কাকের ডাক (ভৌতিক)

তাপসকিরণ রায় ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪, সোমবার, ১০:৫৬:০৬অপরাহ্ন গল্প ৬ মন্তব্য

কি লিখবেন ভাবছিলেন কমলেশ। মাঝে মাঝে এমনি হয়, কলম আর চলতে চায় না, মনে হয় লেখার সমস্ত ভাবনা এখানেই বুঝি থেমে গেলো!

কমলেশ লেখক, বেশ কিছু গল্প কবিতা পত্রিকায় ছেপেছে তাঁর ।চার পাঁচটা বইও প্রকাশিত হয়েছে। লিখে যাচ্ছেন একের পর এক গল্প কবিতা, কোথাও আটকাচ্ছে না। কিন্তু আজ কি লিখবেন  কিছুই মনে করতে পারছেন না। হাতে কলম, সামনে লেখার কাগজ, ঠায় বসে আছেন কমলেশ।

ঠিক এমনি সময় একটা কাক কর্কশ গলায় ডেকে উঠলো।যখন তখন এমনি কাকের ডাক নাকি খারাপ–অশুভ লক্ষণ। বারবার ডাকতে লাগলো কাকটা–যেন কোন শোক পড়েছে–কান্না করছে এমনি ভাব!

কমলেশের স্ত্রী তাড়াতাড়ি এসে বললেন, দেখ, দেখ, কাকটা কেমন ডাকছে! মর, মর! কা কা করে আবার বেসুরে ডাকতে লাগলো ওটা।

–রাম নাম বল, রাম নাম বল, কাককে রাম নাম শিখাতে লাগলেন মধুমতী, কমলেশের স্ত্রী।

এমনি এক কাক ডাকা রাত ছিল। রাতে কাকের ডাক নাকি খুব খারাপ! কমলেশ তখন থাকতেন টালিগঞ্জ, হরিপদ দত্ত লেনের চৌত্রিশের একের অনিল কুটিরে।ঠিক আনোয়ার শা স্টুডিওর সামনের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই বাড়িটা রাস্তার বাঁ পাশে পড়ে। তারপর আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে মোড়ের কোনে ছিল  বিরাট ঝাঁপড়ানো, কমসে কম একশ বছরের পুরনো এক তেঁতুল গাছ। রাতে ওই এলাকার পাখীদের আশ্রয় ওই গাছটাই ছিল। দিনের বেলা অনেক বাদুরের দল ঝুলে থাকত। তখন এত ঘিঞ্জি, এত ভিড়ের লোকালয় ছিল না কলকাতা। আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগের কথা ভাবলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা!

কমলেশের পাঁচ ছ বছর বয়সের ঘটনা ছিল সেটা– রাতে কাকগুলি ডাকতে থাকলো খুব–যেন কান্না করছে ওরা, তাদের পরিবারে কোন শোক নেমে এসেছে–এমনি একটা ভাব! অবশ্য সত্যি করে কাকেদের পরিবারে কোন শোক পড়ে কিনা কোন দিন আমরা তা যাচাই করে দেখার মত অবসর পাই না। সে রাতের কাকেদের ডাকাডাকির পর ভোর হল, বাইরে বেরিয়ে কমলেশ দেখলেন, হরিপদ দত্ত লেন ডাক্তারের কার, ট্যাক্সি, ভেনে গিজগিজ করছে! জানা গেলো বড় বড় নামী-দামী বহু ডাক্তারদের অশেষ চেষ্টার পরও চ্যাটার্জী বাড়ির বৌ মারা গেলেন! অনেক দিন আগে থেকে নাকি ভুগছিলেন তিনি। মহারোগ ছিল ভদ্র মহিলার, ক্যান্সার–যার ওপর আর কোন রোখ নেই, সে সময় ছিল ক্যান্সার মানে অবধারিত মৃত্যু! দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে শয্যাগত ছিলেন তিনি। বয়স বেশী ছিল না, চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর বয়স হবে। অনেক ভুগে, অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেলেন। ফুড পাইপে ক্যান্সার ছিল, বছর খানেক ধরে  গলায় নল লাগানো ছিল, খাদ্য খাবার সব লিকুইড করে নিয়ে গলায় লাগা নলের মাধ্যমে তাঁকে খাওয়াতে হত। গত এক মাস নাকি সেটাও সম্ভব ছিল না। কোন মত ফলের রসটস একটু আধটু খায়িয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়ে ছিল তাঁকে!

কমলেশ ভালো ভাবে চিনতেন না ওঁকে, পাড়ার লোকেরা বলত, খুব ভালো মানুষ ছিলেন, গরীব  দুঃখীদের দান ধ্যান পুণ্য করে গেছেন। যাই হোক, পাড়াকে সাড়া জাগিয়ে ভদ্র মহিলা চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সেই অশুভ কাকের ডাকের কথা আজ খুব করে মনে পড়ে গেলো। কমলেশের খুব ছোট বেলার কথা ছিল সেটা।

ছোট বেলা গড়িয়ে গেলো অনেকটা। কমলেশের বাবার বদলির সঙ্গে সঙ্গে ওদের যেতে হল অনেক দুরে–মধ্য প্রদেশের বস্তার জেলায়–যার কিছুটা অংশ নিয়ে দণ্ডকারণ্য প্রজেক্ট গড়ে উঠেছে। প্রজেক্ট হেড কুয়াটার ছিল ছোট্ট এক শহরে–গাঁয়ের নামেই নাম তার—কোন্ডাগাঁও। সেখানে কলকাতা বোর্ড আর কলকাতা ইউনিভার্সিটির পরীক্ষার সেন্টার ছিল, প্রাইভেট  ক্যান্ডিডেট হিসাবে ওখান থেকে অনেকেই মেট্রিক, প্রি-ইউনিভার্সিটি, পরে বিয়ে পাশ করেছেন। এর মধ্যে কমলেশও একজন।

বই.এ.পাশ করেন কমলেশ–শিক্ষকের চাকরি নিয়ে চলে এলেন সুদূর উড়িষ্যার–কোরাপুট জেলায়। এ জেলার কিছুটা অংশ দণ্ডকারণ্য প্রজেক্ট অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারই এক গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পোস্টিং হল তাঁর।  নতুন চাকরি খুব ভালো লাগছিল তাঁর। এই গ্রাম, চার পাশের নদী, ঝর্ণা, সুন্দর দৃশ্যের মাঝে আম্বাগুডা গ্রাম, প্রকৃতির কোলে বসা সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে বসে ছিল। গ্রাম থেকে দেখা যেত পাহাড়ের গা বেয়ে ট্রেনের যাওয়া আসা, বাস্তবের ট্রেন কেমন খেলনার মত ছুটে চলত পাহাড়ের গা বেয়ে! এ লাইন ছিল মধ্যপ্রদেশের বয়লাডিলা থেকে অন্ধ্রের বিজয়নগরম পর্যন্ত। সিঙ্গেল গেজ লাইন, বেশির ভাগ মাল গাড়ির আনা গোনা–দিনে দু-তিনটে প্যাসেঞ্জার গাড়িরও  যাতায়াত ছিল।  প্রাকৃতিক দৃশ্যের পূজারী যারা তাদের পক্ষে এ রুটটা আদর্শ বললে ভুল হবে না। পাহাড়, পর্বত, নদী, ঝর্ণা, টানেল, বন, কত রকম গাছের মেলা বসেছে রাস্তার দু ধার ধরে–চোখ জুড়ানো মনোরম এ দৃশ্য পৃথিবীর অনেক কম জাগাতেই পাওয়া যাবে বলে কমলেশের বিশ্বাস। যাই হোক, এবার সেই কাকের ডাকের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক।

একদিন নিশুতি রাতে আবার কানে ভেসে এলো অনেক কাকের করুণ ডাক।এ রাত কি তা হলে অলক্ষুণে রাত! সকাল হতে না হতেই গ্রামের মাতব্বর অলোকরঞ্জন এসে বললেন, শুনছেন! বিশু মাস্টার মারা গেছে!

–বিশু মাস্টার মারা গেছেন ? আশ্চর্য হয়ে কমলেশ পাল্টা প্রশ্ন করে বসেন।

–হ্যাঁ, অদ্ভুত ভাবে! লোকে বলছে, ভুতে নাকি ওকে মেরেছে! অলকরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন।

গ্রাম গঞ্জে এমনি ভুতের গল্প-কথার অভাব নেই।অনেক জাগাতেই ভুতের ভয় থাকে–অমুক জাগায় বেশী রাতে গেলে গা ছমছম করে, তমুক হাট বাজারের পাশ দিয়ে আলেয়া বের হয় নিশুতি রাতে! কমলেশের কাছে এসব এখানে আসার আগে বিশ্বাস যোগ্য বলে মনে হত না।

তেঁতুল গাছের ডাল চাপা পড়ে মরেছেন বিশু মাস্টার! মাতব্বরের দৃঢ় বিশ্বাস এটা ভূতেরই কাজ!আগে কমলেশেরও ভুতে বিশ্বাস ছিল না।ইদানীং হয়েছে। তবে বিশু মাস্টারের ব্যাপারটা অন্য রকম,কারণ গত রাতে খুব ঝড়-জল হোয়ে ছিল,মাসটাও চৈত্রের শেষ,

কাল বৈশাখীর ঝড় ঝাপটা গত ক’দিন যাবত চলছিল। রোজ বিকেল হলেই আকাশে মেঘ করে আসে, হালকা বৃষ্টির সঙ্গে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমক আর ছোট বড় ঝড়ের দাপট হয়েই চলেছে। বিশু মাস্টারের তেঁতুল গাছের ডাল পড়ে মৃত্যু নেহাতই স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয়। রাতে ঝড় হচ্ছিল, তেঁতুল তলা দিয়ে কোন কাজে যাচ্ছিলেন বিশু মাষ্টার, মাথায় তেঁতুলের ডাল ভেঙ্গে পড়ল।মাথায় বেকায়দা আঘাত হলে মানুষ তো মরতেই পারে! আর

স্বাভাবিক ভাবে বিশু মাস্টারও মরল। এমনি ভাবে ঘটনাটা সাজালে ভালো হত। তবু, হ্যাঁ, তবু বলে একটা প্রশ্ন মনের কোনে কোথায় যেন থেকে যায় বটে!

গ্রামের লোকের, ইদানীং কমলেশেরও, ভুতের ব্যাপারে বিশ্বাস এসেছে। গ্রামের লোকের দৃঢ়     বিশ্বাস এ ভূতেরই কাজ। কমলেশ এ ব্যাপারে দৃঢ় শব্দ ছেড়ে দিলেও বিশ্বাস কথাটাকে উড়িয়ে দিতে পারলেন না।

দাহ করতে যাঁরা  গেলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষক ছিলেন। বিশু মাস্টার কোন স্কুলের মাস্টার নন, স্থানীয় গ্রামেরই বাসিন্দা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাইমারি স্কুলের ছেলে মেয়েদের পড়াতেন।শিক্ষকদের সঙ্গে তার মিলা মেলামেশা বেশী ছিল। অবসর বিনোদনের অধিকাংশ সময়টুকু তাঁকে পাওয়া যেত কমলেশের ঘরে।

গত ক মাস আগের কথা, বিশু মাস্টার কমলেশের ঘরে এলেন। রাত তখন দশটার কাছাকাছি হবে, জমিয়ে ভুতের গল্প শুরু করলেন তিনি। আশপাশের চার-পাঁচ গ্রাম জুড়ে নাকি বেশ কিছু জাগার বদনাম আছে! পাশের গ্রামের নাম রণ্ডাপালি, তার পরের গ্রাম হল, হাড্ডা পুট। আর দু গ্রামের মাঝখানে বসে হাট, সপ্তাহে দু দিন–মঙ্গলবার আর শনিবার। ওই দুটো দিনই নাকি রাত গভীর হলে হাটের পাশ থেকে এক আলেয়া বের হয় এবং তার গতি বিধির নির্দিষ্ট পথ থাকে। হাটের পাশ থেকে আলেয়া চলতে শুরু করে–ধান জমি পেরেয়ে, বড় রাস্তা পার হয়ে যাত্রা শেষ করে ছোট পাহাড়ি নদীর কিনারে, যেটা স্থানীয় পাঁচ ছ গ্রামের শশ্মানঘাট।

(ক্রমশ)

৯১৮জন ৯১৮জন
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ