আমার জন্মশহর ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরের এই শহরে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি। পর্যাপ্ত রুম না থাকায় আমরা স্বামী-স্ত্রী ড্রইং রুমের ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমাই সবাই ঘুমিয়ে গেলে। আবার ভোরে সবাই জেগে উঠবার আগেই বিছানা পত্র গুটিয়ে উঠে যাবার চেষ্টা করি।
এক শুক্রবার স্বামী’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছুটে আসে অন্য শহর হতে। শনি-রবি দু’দিন তাঁদের ডে অফ। দু’দিনের জন্যে আমাদের নিয়ে যাবে সেখানে। ঘুরাবে। শহর দেখাবে। অনেকদিন পর দেখা দু’বন্ধুর। তাঁরা তীব্র উচ্ছাস আর আনন্দে গল্পে মশগুল। আমি গোছগাছ করছি। কিছুটা অসুস্থ বোধ করি। কাউকে কিছু না বলে ভেতরের রুমে পরিবারটির কন্যাদের দো’তলা বেডটিতে নিরবে শুয়ে থাকি। গৃহকত্রী দেখে যারপরনাই রেগে গেলেন। বললেন__ ” তোমার মুখে ব্রন, তুমি কেন আমার মেয়ের বিছানায় শুয়েছো ? বেইজমেণ্টে পুরনো কাপড় আছে, নিজের জন্যে বালিশের কভার বানিয়ে নাও। ”
বলাবাহুল্য, মাটির নিচের রুমটিতে পরিত্যক্ত কাপড় স্তূপীকৃত করে রাখা হতো। যদিও আমি সচেতন ছিলাম যেন আমার উপস্থিতি কারো বিরক্তির কারন না হয়, তবুও আচমকা এমন রুঢ় আচরনে বর্ণনাতীত বিস্মিত এবং লজ্জিত হলাম। মনে হচ্ছিলো, বাড়িটির প্রতিটি ইট একটি একটি করে খসে আমার সমস্ত শরীর চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছিলো। আমি জড়সড় হয়ে উঠে বসি। স্বামী এবং তাঁর বন্ধুটির সাথে কানেক্টিকাট নামক শহরের উদ্দেশ্যে বাইরে বেরিয়ে আসি।
সমস্ত পথ দু’বন্ধু পুরনো স্মৃতিচারণে মগ্ন। জানালার ধারে চুপটি করে বসে থাকা আমার ভেতরটা তীব্র সুনামি শেষে লণ্ডভণ্ড শহরের ধ্বংসস্তূপের মতোই আর্তনাদ করছিলো। পাশে থাকা সবচেয়ে কাছের মানুষটিও সেই আর্তনাদ টের পেলো না। ট্রেন ছুটে চলছে একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকি।
চোখের সামনে ভেসে উঠে আমার বাবার বাড়ি। বড় বিছানায় আমি একা ঘুমাতাম। ফ্লোরে আলমগীর নামের ৬/৭ বছরের ছোট্ট কাজের ছেলেটি। রোজ রাতে তাঁকে বলতাম___” এতো বড় বেড… তুই একপাশে এসে ঘুমা “। সে আসতো না। বলতো, ” আফা, মশারীর ভিতরে দম বন্ধ হইয়া আসে “। আমি বুঝি, ফ্লোরের শীতলতা, মুক্ত বাতাস আর মশার কামড়ে সে অভ্যস্ত।
স্বল্পকালীন সময়ের জন্যে আমি যাঁদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা হয়ে ছিলাম এই প্রবাসে, একদিন সেই বাড়িটি ছেড়ে আমরা কাছেই আলাদা বাসায় উঠি। গৃহকত্রী অসুস্থ হয়ে পরেন হঠাৎ। মানবিক মনের মানুষ বাড়ির কর্তা এলেন। অনুরোধ করলেন একবার তাঁর বাড়িতে যেতে। স্বামী অভিমানে যেতে দিতে চায় না। তবুও যাই। ভেতরের রুমটিতে অসুস্থ গৃহকত্রী শুয়ে। আমি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকি ক্ষণিক। কোন এক ব্যাখ্যাতীত কারনে মানুষটির জন্যে মায়া লাগতে থাকে। তবুও অদূরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি মৌনতায়, তিনি না ডাকা অবধি। অবশেষে ডাকলেন। কাছে বসালেন। দু’হাত দিয়ে আমার বাঁ হাতটি চেপে ধরলেন। টুকরো টুকরো কৃতকর্মের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি আবেগে ঈষৎ কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে শুধু বলি___ “আমি কিছু মনে রাখিনি, কষ্ট নেইনি।”
আসলেই কি কিছু মনে রাখিনি ? কিছু কথা, কিছু ঘটনা আমরা মনে রাখতে না চাইলেও মনের গহীনের সৃষ্ট ক্ষত থেমে থেমে মনে করিয়ে দিবে সময়ে অসময়ে…
যে কারনে লেখাটি লিখেছি ___
” three things u cannot recover in life___ the WORD after it’s said, the MOMENT after it’s missed, and the TIME after it’s gone “
৩০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
কিছু কথা কিছু ঘটনা ‘আমি কিছু মনে রাখিনি’ বললেও বলাতেই থেকে যায়।
হৃদয়ে পৌছে না।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছে। মনের অজান্তেই মনের গহীনে গেঁথে থাকে কথাগুলো।
আজিম
চলার পথে অনেক দু:খ-কষ্ট পেতে হয়। সব ভোলা যায়ও না।
বরাবরেরই মতো আপনার লিখা সুপাঠ্য।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। নিরাপদ থাকুন। শুভকামনা রইলো। -{@
নীতেশ বড়ুয়া
অভিমান, মুহুর্ত আর শব্দ… সব স্বাভাবিক হয়ে গেলেও এই তিনের কিছুই কেউই ফিরিয়ে আনতে পারে না আর স্বাভাবিকভাবে… প্রায় প্রতিজনেরই এমন তিনের সাথে পরিচয় আছে বোধহয় 🙂
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের, সম্পর্কের যত্ন প্রয়োজন। কেননা জীবন সংক্ষিপ্ত। মানুষ থাকে না হয়তো একসময়। কিন্তু কথা’রা থেকে যায়।
নীতেশ বড়ুয়া
একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কবিতার একটি লাইন আপনার এই পোস্টকে ডেডিকেট করলাম যা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার বিখ্যাত কবিতার প্রথম লাইনঃ ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়’…
রিমি রুম্মান
অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন সবসময়। -{@
শিশির কনা
কিছু দাগ কখনোই মুছে যায় না। ভালো লেগেছে আপনার এমন লেখা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন অনেক অনেক। -{@
জিসান শা ইকরাম
যতই বলি ভুলে গিয়েছি,তারপরেও কিছু কষ্ট থেকেই যায় মনের গহীনে।
সব সময় ব্লগের মন্তব্য আপনার ফেইসবুকে কপি পেস্ট করি।আজ ফেইসবুকের মন্তব্য এখানে কপি পেস্ট।অবাক হয়ে দেখি ‘ গহীন ‘ শব্দটি আপনার লেখার শিরোনামে।
রিমি রুম্মান
বাহ্ ! কেমন করে মিলে গেলো ! 🙂
সীমান্ত উন্মাদ
আপু আমদের সবার জীবনেই এমন কিছু কষ্টের কথা আছে যা মুখে যতই বলি ভুলে গেছি মনে রাখিনি কিন্তু সত্যিটা হল শরীরের ক্ষত হয়ত পুরুপুরি শুকিয়ে যায় কিন্তু মনের ক্ষত না।
অনেক অনেক শুভকামনা জানিবেন নিরন্তর। আমি জানি সেদিনের কষ্ট আপনি ভুলেননি আর ভুলেননি বলেই আজ বাইজান্টাইন সম্রাজ্ঞীর মত সুখের সাগরে ভাসছেন এবং অনুভব করতে পারছেন।
রিমি রুম্মান
ভাল বলেছেন। ভাল থাকুন নিরন্তর। 🙂
লীলাবতী
” three things u cannot recover in life___ the WORD after it’s said, the MOMENT after it’s missed, and the TIME after it’s gone “ বিক্ষিপ্ত ভাবে এসব জানতাম, আপনার এখানে তিনটি জিনিস একই সাথে পড়লাম।আমরা না বললেও দাগ থেকেই যায় মনে।
রিমি রুম্মান
যে কথা একবার বলা হয়ে যায়, তা কি কখনো ফিরিয়ে নেয়া যায় ? ভাল থাকুন। -{@
মেহেরী তাজ
🙁 থাক আপু ভুলেই যান, তআআ না হলে বেশশ কষ্ট পাবেন।
রিমি রুম্মান
ভুলেই গিয়েছি। আদৌ কি ভুলে যাওয়া হয় ?
খেয়ালী মেয়ে
এমনকিছু কথা/ব্যবহার চাইলেও কখনো ভুলে থাকা যায় না–তারপরও আমরা ভালো কিছুর আশায় এমন ঘটনাগুলো ভুলে থাকার অভিনয় করি–আর এতে যদি কাউকে স্বস্তি দেওয়া যায় মন্দ কি!!!
রিমি রুম্মান
সেটাই মুল কথা। আমরা ভুলে যাবার অভিনয় করি প্রতিনিয়ত, ভাল থাকবার আশায় … ভাল রাখবার আশায়।
ব্লগার সজীব
কিছু ক্ষত কখনো মিলিয়ে যায়না।মাঝে মাঝে আমাদের অনুভবে জেগে ওঠে।
রিমি রুম্মান
কিছু ক্ষত না চাইলেও মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে যায়।
তানজির খান
নীলা আপি আজ দুপুরে আমাকে টেক্সট করে জানিয়েছিলেন আমি যেন আপনার আজকের এই লেখাটা পড়ি। ভেবে ছিলাম লেখাটা খুব ভাল, তাই পড়তে বলেছেন। এখন দেখলাম এটা কোন লেখা না,এটা একটা সংগ্রামী জীবনের ক্ষুদ্র অংশ। এই ক্ষুদ্র অংশটুকুই আমাকে বেঁচে থাকতে ,লড়াই করতে ভিষন ভাবে অনুপ্রাণিত করলো। ভাল থাকবেন আপু। আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
কিছু আঘাত… কিছু ধাক্কা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। ভাল লাগলো জেনে যে, লেখাটি কোন ভাবে কাউকে নাড়া দিয়ে গেলো। ভাল থাকুন আপনিও।
অলিভার
সময়ের পরিবর্তন ঘটে, শুধু পরিবর্তন আসে না ফেলে আসা সময়ের স্মৃতিতে।
তবুও মানুষ বলে প্রকাশ করতে হয় “ভুলেছি” নিজেকে কিংবা অন্যে..
সামনের সময়ের জন্যে শুভ কামনা থাকলো 🙂
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও। শুভকামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
অনেক চাপা কষ্ট অনুভব করছি। অনেক বেশী।
মানুষের জীবনে কতো কিছু যে ঘটে যায়, না বললে কেউ বোঝেনা।
আবার জেনেও দেখা যায় অনেকেই বোঝেনা।
রিমি আপু এতো কঠিন আর নির্দয় হয়ে কিভাবে পারে মানুষ? একবার আমার মনে আছে মামাতো ভাই দুষ্টুমী করেছিলো, ছোট ছিলো। কিন্তু মেজাজ ছিলো খারাপ বেশী রাগ করে বললাম বের হ বাসা থেকে।
বলেই পরে মনে হলো, ছিঃ এটা কি বললাম? যদিও ওটা কথার কথা ছিলো। ভাইকে বলি তোর মনে আছে? বলে আরে ধ্যৎ দিদি তুমি কবে থেকে এতো ফরমাল হয়ে গেলে?
কানাডায় এসে বাসা নিলাম। দেশ থেকে একটি ছাত্রী এসে থাকলো। দুই বেডরুম ছিলো, ছেলের বাবা তখন দেশে। ছেলেকে নিয়ে আমি শুতাম, বাপ্পীকে ছেলের রুমটা দিয়েছিলাম। কতো বকেছি, রাগ করেছি। তারপর অনেক মজা করতাম তিনজনে। ওর জন্মদিন জেনে সারপ্রাইজ দিলাম। কি খুশী!
অনেক মিস করি মেয়েটাকে। আর এও সত্যি কখনো ওকে পর ভাবিনি। ভাড়া দিতো, কতোবার না করেছি, নিতাম না। তাও জোর করে দিতো। দিব্যি-টিব্যি দিয়ে। পারিনি নির্দয় হতে। পরিবারের সদস্য ছাড়া কখনোই আলাদা ভাবিনি। দেশে যাবার আগে হ্যামিল্টন এলো। শুধু আমার সাথে দেখা করতে। এখনও কথা হয় ফোনে।
আপনার লেখা পড়লে অনেক কিছু লিখে ফেলি নিজের জীবনের। বিরক্ত হোন না তো?
ভালো থাকুন নিরন্তর। ঈশ্বর আপনাকে আনন্দে রাখুন। -{@ (3
রিমি রুম্মান
আমাদের জীবনটায় কত কি ঘটে যায়। কত কি আমরা ভুলেও যাই। কিন্তু কিছু ঘটনা ভুলে যেতে চায় না মন থেকে। তবে জীবনে এমন ঘটনাগুলো আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যায় অনেক কিছুই। আমার বাসায় দেশ থেকে নতুন আসা অনেকেই ঠাই নেয়। কিছুদিন পর চলার মত একটি জব পেলে চলেও যায় আলাদা বাসায়। সেই স্বল্পকালীন সময়ে ওদের যেন কোন কষ্ট না হয়, আমি সচেতন থাকি। কেননা, ওদের মাঝে আমি যে আমারেই খুঁজি । ভাল লাগলো আপনার ঘটনাগুলো শেয়ার করাতে। ভাল থাকুন প্রাবাসে সবসময়। (3
শুন্য শুন্যালয়
এমন কিছু মানুষ আছে আপু। ঠিক এমনি কিছু ক্ষত আমার মধ্যেও রয়েছে। ক্ষত রয়েছে, তবে ক্ষমা করে দিয়েছি তাদের। তবে ক্ষমা আর ভুলে যাওয়া এক নয়। এ অভিজ্ঞতাগুলোর প্রয়োজন আছে জীবনে, নইলে এমনি করে আপনার মতো খাঁটি সোনা হয়ে উঠবেনা তা।
রিমি রুম্মান
মন থেকে মুছে যেতে না চাইলে সেটা ক্ষমা’র পর্যায়ে পরে কিনা জানা নেই। যদি সেরকমটি হতো, ভাল হতো। কেননা, ক্ষমা একটি মহৎ গুন।