গহীনের ক্ষত

রিমি রুম্মান ৯ আগস্ট ২০১৫, রবিবার, ০১:৫১:৫৭অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩০ মন্তব্য

আমার জন্মশহর ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরের এই শহরে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি। পর্যাপ্ত রুম না থাকায় আমরা স্বামী-স্ত্রী ড্রইং রুমের ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমাই সবাই ঘুমিয়ে গেলে। আবার ভোরে সবাই জেগে উঠবার আগেই বিছানা পত্র গুটিয়ে উঠে যাবার চেষ্টা করি।

এক শুক্রবার স্বামী’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছুটে আসে অন্য শহর হতে। শনি-রবি দু’দিন তাঁদের ডে অফ। দু’দিনের জন্যে আমাদের নিয়ে যাবে সেখানে। ঘুরাবে। শহর দেখাবে। অনেকদিন পর দেখা দু’বন্ধুর। তাঁরা তীব্র উচ্ছাস আর আনন্দে গল্পে মশগুল। আমি গোছগাছ করছি। কিছুটা অসুস্থ বোধ করি। কাউকে কিছু না বলে ভেতরের রুমে পরিবারটির কন্যাদের দো’তলা বেডটিতে নিরবে শুয়ে থাকি। গৃহকত্রী দেখে যারপরনাই রেগে গেলেন। বললেন__ ” তোমার মুখে ব্রন, তুমি কেন আমার মেয়ের বিছানায় শুয়েছো ? বেইজমেণ্টে পুরনো কাপড় আছে, নিজের জন্যে বালিশের কভার বানিয়ে নাও। ”

বলাবাহুল্য, মাটির নিচের রুমটিতে পরিত্যক্ত কাপড় স্তূপীকৃত করে রাখা হতো। যদিও আমি সচেতন ছিলাম যেন আমার উপস্থিতি কারো বিরক্তির কারন না হয়, তবুও আচমকা এমন রুঢ় আচরনে বর্ণনাতীত বিস্মিত এবং লজ্জিত হলাম। মনে হচ্ছিলো, বাড়িটির প্রতিটি ইট একটি একটি করে খসে আমার সমস্ত শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছিলো। আমি জড়সড় হয়ে উঠে বসি। স্বামী এবং তাঁর বন্ধুটির সাথে কানেক্টিকাট নামক শহরের উদ্দেশ্যে বাইরে বেরিয়ে আসি।

সমস্ত পথ দু’বন্ধু পুরনো স্মৃতিচারণে মগ্ন। জানালার ধারে চুপটি করে বসে থাকা আমার ভেতরটা তীব্র সুনামি শেষে লণ্ডভণ্ড শহরের ধ্বংসস্তূপের মতোই আর্তনাদ করছিলো। পাশে থাকা সবচেয়ে কাছের মানুষটিও সেই আর্তনাদ টের পেলো না। ট্রেন ছুটে চলছে একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকি।

চোখের সামনে ভেসে উঠে আমার বাবার বাড়ি। বড় বিছানায় আমি একা ঘুমাতাম। ফ্লোরে আলমগীর নামের ৬/৭ বছরের ছোট্ট কাজের ছেলেটি। রোজ রাতে তাঁকে বলতাম___” এতো বড় বেড… তুই একপাশে এসে ঘুমা “। সে আসতো না। বলতো, ” আফা, মশারীর ভিতরে দম বন্ধ হইয়া আসে “। আমি বুঝি, ফ্লোরের শীতলতা, মুক্ত বাতাস আর মশার কামড়ে সে অভ্যস্ত।

স্বল্পকালীন সময়ের জন্যে আমি যাঁদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা হয়ে ছিলাম এই প্রবাসে, একদিন সেই বাড়িটি ছেড়ে আমরা কাছেই আলাদা বাসায় উঠি। গৃহকত্রী অসুস্থ হয়ে পরেন হঠাৎ। মানবিক মনের মানুষ বাড়ির কর্তা এলেন। অনুরোধ করলেন একবার তাঁর বাড়িতে যেতে। স্বামী অভিমানে যেতে দিতে চায় না। তবুও যাই। ভেতরের রুমটিতে অসুস্থ গৃহকত্রী শুয়ে। আমি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকি ক্ষণিক। কোন এক ব্যাখ্যাতীত কারনে মানুষটির জন্যে মায়া লাগতে থাকে। তবুও অদূরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি মৌনতায়, তিনি না ডাকা অবধি। অবশেষে ডাকলেন। কাছে বসালেন। দু’হাত দিয়ে আমার বাঁ হাতটি চেপে ধরলেন। টুকরো টুকরো কৃতকর্মের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি আবেগে ঈষৎ কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে শুধু বলি___ “আমি কিছু মনে রাখিনি, কষ্ট নেইনি।”

আসলেই কি কিছু মনে রাখিনি ? কিছু কথা, কিছু ঘটনা আমরা মনে রাখতে না চাইলেও মনের গহীনের সৃষ্ট ক্ষত থেমে থেমে মনে করিয়ে দিবে সময়ে অসময়ে…

যে কারনে লেখাটি লিখেছি ___

” three things u cannot recover in life___ the WORD after it’s said, the MOMENT after it’s missed, and the TIME after it’s gone “

১জন ১জন
0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ