্রতিটা মানুষকে এবং এই সর্বোচ্চ সুখটা পাওয়া যেতে পারে শুধুমাত্র মনের মধ্যে মহৎ চিন্তা লালন করা আর মহান কাজ করার মাধ্যমে। তরুনদের তিনি বলতেন, স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন, শুধুই দেখে যেতে হবে স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখা ছাড়া কোন কাজ করা যায়না, সে কাজের ভাল ফল নাই, কোন সুখও নাই সেকাজে। ’নিজেকে কখনো একা মনে হলে আকাশের দিকে তাকাও; আমরা একা নই, পৃথিবী আমাদের বন্ধু। যারা কাজ করে ও স্বপ্ন দেখে, প্রকৃতি তাদের সাহায্য করে।’- তাঁর বিখ্যাত উক্তিগুলির মধ্যে একটি। নেতাদের মাঝে তিনি সততা দাবী করতেন এবং মনে করতেন নেতাকে সব সমস্যার সমাধান করতে পারতে হবে তাঁর সততা আর দৃঢ়তা দ্বারা। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বপ্নবাজরাই কেবল সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তারুন্যের জয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, তরুনদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে, নতুন কিছু ভাবতে হবে, অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে।
গতকাল তাঁর মৃত্যুর পর এক টকশোতে আলোচনা হচ্ছিল ভারত উন্নত সংস্কৃতির দেশ এবং গুনী ব্যক্তিকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে কার্পন্য করেনা, আমরা যে কবে পারব এরকম গুনী মানুষকে যথাযথ মর্যাদা দিতে। আমাদের আছেন ডক্টর ইউনূস, কিন্তু আমরা কী তাঁকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারছি? এটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক এদেশেই আছেন অনেক সাদামনের মানুষ, প্রভাতে উঠেই যাঁরা তাঁদের এই বৃদ্ধ বয়সেও বই নিয়ে বাই-সাইকেলে করে বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন বাসাবাড়ীতে, ছেলেমেয়েদেরকে বই পড়ানোর উদ্দেশ্যে, অনেকে হেঁটে হেঁটেও এইকাজ করেন অতি তৃপ্তির সাথে। আবার অনেকে আছেন, কিছু করতে না পেরে সুশাসনের জন্য নিজ হাতে লিখে ফটোকপি করে সেগুলো প্রচার করেন। কিছু মানুষ সারা জীবন গাছ লাগিয়ে গেছেন মানুষ আর প্রানিসকলের আরাম এবং স্বস্তির জন্য। নিজ-দারিদ্রতার মধ্যেও আছেন অনেক মানুষ, সারাদিন পরোপকার করেই বেড়ান যাঁরা।
হাঁ, আমাদের সবাইকে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। ডক্টর ইউনূসকে তাঁর মতো এবং শ্রদ্ধেয় সাদামনের মানুষজনকে তঁদের মতো করে সেরকমভাবে। তবে ডক্টর ইউনূসকে এপিজে আবদুল কালামের সাথে একই পাল্লায় মাপলে হবেনা। কমপক্ষে উদারতার দিক থেকে তাঁদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। ডক্টর ইউনূসের বিরাট অবদান থাকলেও তাঁর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু ডক্টর কালামের কোন সীমা-পরিসীমা নাই। সুস্পষ্টভাবেই তিনি তরুন সমাজকে স্বপ্ন দেখতে ডাক দেন যে-স্বপ্নের কোন সীমা-পরিসীমা নাই এবং সেই স্বপ্নের থাকতেও হবেনা কোন সীমা-পরিসীমা। নেতাদের সম্পর্কেও সুস্পষ্টভাবে তিনি বলেন, নেতাকে অবশ্যই সব বিষয়ে সমাধান করতে পারতে হবে এবং অবশ্যই নেতাকে সৎ হতে হবে, সততা নিয়ে চলতে হবে।
[পাদটিকা: পৃথিবীতে কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। এপিজে আবদুল কালামের স্বপ্নের পরিসীমাকেও ছাড়িয়ে যাবে হয়তো অন্য কোন স্বপ্ন দেখার প্রয়োজনীয়তা। হয়তো সেই প্রয়োজনের কথা তাঁর মনে আসেনি। কারন দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করলেও জীবনের শেষের কমপক্ষে পঞ্চাশটা বছর তাঁর অভাবে কাটেনি। তাই দারিদ্রতা অনূভবের কারনে তাঁর কাছ থেকে আরো কিছু বারুদ আমরা পাইনি। তবুও এর মধ্যেই যতটা পেয়েছি, দারিদ্রক্লিষ্ট তরুন প্রজন্মের অনেকে তাতেই যে তাঁকে কোনো একদিন ছাড়িয়ে যাবেনা, কী করে নিশ্চিৎভাবে বলা যাবে এটা!]
২৬টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
খুব ভাল লাগলো।
নিরন্তর শুভেচ্ছা।
আজিম ফাইফ ও ফাইভ
আপনাকেও নিরন্তর শুভেচ্ছা জনাব মজিবর ভাই।
জিসান শা ইকরাম
ভালো লাগলো আপনার লেখাটি।
শ্রদ্ধা জানাচ্ছি প্রয়াত এপিজে আবুল কালাম এর আত্মার প্রতি।
সোনেলায় স্বাগতম -{@
আজিম ফাইফ ও ফাইভ
স্বাগতম নয় জিসান ভাই। আমি আগেরই আজিম। আগের পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ার কারনে ঐ নামে আর লগিন করতে না পেরে এই নামে নতুনভাবে নিবন্ধিত হয়েছি।
জিসান শা ইকরাম
হায় হায় বলেন কি? ফেইসবুকে কি এড আছেন আমার সাথে? না থাকলে এড করে নেন।
দু একজন মডু চিনি আমি,তাহলে এই পোষ্ট আগের আইডিতে দিয়ে দেয়ার অনুরোধ করলে শুনবে তারা।
আর পাসওয়ার্ড সমস্যার সমাধান করা যাইত। আগের আইডির মেইল কি সচল?
শুভ কামনা।
আজিম ফাইফ ও ফাইভ
আমার আগের মেইল সচল। [email protected]
আর মডু চেনেন কী বলেন জিসান ভাই? আপনি আর ছাইরাছ হেলাল ভাই-ই তো এই সোনেলার হর্তাকর্তা, ভুল যদি না করি, তবে আপনারাই তো মডু নিয়োগ দেন। আমার ইমেইল নম্বরে আমি পাসওয়ার্ড নম্বর চেয়ে পাইনি। আবারো দিলাম যদি আগের পাসওয়ার্ড নাম্বার পূণরুদ্ধার হয় এই আশায়।
ধন্যবাদ এবং আপনার জন্যও শুভকামনা।
জিসান শা ইকরাম
মডুদেরকে অনুরোধ করছি আপনার সমস্যা সমাধানের জন্য 🙂
ছাইরাছ হেলাল
এখানে হর্তাকর্তাদের বেইল দেয়া হয় না। এটি কিন্তু খুব অন্যায়।
জিসান শা ইকরাম
পুরাতন আইডিতে স্বাগতম -{@
আজিম
সমস্যা মিটিয়ে দেয়ার জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জনাব জিসান ভাই।
পুরাতন আইডিতে স্বাগতম জানানোর জন্যও ধন্যবাদ। -{@
ছাইরাছ হেলাল
পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির রেয়াজ আমরা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি।
এ আমাদের ব্যর্থতা।
আজিম
এবিষয়ে আমার কোন গাফিলতি থাকলে দু:খিত।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার কথা বলছি না, সামগ্রিক ভাবে চিন্তা করি।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতির লেখা বই পড়েছি, শ্রদ্ধা করারই মত।
ছাইরাছ হেলাল
আমার অবশ্য নূতনটির প্রতি পক্ষপাত ছিল, যাক ব্যাপার না।
প্রশ্নের অপেক্ষা করতেই আছি।
স্বপ্ন
এতটা জানা ছিলনা।ধন্যবাদ আপনাকে এমন পোষ্ট দেয়ার জন্য।
আজিম
আপনাকেও ধন্যবাদ।
অরণ্য
উনার মৃতুর দিনও বিকেলে অফিসের এক আলোচনায় রেফারেন্স টানছিলাম “ছোট স্বপ্ন দেখা অপরাধ”। শ্রদ্ধা এই মহান আত্মার প্রতি।
পাশাপাশি এই পাঠক হৃদয়ের ভাললাগার কার্ভটি ৪৫ ডিগ্রি বরাবর এগোতে এগোতে হুট করে হরিজন্টাল বরাবর চলে গেল শেষের দিকে এসে। এ আমার সংকীর্ণতাও হতে পারে।
আজিম
পড়া এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
ব্লগার সজীব
ভালো লাগলো একজন প্রয়াত মানুষের মূল্যায়ন মূলক লেখা।এই লেখার মাঝে ডঃ ইউনুসকে না আনলেই মনে হয় ভাল হতো। কাগজে পত্রে গ্রামীণ ব্যংকের সাফল্যই দেখান হয়,গ্রামীন ব্যংক যে গরীব নারীদের সবচেয়ে বড় শোষক এটি কখনোই প্রকাশিত হয় না। হবেও না।
আজিম
ড. ইউনূসের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিকে এখানে আনতে আমি চাইনি। কিন্তু টকশোতে এক ব্যক্তি উনার নাম উঠানোর কারনে বিষয়টা বিশদ করার চেষ্টা করেছি মাত্র।
নীলাঞ্জনা নীলা
এমন একজন মানুষ চলে গেলো যিনি স্বপ্ন দেখাতেন, স্বপ্নের কথা বলতেন।
পৃথিবীতে এমন একজন আর আসবে না।
আজিম
এবিষয়ে পাদটিকায় কিছুটা বলা আছে।
শুন্য শুন্যালয়
শ্রদ্ধা রইলো এমন একজন মানুষের প্রতি, যিনি স্বপ্ন দেখাতে জানতেন।
আজিম
জ্বী, এমন মানুষের উপর শ্রদ্ধা থাকতেই হয়।
লীলাবতী
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
আজিম
আপনাকেও ধন্যবাদ।