প্রথম পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
–“এক কাপ চা কি হবে রীনি?” মৌণব্রতর কথায় ফিরে তাকালো রিনীতা । দুপুরে ঘুমোয় না মৌণব্রত , ওই সময়টায় লাইব্রেরীতে বসে । বাড়ী যখন করে , তখন এই লাইব্রেরী ঘরটাও ডিজাইনে রেখেছিলো । মানুষটাকে অনেক জ্বালায় রিনীতা । মৌণব্রত একটু-আধটু রাগ যে করেনা , তা নয় । একবার যদি রেগে যায় তাহলে কথা তো বলবেই না । বরং রিনীতার মনকে পোড়াতে থাকবে । তাই সহজে ঘাটায় না । কষ্টটা তো বেশী পায় মৌনব্রতই ।
–“কি হলো ? এক কাপ চা কি দেবে বানিয়ে ?”
–“না দেবোনা , নিজে বানিয়ে নাও ।”
–“বানিয়ে নিতে পারিনা । না দিলে কি আর করা ! বৃষ্টির মধ্যে পাড়ার ওই দোকানে গিয়ে চায়ের গন্ধ লাগানো জল পান করতে হবে ।”
–“ইস কি কথা ! জল পান !! দাঁড়াও বানিয়ে দিচ্ছি । কিন্তু ঋভু বললো আজ একসাথে নাকি সবাই চা খাবে । পৌষীটা তো এখনও আসেনি । কি যে করে , কোথায় যায় ! কিছু জিজ্ঞেসা করলে চুপ করে থাকে । একটা শব্দ মুখ থেকে বের করতেও যেনো কষ্ট হয় । কথা খরচ যে এতো দামের , সে তোমার মেয়েকে না দেখলে জানতামই না ।”
–“রিনী কেন এমন করো বলোতো ? সেদিন রাতের খাবার খাওয়ার সময়েই তো বলেছিলো আজ ওরা সাত বান্ধবী মিলে আয়োজন করেছে একসাথে ঘোরার । ওর কোন এক বান্ধবীর সামনের মাসে বিয়ে , তাই এই আয়োজন । আজ আমায় কি বলে গেলো জানো ?”
–“কি ?”
–“বাবা তোমরা ছেলেরা বিয়ের আগে ব্যাচেলর পার্টি করতে পারলে মেয়েরা কেন করবে না ? ওরা তো পরিচিত জায়গা ছেড়ে যায়না ! আচ্ছা বাবা তুমি কি ব্যাচেলর পার্টি করেছিলে বন্ধুরা মিলে ?”
–“তা বললে না কেন ? বিয়ের আগের দিন তোমার হবু বৌকে ফোন দিয়ে বলেছিলে , আস্ত একটা ঝামেলা ঘাড়ে উঠলো ।”
মৌণব্রত হেসে ফেললো । রিনীতার এসব কথার জন্যেই এখনও অপেক্ষা করে থাকে সেটা রিনীতাও বোঝে-জানে । রাতের শয্যায় মৌণব্রতর বুকে যখন মুখ লুকিয়ে বলে , “খুব বাজে ব্যবহার করি । কেন কিছু বলোনা আমায় ?” কেন বলেনা কারণ এখনও ওই লজ্জ্বা মাখানো কোমলতর আহ্লাদীকে মনের ভেতর প্রতিদিন নতূন করে সাজিয়ে নিতেই ।
ফিরে এলো পৌষালী । এসেই প্রথম কথা , “বাবা চা খেয়েছো ?” মৌণব্রত বললো , “অপেক্ষা করছিলাম তুই আসবি , একসাথে খাবো ।”
–“বলো মা বানিয়ে দেয়নি । কি যে হয়েছে মায়ের , একেবারে…”
থামিয়ে দিলো মৌণব্রত । “একটা কথাও না মায়ের সম্পর্কে । এবার তুমি যেতে পারো ।”
পৌষালী ভুলে গিয়েছিলো মাকে নিয়ে কোনো কথা বাবাকে বললে মারাত্মক রেগে যায় । এক মুহূর্তে বাড়ীর পরিবেশ একেবারে থমথমে । ঋভু বুঝলো এবার ওকেই মঞ্চে নামতে হবে । “মা সবাই তো এলো । এবার তোমার চা দাও । আর চায়ের সাথে তোমার বিশেষ খাবার কি ?”
রিনীতা আর পিউলী দুজনে মিলে চা আর পুরী ভেঁজে নিয়ে এলো । খাবার টেবিলে সবাই একসাথে , কিন্তু নিঃশব্দে । “কি ব্যাপার আমরা কি সবাই কোনো শোকসভায় এসেছি ? মনে হচ্ছে শোকসভার এক মিনিট নীরবতা পালন করা হচ্ছে ?” ঋভুর কথায় পিউলী হেসে ফেললো ।
–“দাদা তুই না যে কি !”
–“আচ্ছা শোনো একটা খবর জানানো হয়নি । আটলান্টায় একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম ইন্টারনেটে । চাকরীটা পেয়ে গেছি । এতোদিন বলিনি । আজ খবর পেলাম ভিসা হয়ে গেছে । কাল সেটা তুলতে যাবো অ্যামবেসীতে । সামনের মাসের পনেরো তারিখের মধ্যে জয়েন করতে হবে ।”
এক যোগে সবাই চাইলো ঋভুর মুখের দিকে । কানের কাছে বাজ পড়েছে , তাও অমন চমকায়নি রিনীতা । পৌষালী বলে উঠলো , “অভিনন্দন ভাই । দারুণ করেছিস । এ দেশে থাকলে তোর ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যেতো ।”
সবার মুখে-চোখে আনন্দ এ খবর শুনে । যাক অবশেষে ঋভুর একটা অবস্থান তৈরী হলো । মৌণব্রত জানে পৌষালীও কিছুদিনের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাবে । শুধু পিউলীকে নিয়েই একটু চিন্তা । লেখা-পড়া নিয়ে নয় , ক্যারিয়ার গড়ে নিতে পারবে । কেবল চিন্তা জীবনের জটিলতায় । সংসারের মারপ্যাঁচে নিজেকে সামলে নিতে পারবে তো ? রিনীতার মতো হয়েছে একেবারে । রিনীতার অনেক দোষ-ভুলকে আপন করে নিয়ে সহজভাবে বুঝিয়ে দিতো মৌণব্রত । তাই এই সংসারে এখনও খুনসুটি হয় ।
অনেক রাতে সবকিছু গুছিয়ে শুতে গেলো রিনীতা । মৌণব্রত তখনও জেগে । “আচ্ছা ঘুমোওনি কেন ?” প্রশ্নটার উত্তর জানে রিনীতা । আজ অব্দি বিছানায় না গেলে ঘুমোয় না মৌণব্রত । সমস্ত দিনের গল্প হয় , কিছুটা আদর । শারীরিক সম্পর্কটা আদরের কাছে নতজানু হয়েছে । সারাটি দিনের ব্যস্ততা-ছুটোছুটি ঘরে-বাইরে , এই আদরটুকুই মনে শক্তি সঞ্চার করে । বালিশে মাথা রাখতেই বুকে টেনে নিলো মৌণব্রত । “মন খারাপ করোনা ।”
–“না , না মন খারাপ কেন করবো ? এখন ওরা বড়ো হয়ে গেছে । ওদের সিদ্ধান্ত ওরা নিতে শিখে গেছে , এইতো চাওয়া ছিলো আমাদের । আগে আমরা ছিলাম ওদের আবেগী নিরাপত্তার ছায়া । জন্ম দিয়েছি বলেই ওটুকু দায়িত্ত্ব পালন করলো জানিয়ে । এটাই তো নিয়ম ।”
–“ওরা এখনও আমাদের ছায়ার নীচেই আছে রিনী । এই যে পরিচয় , বাবা-মায়ের নাম কখনো কি বদলে দিতে পারবে ? বলো ? সে যেখানেই যাক না কেন !”
রিনীতা চুপ করে রইলো । একটা বাচ্চা মেয়ের মতো মৌণব্রতর বুকে মাথা রেখে চোখ বুজলো । মনে মনে নিজেকে বলে যাচ্ছিলো রিনীতা , “ফিরে আসার জন্যে আর কখনোই ফিরবেনা ঋভু । বৃক্ষ বড়ো হয়ে তার ডাল-পালা ছড়ায় । শেকড় ততোই বিস্তৃত হতে থাকে ।”
–“মৌণ আমায় আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নাও ।”
.
হ্যামিল্টন , কানাডা
২৮ জুলাই , ২০১৪ ইং ।
১২টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
“ফিরে আসার জন্যে আর কখনোই ফিরবেনা ঋভু । বৃক্ষ বড়ো হয়ে তার ডাল-পালা ছড়ায় । শেকড় ততোই বিস্তৃত হতে থাকে ।”
বেশ ভাল লাগছে আপু লিখতে থাকুন।আসলে জীবনটাই এমন ।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়া জীবনটা কেন এমন ?
জিসান শা ইকরাম
এসব নিয়েই আমাদের জীবন।
বাইরে যারা চলে জান, বিভিন্ন বাস্তব কারনের জন্য তাঁদের আর ফেরা হয়না।
ভালো লেগেছে লেখা।
ভালো থাকুন প্রবাসে।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রবাস আমাকে এমন একটি মঞ্চ দিয়েছে , যার জন্যে এখনও লিখতে পারি…দেশে থাকলে হয়তো ছেলের পেছনে ওর হোমওয়ার্ক নিয়ে ঘুরতে হতো…
সীমান্ত উন্মাদ
এটাই হয়ত বাস্তবতা। তোমার গল্পগুলো বেশ ভালো লাগে আপু। শুভকামনা জানিও নিরন্তর ।
নীলাঞ্জনা নীলা
জীবন আমাকে শেখায় ভাইয়া…বুঝলে ?
স্বপ্ন
দুই পর্বে সমাপ্ত গল্পটি ভালো লেগেছে খুব।
নীলাঞ্জনা নীলা
খেয়ালী মনের খেয়ালী গল্প…
মেহেরী তাজ
ভালো লেগেছে খুব নীলাদি। প্রবাসে থেকেও বাংলাকে এমন ভাবে বেঁধে রেখেছেন আপনি। শ্রদ্ধা আপনার প্রতি।
নীলাঞ্জনা নীলা
যতো দূরেই যাই না কেন , শেকড় তো দেশেই আমার…
মোঃ মজিবর রহমান
মানুষ সম্পর্ক হয়ত এরকমই। বুকের ধনকে কেউ হাতছাড়া ও দৃষ্টিপলক থেকে দূরে যেতে দেয়না, কিন্তু তারাও বড় হয়ে তাঁদের প্রিথিবীতে তাঁদের মতই চলবে স্বাভাবিক।
ভাল লেগেছে আপু ।
নীলাঞ্জনা নীলা
১২ বছরের ছেলে আমার , ওর জগতটায় আমি আছি…কিন্তু পরিবর্তন তো হচ্ছে…যেমন একসময় আমারও হয়েছিলো…তাইতো আজ বাবা-মা ছাড়া এখানে এই প্রবাসে…