
কান্নারা সব তখন আমার গলায় দলা বেঁধে অপেক্ষা করছে বেরুবার। তন্ময় কি বুঝেছিল জানিনা। ন্যাড়া মাথায়, মলিন আধমরা একটা গোলাপ হাতে আমার সামনে সামান্য ঝুঁকে এলো। পৃথিবীতে বোধহয় এই প্রথম কেউ এভাবে প্রেম নিবেদন করছে।
‘I love you so much,,, Never leave me.’
উত্তর কি হবে আমার জানা নেই! কারন আমি তো তাকে ছাড়ছি না, সে নিজেই মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমাকেই ছাড়তে বসেছে। বলতে পারলাম না কিছুই শুধু আজও আমার হাঁচি এলো। আমি গোলাপ হাতে হাসপাতালের বেডে তাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।
আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়তেই তার সাথে ভারচুয়ালি পরিচয় হয়েছিলো। এখন সে জাহাঙ্গীর নগর, আমি ইডেন কলেজ। আমরা দেখা করবো বলে ঠিক করলাম। নির্জন দুপুরে তন্ময় একগাদা ফুল হাতে হাজির! কেমনে জানলো আমার কৃষ্ণচূড়া পছন্দ? আমি ফুল হাতে নিতে গিয়ে পরপর তিনবার হেঁচে দিলাম। এমন কেন হলো বুঝলাম না? সে অপ্রস্তুত না হয়ে বললো হাঁচি আল্লাহর রহমত তাই ’আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে হয়। বিয়েতেও আমরা তিনবার ’আলহামদুলিল্লাহ’ বলি। তো আর কি? হয়ে গেলো বিয়ে! হা হা হা হা
মজার মানুষ, মুহূর্তেই কারও মন জয় করে নিতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা। আমি তেমন কিছু বলতে পারলাম না। কিন্তু মনে মনে ঠিক করলাম এ ছেলেকেই বিয়ে করবো। এরপর ছ’বছরের প্রেমে হাঁচির ভয়ে সে কখনই ফুল আনেনি। আমিও বলিনি,ভেবে রেখেছি বিয়ের রাতে সব ফুল নেব তার কাছে। যতই হাঁচি আসুক, প্রয়োজনে সারারাত ফুলের উপর বসে হাঁচতেই থাকবো।
পরিবারের মোটামুটি সবার তাকে পছন্দ। ছেলে ভালো, সরকারী চাকুরী হয়েছে। বাবা আর বুবু বেঁকে বসলেন একটু সময় নেবেন। অবশ্য অন্য কারনও ছিলো বুবু তখনও বিয়ে করেননি। বুবু যেহেতু তার সাথেই চাকুরী করে, সব জানতেন। তন্ময়ের চাকরীই একমাত্র ভরসা। তাই তাঁর আর্থিক অস্বচ্ছলতায় বুবু শঙ্কিত ছিলেন। তাছাড়া আমারও পড়াশুনা শেষ হয়নি।
কিন্তু তন্ময় ভীষন জেদ করছিলো কারন একমাত্র ছেলে হওয়ায় তার বাড়ি থেকেও প্রেসার ছিলো। আর সবচেয়ে বড় যেটি তা হলো তার নাকি মনে হতো এখুনি বিয়ে না হলে আমাকে সে হারিয়ে ফেলবে। অবশেষে বড় মেয়ে রেখেই বাবা আমার বিয়ে দিলেন। তবে শর্ত দিয়ে, আমি যতদিন পড়াশুনা শেষ না করি ও জব না পাই ততদিন উঠিয়ে দেবেন না। এমনকি বুবু তখনও যেহেতু ব্যাচেলর তাই আমাদের ঘন ঘন দেখাও করা যাবে না। তন্ময় সব মেনে নিলো।
আমাদের বিয়ে হলো, ফুলশয্যা হলো না। রাতেই সবাই চলে গেল। আমার ছ’বছরের ফুল বাকিই রয়ে গেলো।আমি যেহেতু ইডেন কলেজের হোস্টেলে থাকি , কদিন পর চলে গেলাম। এক সন্ধ্যায় লুকিয়ে তন্ময় হাজির। সেদিন দুজনে হারিয়ে গেলাম এবং ফুলহীন আমার প্রথম ফুলশয্যা হলো আটশ টাকার হোটেল রুমে। তাতেই আমি ভীষন খুশি।
তারপর গতদুবছর আমাদের এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে সংসার চলছিল। দুবছরে দেখা হলো মাত্র আটাশ দিন। অবশ্য এক একটি দিন একটা বছরের সমান। কম দেখা করার অন্য কারন একমাত্র উপার্জনক্ষম তন্ময় চাইলেই আমার কাছে যেতে পারতো না। হোটেলে থাকা, বাইরের খরচ করার সামর্থ্যও তার ছিলো না। আর করোনায় আমার কলেজ বন্ধ থাকায় আরও বিপদ! চাইলেই কোথাও যাওয়া যায় না।
আমাদের দেখা হয় কিন্তু প্রেমের ঘোর না কাটতেই তন্ময় চলে যায়। বিদায় দিতে গেলেই যেন বুকের হাঁড় পাঁজর, দম আটকে যায়। এরচেয়ে কষ্টের বোধহয় কিছুই নেই। কাউকে ভালোবাসি, সে আমার অথচ তাকে পুরোপুরি কাছে পাচ্ছি না। অদৃশ্য দেয়াল যেন মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাডিয়ে আছে।’
ঈদের পরদিন তন্ময় এলো বাবাকে নিয়ে দাওয়াত খেতে। বাড়ি ভর্তি মানুষজন আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম কখন তাকে একা পাবো। সুযোগ এলো, সন্ধ্যায় হাওয়া খাবার অজুহাতে আমরা গেলাম পুকুর পাড়ে। কতদিন পর দেখা ঘন অন্ধকারে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। তবুও নিজের অযাচিত আবেগী শব্দকে দমন করলাম।
পরদিন সকাল থেকে তন্ময়ের ঘাডে প্রচন্ড ব্যাথা। অপরাধী চোখে বারবার ইশারায় ক্ষমা চাইলাম। সে হেসে বললো, রাতে বেশ কজন একই খাটে ঘুমিয়েছিলো। নড়াচড়া করতে পারেনি বলেই হয়তো এমন হয়েছে। তবুও মনের খচখচানি কারন বাড়ি যাবার পরও দুদিন ব্যাথা যায় না।
অবশেষে ডাক্তার দেখাতেই হলো। রিপোর্টে ডাক্তার বলে দিলো ব্লাড ক্যানসার। আমি শুনে অনেকক্ষন হাসলাম, যতোসব ভুলভাল রিপোর্ট। দ্বিতীয়বার টেষ্টেও একই রিপোর্ট। ইমিডিয়েট পিজিতে যেতে হবে।
হঠাৎ পৃথিবীটা ফাঁকা হয়ে গেলো। সেদিন আর মা- বাবা বোন কারও বাঁধা-নিষেধ মানতে ইচ্ছে হলো না। প্রথম সাহস এলো তার সাথে হাত ধরে বেডিয়ে যাবার। পিজিতে তার সাথে আমিই গেলাম। সেখানকার রিপোর্ট এলো, হ্যাঁ সত্যিই তাই! আমি কি অপরাধ করেছি মাবুদ, তুমি আমার ভালোবাসাকে এভাবে কেড়ে নিতে চাইছো?
তন্ময়কে তিনদিন স্যালাইন, রক্ত দিলো। বাইরে নিতে পারলে ভালো, না হলে তৃতীয় দিন থেকে কেমো দেয়া শুরু হবে। তার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই এসে চুল ফেলে দিলেন। আমার মানুষটা হঠাৎই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলো। মাথা ভর্তি যে চুল রেগে গেলেই টেনে ধরতাম তা নিচে পরে রইলো। সবাই তার উপর দিয়ে কেমন করে হাঁটছে। কথা বলার সময় আর তার চুল উড়ছে না। অসহায় শিশুর মত সবার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
হাসপাতালের একটা ছোট্ট রুমে শুরু হলো আমাদের কাঙ্খিত সংসার। তন্ময় আর আমি কতবার যে এমন একান্ত সময় কামনা করেছি। অথচ আজ যখন কাছে পেয়েছি তখন চোখে শুধু পানি, হতাশা, হাহাকার!
এতটাকা কোথা থেকে আসবে বলে ভাবছিলাম। অথচ সে টাকা আসছে উড়ে উড়ে। তার গ্রপের বন্ধু,ভার্সিটি, শিক্ষকসহ সবার কাছ থেকে। আজ দৈন্যতা হার মানলো অথচ যার জন্যই আমাকে উঠিয়ে দেয়নি।
কিন্তু সময়? সে কি হার মানবে? আমি প্রত্যেকটা সময় গুনতে লাগলাম, তাকে ফিরে পাবার আশায়। হাসপাতালে বুবুও এসেছে, খুউব দৌড়াচছে। বোনের ভবিষ্যত যে টাকা নয়, নিয়তি। সেটা ভেবে হয়তো কষ্টও পাচ্ছেন। বাবাও লুকিয়ে কাঁদছেন। শুধু আমি কান্না ছেড়ে দিয়েছি। সমস্ত কৃষ্ণচূড়া তার হাত থেকে নেবার অপেক্ষায় থাকবো অনন্তকাল। আর তন্ময়কে কথা দিয়েছি- ‘I’m not gonna leave him, Never.’
পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান ভালোবাসা, প্রেম ও প্রেমিক।যা হিসেব করে হয়না, সাজিয়ে- গুছিয়ে হয়না। পাওয়ার সাথেই বুকের সাথে লেপ্টে, হুটহাট যখন তখন এটাতে ডুব দিতে পারলেই জীবন স্বার্থক। কারন হারিয়ে যাবার আগে তাকে ছুঁতে পারে ক’জন!!!!
“আচান বহত হ্যায় হ্যায়না খোদা,,
মেরী তারহা তুভি জিকে বাতা।
কিছমাত জো মেরি তুনে লিখি হ্যায়,,
একরোজ ইসপে চালকে বাতা!
জ্বালতে হ্যায় মুঝম্যায় শোলে জো বানকে,,
তু ফির কাভি ইনছে জ্বালকে বাতা।
আজা ফালাক ছে এক রাত তু,,
এক দো কাদাম মেরে চাল সাথ তু।
পায়ে গা তু ভি রুচপায়িয়া,,,,,,,
তানহায়ি আহে তানহায়িআ,,,,,,
ছবি- নেটের
১৯টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপু গল্পটি পড়ে ভালোবাসার স্বর্গ,নরক দুটোই খুঁজে পেলাম। ভালোবাসায় যেমন সুখ, তেমনি দুঃখের পাহাড়-পর্বত ও তৈরি থাকে। একান্ত নিজের মানুষটিকে কাছে পেতেও কত শত বাধা বিপত্তি এটা যে অনেক অনেক কষ্টের মেনে নেয়া। রেটিং দিবো ১০ এ ৯। ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন শুভকামনা অবিরাম
রোকসানা খন্দকার রুকু
মন্তব্যের এমন আকালে আপনার গঠনমূলক মন্তব্য ও এমন অনুপ্রেরণায় উৎসাহিত না হয়ে পারিনা। ১০ এ ৯ দেবার আগে একটু সমালোচনাও করুন! খাঁটি হই।
অসংখ্য ধন্যবাদ ও ভালোবাসা দিদিভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাপরে আমার কম্ম না এটাতে সমালোচনা করা। মাপ চাই, দোয়া ও চাই সমালোচনা শেখার জন্য।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা এতো ভালোবাসলে হবে!
আরজু মুক্তা
গল্প আর জীবন কী আলাদা? জীবনের প্রতিচ্ছবি।
মন খারাপ করা গল্প।
রোকসানা খন্দকার রুকু
প্রকৃত ভালোবাসার গল্প মন খারাপ করাই হয়।
শুভ সকাল ম্যাম। ভালোবাসা নেবেন।
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ রোমান্টিক গল্প রুকু আপু
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভাই রোমান্টিকতা কই পাইলেন। কি যে কই। ভালো থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
গল্পটি অন্তর স্পর্শ করলো।
ভালোবাসার মানুষটি নিশ্চিত চলে যাবে, একা হয়ে যাবে অন্যজন, এটি মেনে নেয়া খুব কঠিন। এই কস্ট অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারবে না।
একমূহুর্তের জন্য ভালোবাসাকে ছুঁতে পারাও জীবনের সার্থকতা। মানুষ একে অপরের সাথে থাকে বছরের পর বছর। কিন্তু ভালোবাসাকে ছুঁতে পারে কজন?
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভালোবাসায় কজন স্বার্থক হয়সেটাই প্রশ্ন। অন্তরদহন নিয়েই কাটাতে হয়। ধন্যবাদ ও শুভকামনা দাদা।
উর্বশী
ভালোবাসা অতঃপর। ভালোবাসায় স্বার্থক হওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। জানি চলে যাবে কিন্তু কিছুই করার নেই, সেই কষ্টের পাহাড় যার হয় শুধু সেই বুঝে অন্তর থেকে।মন খারাপের উঠোন জায়গা করে নেয় প্রকৃত ভালোবাসায়। কোনো কিছুর বাঁধ মানে না। এর পরের ধাপ স্মৃতির ডাইরির পাতা। জীবনমুখী লেখা।
ভাল থাকুন আপু,ভালোবাসা সব সময়।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ আপু। আপনিও ভালো থাকুন।
হালিমা আক্তার
জীবনে কোন কিছুই বলে কয়ে আসে না। ভালোবাসা আছে অথচ তাকে ছোঁয়া যায় না, ধরা যায় না। ভালোবাসার সাগরে ডুবেও ভালোবাসাকে কাছে পাওয়া যায় না। একেই বলে নিষ্ঠুর নিয়তি। চমৎকার গল্প। শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হারানোর ব্যাথা সেই জানে যার হারায়!
ধন্যবাদ ও শুভকামনা আপু।
ছাইরাছ হেলাল
জীবনে চাওয়া আর পাওয়ার সমন্বয় না হওয়াটাই যেন সার কথা, লেখায় এটি এসেছে।
কামড়া কামড়ি সুন্দর এবং সময়মত মোক্ষম। এটি আমাদের লাগেই।
তবে এর সাথে ব্লাড ক্যান্সার যেন একটু কেমন মনে হয়, এখানে একটু ভাবার বিষয় আছে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
গল্পের ভুল ধরিয়ে দেয়া খুব জরুরী। তবে ওটা লেখার টান।
আপনাকে সেজন্য অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ইডিট করে দিয়েছি।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
ছাইরাছ হেলাল
আরে আরে আমি আবার কোনসুম ভুল ধরলাম!!
হালিম নজরুল
চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন থাকলে পৃথিবীতে কোন দ্বন্দ্ব থাকত না।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া