ফয়সাল এর আগে কখনো একা একা শহরে আসেনি। যদিও শহরটা তার গ্রামের কাছাকাছি তবুও বিভিন্ন কারণে আসা হয়নি তার। ফয়সালের বয়স আঠারো বছর তিন মাস বারো দিন, সবচেয়ে অবাক ব্যাপার এতটা বয়সে বাবা মাকে ছেড়ে সে একা একা থাকেনি কোথাও কোনদিন।
ভীষণ রকম মা বাবা নির্ভরশীল ছেলে সে। একমাত্র ছেলে হবার কারণে সম্ভবত এমনটা। জহির ও সাবেরার চোখের মণি যাকে বলে, একটু সময় ছেলেকে না দেখলে কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠেন তারা।
এইচ এস সি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত খোঁজ খবর নিতে চাচাতো ভাই রবিনের সাথে এক বিকালে সে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।স্বাভাবিক ভাবে জহির সাবেরা দম্পতির বিষন্ন মনে অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে ছেলেকে বিদায় দেন।
পথে তেমন সমস্যা না হলেও হঠাৎ করে গাড়ির ইঞ্জিণ বিকল জনিত সমস্যার কারণে তারা শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে যায়।
মফস্বল শহর, সেই কারণে হয়তো রাস্তায় লোক চলাচল কম।রিক্সা না পাওয়াতে তারা দু’ভাই কিছুটা হেটে গন্তব্যে পৌছে গেলো অল্প সময়ের মধ্যে। একটু দ্রুত হেটে তারা পথটুকু অতিক্রম করলো কারণ আকাশ জুড়ে তখন ঘণ কালো মেঘ।যখন তখন বৃষ্টি চলে আসতে পারে।
গলির ভিতরে ছোটখাটো দোতলা বাড়ি । এখনো নির্মাণাধীন।রবিন মোটামুটি ফ্রিতে এখানে থাকে। বাড়িওয়ালা তার মামার বন্ধু হবার সুবাদে বাড়ির কাজ দেখাশোনার বিনিময়ে সে এই বাড়িতে থাকে আর কি। কেয়ারটেকারের কাজটা তাকে দিয়ে দিব্যি চলে যায়।
যাহোক বাড়ি দেখে ফয়সালের বেশ পছন্দই হলো। পাড়াটিও নিরিবিলি বলে মনে হলো। যদিও এতো রাতে ভিতরের দিকে রাস্তায় লোকজন না থাকাটা স্বাভাবিক।
তালা খুলে বাসায় ঢুকে আলো জ্বালতেই রবিন একটা জরুরি কল পেয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল তাড়াহুড়ো করে। যাওয়ার আগে বলে গেলো আমি এক্ষুনি আসছি। একটা জরুরী কাজ আছে, ফ্রিজে খাবার রয়েছে তুই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গ্যাসে খাবার গরম করে খেয়ে নে।আমি এক্ষুনি আসছি ।
ফয়সালের যদিও একটু ভয় ভয় করছিলো।তবে সেটা সে প্রকাশ করলো না।পাছে রবিন হাসাহাসি করে । এমনিতে সে মায়ের আঁচলে থাকে বলে তাকে নিয়ে আত্নীয় স্বজনের সবাই হাসা হাসি করে। নানা রকম টিকা টিপ্পনী কাটে সবসময়।
সে ঢোক গিলে শুধু বলল,
-ভাইয়া তুমি দেরি করোনা।
– আরে না ভয় কি ? পুরো বাড়ি ফাকা কেউ নেই তুই নিশ্চিন্তে থাক আমি যাবো আর আসবো।
বাসাটা বেশ বড় বলে মনে হচ্ছে। মেঝেটা অমসৃণ ।দেয়ালগুলোতে রঙের প্রলেপ পড়েনি এখনও। প্রথমে ফয়সাল চারদিকে এক নজর
ওয়াশরুমে ফ্রেস হতে হতে একবার মনে হলো গোসল করতে পারলে ভালো হতো। আজ বেশ গরম পড়েছে। কিছুক্ষণ পরে তোয়ালে নেবার উদ্দেশ্য দরজা খুলতেই খেয়াল করলো মিষ্টি একটা গন্ধে ঘরটা ভরে গেছে।
ফয়সাল অবাক হলো? পারফিউমের গন্ধ এটা নিশ্চিত। পরিচিত কোন ফুলের এমন সুবাস নেই।বাসায় তো অন্য কেউ নেই। তাহলে? যাহোক সে গোসল সেরে বুঝতে পারলো যে তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
সাত পাঁচ না ভেবে সে খাবার গরম করতে রান্নাঘরে ঢুকলো।বাসায় থাকতে সে মায়ের রান্নাবান্নায় অনেক সাহায্য করে দিতো সেহেতু অভ্যাস থাকার কারণে চুলা জ্বালিয়ে খাবার গরম করতে তার খুব একটা অসুবিধা হলো না।
খেতে বসেছে হঠাৎ তার মনে হলো ঘরের ভিতরে কেউ একজন নূপুর পায়ে দিয়ে হাটছে। সে পিছন ফিরে এদিক ওদিক চাইলো।
না কেউ নেই। সে কি ভুল শুনছে? এখন অবশ্য আওয়াজটা আর নেই। আশ্চর্য! নূপুরের আওয়াজ কোথেকে আসবে?
কিছুক্ষণ কান খাড়া করে নিজেকে নিজেই বোকা ভেবে বকা দিলো তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলো সে।
তখন খাওয়া প্রায় শেষ। বেসিনে যাবে হাত ধুতে। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। এরকম মনে হচ্ছে কেন? কি হচ্ছে কি তার সাথে?
এরকম হবার তো কথা নয়? সেতো দরজা লক করে ছিটকিনি তুলে দিয়েছে।তাহলে?
যাহোক সে খাওয়া শেষে আবোল তাবোল চিন্তা বাদ দিয়ে ব্যাগ খুলে একটা গল্পের বই বের করলো । তবে কিছুতেই বইয়ে মন বসাতে পারলো না।মনের মধ্যে কেমন যেন অশান্তি অশান্তি লাগছে।
কষ্ট করে বইয়ের ক’পাতা পড়েছে সবে হঠাৎ তার কানে মেয়ে কণ্ঠের গুণ গুনিয়ে গান গাওয়ার আওয়াজ ভেসে এলো। ভারি মিষ্টি গলা তো!কিন্তু এখানে গান গাইবে কে?
নাকি সে ভুল শুনছে?
এবার কিন্তু সত্যি সত্যি তার কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো। অনেক গুলো ঘটনা ঘটে গেছে যার কোন ব্যাখ্যা সে পাইনি।এমন হবার কারণ কি?
ঘরে কি কেউ আছে?
এসব ভাবতে ভাবতে বলা নেই কওয়া নেই দুম বিদ্যুৎ চলে গেল।
[২]
এবং কাছাকাছি সময়ে ঝড় উঠলো তারপর শুরু হলো বৃষ্টি।
বৃষ্টি দমকা হাওয়া সাথে করে ঘর অবধি এসে পৌছাচ্ছে ,জানালাগুলো বন্ধ করে দেওয়া দরকার তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো জানালা খুলল কে? নাকি খোলা ছিলো।
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফয়সাল দেখলো কেউ একজন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো এবং দ্রুত গতিতে জানালার কপাট বন্ধ করতে লাগলো আর সেই সাথে একটু আগের পারফিউমের গন্ধটাও নাকে এসে লাগলো। কি আশ্চর্য নূপুরের আওয়াজটাও ফিরে এসেছে।
কে ? কে ওখানে ?
ফয়সাল চেষ্টা করলো কথাগুলো বলতে কিন্তু কে যেন তার গলা চেপে ধরেছে মনে হলো । ক্রমশ তার গলার ভিতরটা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে। ভয়ে আতঙ্কে সে খুব দ্রুত জ্ঞান হারালো।
তারপর যখন তার জ্ঞান ফিরে এলো তখন প্রথমে সে চোখ মেলে দেখলো তার চাচাতো ভাইয়ের উদ্বিগ্ন মুখ।সে বেচারাও খুবই চিন্তিত তা বোঝা যাচ্ছে তার চোখে মুখ দেখে।
ডাক্তারের কথা শুণে ফয়সাল সব ঝেড়েঝুড়ে ধড়মড়িয়ে ঠেলে উঠলো্ ডাক্তারকে তার দারুণ ভয় কারণ ছোটবেলাতে একবার ইনজেকশান পুশ করা নিয়ে হুলুস্থুলুস কান্ড ঘটে ছিলো।
ঘরের মধ্যে সে রবিন ভাইয়া আর অচেনা একজন স্ত্রীলোক। এই মেয়েটি সেই মেয়েটি কি? যাকে দেখে সে ভয় পেয়েছিলো?
রবিন আবার জানতে চাইলো
-আর ভয় লাগছে?
ফয়সাল মাথানোয়ালো । এখন তার ভীষণ লজ্জা লাগছে তবে অচেনা মেয়েটি কে জানতেও ইচ্ছে করছে।
রবিন মনে হয় ফয়সালের মনের ভাব বুঝতে পারলো।একে চিনেছিস?
ফয়সাল মাথা নাড়ালো। রবিন হো হো করে হেসে উঠলো তাই তো তাইতো চিনবি কি করে পরিচয়ই তো করে দেইনি।
যাহোক এবার আসল কথায় আসা যাক, বৃষ্টি তখনো পড়লেও বিদ্যুৎ চলে এসেছে , ফয়সালও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।পূর্ববর্তী ঘটনা এরকম।
রবিন মায়ার কাছ থেকে ফোন পেয়ে সেই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে বাড়িতে খুব দ্রুত চলে এসেছিলো। মায়া হচ্ছে সেই অজানা অচেনা নারী মূর্তি।
আসলে সে ভূত বা প্রেত কোনটাই নয়। সে রবিনের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী । এই বউয়ের কথা বাড়িতে তো নয় এমন কি ফয়সালকেও জানাইনি রবিন, মায়াকে সে মাত্র কিছুদিন হলো বিয়ে করেছে।
বিয়েতে মায়ার পরিবারের পূর্ণ সম্মতি ছিলো সে কারণে রবিনকে তেমন একটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি তবে সমস্যা একটা আছে তা হলো মায়ার পরিবার তথাকথিত নিচু বংশ যা রবিনের বাবা বেঁচে থাকাকালীন এই বিয়ে মেনে নেবে কিনা সন্দেহ।রবিন আধুনিক ছেলে সে এই বংশ জাত পাতের ধার ধারে না।কিন্তু তার বাবা এবং পরিবার সমাজ নিয়ে চলেন।তাই সাহস করে রবিন আর বাড়িতে এই মেয়ে বা তাকে বিয়ের কথা তুলতে পারেনি।
যদিও রবিনের বাড়ি পর্যন্ত কানাঘুষো পৌঁছে গেছে রবিন নাকি শহরে কোন এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। বিয়ের কথাটা অবশ্য কেউ জানে না।
তো রবিন বাড়িতে যাবার আগে বৌকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।কারণ মায়ার খালি বাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না ভেবে।আর মায়াও কদিন ধরে বাবার বাড়ি যাবে বলে বায়না করছিলো।
মায়া আজ বিকালে রবিন আসছে বলে বাড়িতে ফিরে আসে রবিনকে চমকে দেবে বলে । এখানে এসে গোসল খাওয়া দাওয়া শেষে একটু ঘুমিয়ে পড়ে।
আর এদিকে কমন চাবি দিয়ে ডোর লক খুলে রবিন ও ফয়সাল ঘরে ঢোকে এবং তৎক্ষনাৎ রবিন সাম্যের জরুরি কল পেয়ে বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশে। সাম্য রবিনের ছোটবেলার বন্ধু।
ফায়সাল যখন ওয়াশ রুমে তখন বাড়িতে কে এলো দেখার কৌতূহলে মায়া ডাইনিং রুমে ঢুকে। সেই মুহূর্তে রবিন ফোন দেয় মায়াকে, মায়া জানায় সে বাড়িতে ফিরে এসেছে। তখন রবিন জানায় যে তোমার এখন ফায়সালের সামনে যাওয়ার দরকার নাই। আমি বাসায় ফিরে সব ম্যানেজ করবো। তুমি নিজের ঘরে থাকো। না হলে ফয়সাল এমনিতে লাজুক মুখচোরা ছেলে ও তোমাকে হঠাঃ দেখলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে।আর সে কারণে পাশের ঘর থেকে মায়া আর বাইরে আসেনি। তবে ঘরের ভিতরে হাঁটা চলার আওয়াজে পায়ের নূপুর বেজেছে। আর স্বভাব সুলভ কারণে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠেছে নিজের অজান্তে যা শুণে ফয়সাল বিভ্রান্ত হয়েছে।
আর সব শেষে
বিদ্যুৎ চলে যাবার পর ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে জানালা বন্ধ করতে মায়া এঘরে ঢুকলে ফয়সাল মায়াকে ভুত ভেবে অজ্ঞান হয়ে যায়।
সবশুনে ফয়সাল সত্যি সত্যি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো। আর ভাবতে লাগলো সে এতো বোকা কেন?
হা হা হা সত্যিকারে ভূত না ভাইয়া। আমি অবশ্য কোনদিন ভুত দেখিনি তবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কল্পনা করে ভূতের ভয় পেয়েছি অনেক তবে সেটা ছোটবেলাতে।এখন আর ভয় পাই না।
# নানা ব্যস্ততায় ব্লগে আসা হয় না। তবে যখন মন চায় তখন আর দেরি করি না। এই যেমন এখন চলে এলাম।
ভালো থাকুন প্রিয় ভাই।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইলো।
১২টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ মজার গল্প প্রিয় ইসিয়াক দা অনেক শুভেচ্ছার রইল
ইসিয়াক
ধন্যবাদ লিটন ভাই। ভালো থাকবেন। শুভসকাল।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভাইয়া খুব ভালো লাগলো। ভূতের ভয় আমার ও আছে তবে এখন পর্যন্ত সত্যতা পাইনি। খালি বাড়িতে, অন্ধকারে আমি থাকতেই পারিনা। নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
ইসিয়াক
আমিও ছোটবেলাতে ভূতের খুব ভয় পেতাম। একলা ঘরে গেলে মনে হতো কেউ আমার পা ধরে টানতে আসছে…………
মন্তব্যে ভালো লাগা জানবেন।
শুভকামান রইলো দিদিভাই।
ফয়জুল মহী
একটি মনোমুগ্ধকর রচনা রচিলেন প্রিয়।
বিমোহিত বরাবরের মত আপনার রচনায়
ইসিয়াক
ধন্যবাদ মহী ভাই। শুভকামনা সতত।
তৌহিদ
প্রথমে ভেবেছিলাম সত্যিকারের ভুত, এতো দেখে মানব ভুতের অসাধারণ গল্প। বরাবরি আপনার লেখা ভালো লাগে ভাই।
মাঝেমধ্যে কই ডুব দেন? নিয়মিত পাইনা আপনাকে ভাই। ভালো থাকুন।
ইসিয়াক
হা হা হা সত্যিকারে ভূত না ভাইয়া। আমি অবশ্য কোনদিন ভুত দেখিনি তবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কল্পনা করে ভূতের ভয় পেয়েছি অনেক তবে সেটা ছোটবেলাতে।এখন আর ভয় পাই না।
# নানা ব্যস্ততায় ব্লগে আসা হয় না। তবে যখন মন চায় তখন আর দেরি করি না। এই যেমন এখন চলে এলাম।
ভালো থাকুন প্রিয় ভাই।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমিও ভুতে ভীষন ভয় পাই। একা থাকলে এমন হয়॥ ভাবীর সাথে পরিচয় হোক। আমি চা খেয়ে আসি ভাই।
লেখা ভালো লেগেছে॥ শুভ কামনা রইলো।
ইসিয়াক
একা একা চা খেলে কিন্তু চোখ লেগে যাবে আপু। আমাকেও এক কাপ দিয়েন।
মজা করলাম। লেখা ভালো লেগেছে জেনে অনুপ্রাণিত হলাম আপু। নববর্ষের শুভেচ্ছা রইলো।
আরজু মুক্তা
আমার আবার ভয়ডর কম। মজাই পেলাম
ইসিয়াক
ভালো থাকুন সবসময়। পাঠে ও মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা জানবেন আপু্ ।
নববর্ষের শুভেচ্ছা রইলো।
শুভকামনা