গ্রিলের ওপাশে এক্‌লা আকাশ

রিমি রুম্মান ২২ জানুয়ারি ২০১৬, শুক্রবার, ১১:৩১:৪৮পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি, গল্প ১৮ মন্তব্য

বছর জুড়ে অপেক্ষার প্রহর গুণে রাহেলা খাতুন। ডিসেম্বরে ছেলে মেয়েদের স্কুল ছুটি হলে বাবার বাড়ি বেড়াতে যাবেন। শৈশব কৈশোরের সেই গ্রাম। দুরন্ত বালিকার দিনভর ছুটোছুটি করা, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া, লবন মরিচ দিয়ে কাঁচা আম আর চাল্‌তা বানিয়ে খাওয়া গ্রাম ! কতকাল শ্বাস নেয়া হয়না জন্মস্থানের চেনা আলো-বাতাসে !
বছর শেষে দীর্ঘদিনের জমিয়ে রাখা স্বপ্ন’রা ভেঙ্গে খান্‌খান হয় রাহেলা খাতুনের। আশাহত হন বৃদ্ধ বাবা-মা। কেননা, স্বামী রহমান সাহেব বুয়া কিংবা অন্য কারো হাতের রান্না করা খাবার খেতে পারেন না। তাঁকে রোজ নাস্তা সেরে অফিসে যেতে হয়। দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে যেতে হয়। পোশাক আশাক হাতের কাছে রেডি থাকা চাই। এতোসব কাজের কোন বিহিত করা হয় না, বিধায় রাহেলা খাতুনেরও যাওয়া হয় না। বাবা-মা’কে আগের মতন উচ্ছ্বসিত চিঠি লেখা হয় না। আশা’র কথাও শোনানো হয় না। 

বৃদ্ধ মা কালে ভদ্রে ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে এলে মাতা-কন্যা’র দেখা হয়। রাত জেগে সুখ-দুঃখের গল্প হয়। অতঃপর অশ্রুজলে বিদায় দেন। রাহেলার আর ফেরা হয়না গাঁ’য়ে। ফেরা হয়না গাছ গাছালী’র ছায়া ঘেরা আম বাগানে। গোল্লাছুট খেলার উঠোনে। তবুও আশায় থাকেন, ছেলেমেয়েরা বড় হলে নিশ্চয়ই যাবেন। স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবেন।
সময় পেরোয়। সন্তানরা বড় হয়। ভার্সিটি পড়ুয়া বড় মেয়েটি রান্না শিখেছে। মায়ের মতোই রান্না। মেজটিও পোশাক-আশাক, এটা-সেটা রেডি করে দেয় বাবাকে। যত্ন-আত্তি করে বেশ। এবার আর রাহেলা খাতুনের বাড়ি যাবার পথে কোন বাঁধা রইলো না। বাবার বাড়ি ! চেনা ঘর !
কিন্তু হায় ! ততদিনে বাবা-মা দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বোনেরা সব শ্বশুরবাড়ি। ভাইয়েরা যার যার সংসারে ব্যস্ত শহরে, বিদেশে। তবুও তিনি এলেন। পাশাপাশি শুয়ে থাকা বাবা-মা’র কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন বিষণ্ণ হয়ে। উঠোন পেরিয়ে পিতৃগৃহের দিকে এগোলেন। তালাসমেত শুন্য ঘরখানা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এঘর ওঘরের চেনা-অচেনা মানুষগুলো দুপুরে রাত্রিতে খাবারের নিমন্ত্রণ করে, সমাদর করে খুব।
বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস আর গড়িয়ে যাওয়া নোনা জল সঙ্গী করে তিনি ফিরে আসেন। ফিরে আসেন ষোল বছর বয়সে শুরু করা সংসারে। পুরনো নিয়মে।
মহা ধুমধামে বড় কন্যা’র বিয়ে দেন। শ্বশুরবাড়ির মানুষজন অনেক আপন করে নেয় নতুন বঁধুকে।
এদিকে রহমান সাহেব এঘর ওঘর পায়চারী করে রাতভর।অন্ধকারে গুমরে কাঁদে পিতৃস্নেহ।নির্ঘুম রাত কাটে।রক্তচাপ বাড়ে। ভেতরটা খালি খালি লাগে। ভীষণ খালি। জীবন থেমে থাকে তাঁর।প্রাণপ্রিয় কন্যাকে ছেড়ে এমন করে থাকা হয়নি তো আগে কখনো !
এতোগুলো বছর পাহাড়সম মমতায় আগলে রাখা কন্যা’র অনুপস্থিতিতে আজ অনুভূতি শুন্য রাহেলা খাতুন।রাতের অন্ধকারে জানালার পাশে পাহাড়ের মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা-মা’র কথা খুব মনে পড়ে। অশ্রুজল চাপা দিয়ে রাখেন ভারী দীর্ঘশ্বাসের নিচে। ভোরের দিকে প্যারালাইজডে আক্রান্ত রাহেলা খাতুন লাঠি ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেলকোনীতে এসে বসেন। টবে যত্নে লাগানো গাছে ছাইরঙা এক শালিক। একপেয়ে শালিক। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মেঝেতে নেমে আসে। রাহেলা খাতুনের বুকের বাঁ পাশে চিন্‌চিনে ব্যথা হয়। গ্রিলের ওপাশে একলা আকাশ। খণ্ড খণ্ড মেঘের বিষণ্ণ আকাশ…

বেঁচে থাকা মানে যদি হয় একলা খুঁড়িয়ে চলা শালিকের জীবন, তবে হ্যাঁ বেঁচে আছেন রাহেলা খাতুন। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ তিনি।
আমরা ভুলে যাই__ আজ যে কন্যা বাবার আদরের দুলালী, আগামী দিনে সে অন্য গৃহে কারো স্ত্রী হবে। কিংবা, আজকের কন্যাহারা বাবা একদিন কারো কন্যাকে এমন করে নিজ গৃহে নিয়ে এসেছিলেন।

আমাদের চারিপাশের অজস্র রাহেলা খাতুনদের সন্মানে লেখাটি লেখা।

৪৪৭জন ৪৪৭জন
0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ