পড়াশোনায় মোটেও ভালোনা টাইপ ছাত্রী আমি। পরিবারে নাম আছে আমার আলসেমী নিয়ে। কিছুটা নিয়ম মাফিক চঞ্চলতাও আছে। আছে অনেকের অনেক রকম অভিযোগ। সেই ছোটবেলাটা কেটে গেছে বেশ কিছুদিন আগে। স্কুলে আবৃত্তির পরে আর একবার আব্বার পরিচালনায় এক বিজয় দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পর্দার পেছনে সেই একই কবিতার মায়ের অংশটুকু আওড়েছিলাম শহরের বিশিষ্ট আবৃত্তিকার সুভাষ বোস কাকুর সাথে,ব্যাস্ ওই পর্যন্তই শেষ তখন পর্যন্ত।
কাকুর বলাতে হাত চুলেই স্থির হয়ে রইলো কিছুক্ষন। মুখে কিছুই বললাম না। শুরু হলো খাতা কলমের যুদ্ধ। চিঠি লেখার খুব চর্চা ছিলো আমার। নানা,খালা, চাচাদের কাছে আমার চিঠি লেখা হতো নিয়মিত।
আগেই উল্লেখ করেছি, ছোটকা খাম পাঠাতেন নাম ঠিকানা লিখে। ছোটকা(শামসুল আলম) সিলেট ক্যাডেটে চাকরি করতেন। পরিবার থেকে অনেক দূরে। ছোটকা চাইতেন সবসময় যেন তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখা হয় চিঠির মাধ্যমে। রাখতামও।
তো যাই হোক….. কয়েকদিনের চেষ্টায় কিছু একটা দাঁড় করিয়ে ফেলে ভয়,সংকোচ,লজ্জা নিয়ে আব্বার সামনে হাজির হলাম। আব্বা নিবিষ্ট তাঁঁর প্রফেসনের লেখা নিয়ে। কথা খুব কম বলতেন আব্বা। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করতেন। কেউ কোনো কিছু জানতে চাইলে পস্ নিতেন দীর্ঘসময়। তারপর গুছিয়ে নিয়ে মুখ খুলতেন। পছন্দ হলে হলো, না হলে নাই। আব্বাকে আমার ভালো রপ্ত করা হয়ে গেছে ততোদিনে। এরও অনেক আগেই আব্বা বুঝিয়ে দিয়েছেন কখনো মিথ্যে বলা যাবেনা, যত যাই হোক সত্য বলবি, মাফ করে দেবো, মিথ্যে বলবি তো…… বাকিটুকু আর বলার বাকি থাকে কিছু?
মাঝে মাঝেই স্কুলের বাইরে চলে যাই, বান্ধবিদের সাথে কোন বাসার সামনে চালতা শুখাতে দিয়েছে? কোন বাসায় গেলে আচার পাওয়া যাবে? সব বান্ধবিদের বাসায় বাসায় ঢুঁ মারা! এসব যদি এসে বলি, “আব্বা আজ বিষ্ণুদের বাসায় গেয়ছিলাম, আজ লুনাদের বাসায় গিয়েছিলাম,আজ বিনা’দের বাসায় গিয়েছিলাম….. ঠ্যাঁ ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবে না? দেবারই তো কথা নাকি? তাহলে সব সত্য কথা বলি কি করে? আর বাইরে আর করবোটাই বা কি?
আমার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আব্বা কলম থামিয়ে চশমার ওপর থেকে আমার দিকে কপালের মাঝ বরাবর যথাসম্ভব চামরা টেনে ভাঁজ ফেলে, কপাল কুঁচকে তাকালেন…..! মুখে কিছুই না বলে লেখার খাতাটা এগিয়ে দিলাম। লক্ষ করলাম, পারলে যেন আব্বা গালের চামরাও কপালে উঠিয়ে আরো কয়েকটা ভাঁজ সৃষ্টি করেন।আবারো আমার চোখের দিকে তাকালেন –অর্থাৎ এবারের প্রশ্নঃ কি এইটা? “লেখাটা একটু দেইখা দেন”শুধু এটুকুই বললাম। যথারিতী কুঁচকানো চোখ আর কপালের অবস্থা বজায় রেখেই খাতাটা টেনে নিলেন, নিজের লেখা রেখে। স্বস্তি পেলাম মনে মনে। “পরে দেখবো, এখন রেখে যা,এসব দেখার সময় না এখন…… ইত্যাদি ইত্যাদি কোনো বাক্য উচ্চারন করেননি।
খুবই আশ্চর্যের সাথে প্রশ্ন করে বসলন -“তুই লেকছো? লজ্জাবনত হলাম! কোনো জবাব দেইনি। আব্বাকে তখনই সব বলে ফেললাম কাকুর কথা। আব্বা কিছুই বললেন না। লক্ষ করলাম ধীরে ধীরে কপালের চামরা স্বাভাবিক হয়ে গেলো আব্বার। কয়েকটা লাইন উপরে, নীচে, বাক্য কয়েকটা এদিক সেদিক করে দিয়ে খাতা ফেরত দিয়ে বললেন,”ঠিক করে লেখ”।
নিজের পড়ার টেবিলে ফিরে গেলাম। কিছুক্ষন আত্মতৃপ্তি উপভোগ করলাম একা একা। যাক…. আব্বা বলেননি তো! ” কি লিখছো এগুলা? কিচ্ছু হয়নাই! তোরে দিয়া *কবিতা*? এসব ছাইড়া পড়াশুনা কর!!
চলবে…..
২৪টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
হুম! বাবার হাত ধরে লেখা অভ্যাস ভালই। ছোট্ট বেলায় এরকম খাওয়া-দাওয়া কিছু থাকবেই
তই বেশি কিছু হলে হতেও পারে।
বন্যা লিপি
কিশোরী বয়সটা উপভোগ করার সুযোগ যতটুকু পেয়েছি….. আমাদের সন্তানেরা তার কিছুই পায়নি। ভাবতেই গর্ব হয় এখন। আমরা যা পেয়েছি, এরা তার কিছুই চোখেও দেখেনি, ভাবতেও পারেনা।
বাবার অমন প্রেরণাটুকু না থাকলে, আমার আর এগোনো হতো না, এটা জ্বলন্ত সত্য।
পাশেই থাকুন ভাই, আরো কিছু বাকি আছে লেখা। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো।
মোঃ মজিবর রহমান
এখন সন্তানরা দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচাচাচি মামাতো ফুফাত ভাই বোন কি তাই জানতে ভুলে গেছেরে আপু। চাকরি, পেটের মধ্যে থাকা অবস্থাই বাবামার চিন্তা গ্রামে যাওয়া ভুলে যাই। কোথায় বাচ্চাকে পড়াব। এটাই এখন চরম সত্যি। আমার ছেলে হলে বাবাকে তাঁর হাতে দিয়ে বললাম তোমার ভাই নাও। বাবা পরম তৃপ্তিতে কোলে নিয়ে আদর করল। আমার ভাই। কিন্তু আল্লাহর আমার সন্তানকে দাদার স্নেহ আদর কিশরে পাওয়ার আগেই বাবা নিয়ে গেল। আল্লাহ বাবাকে স্বরগীয় করুক।
মোঃ মজিবর রহমান
দুই এক লাইনেতর ছন্দময় পক্তি দিলে কি হ??
বন্যা লিপি
হা হা হা হা……. খেয়ালে ছিলো না ভাই। পরেরবার দেখবো মানানসই ছন্দময় পঙ্তি রাখা যায় কিনা!
মোঃ মজিবর রহমান
ছন্দ আসবেই আসুক অপেক্ষায় রইলাম।
কামাল উদ্দিন
আব্বার “তুই লেকছো? কথাটাই হয়তো আপনাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলো অনেক……….চলুক
বন্যা লিপি
আগেই উল্লেখ করেছি….”আব্বা’কে ততোদিনে আমি বুঝে নিয়েছি” আর এই বোঝাটা একদম আমার মতো করে বোঝা। আব্বাও বুঝতেন আমাকে ঠিক তাঁর নিজের মতো করে। যে কারনে ” তুই লেকছো?” কথাটা দিয়েই আব্বা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর বিষ্ময়, ভালোলাগা,উৎসাহ,প্রেরণার সবটুকু অনুভূতি। আমার তৃপ্তিটা সেখানেই গর্বিত হবার অজুহাত খুঁজে নিয়েছিলো।
সাবিনা ইয়াসমিন
অনুপ্রেরণা যদি সঠিক মানুষ থেকে পাওয়া হয়, তাহলে তার চলার পথ এগিয়ে যায় বহুদূর,, এখন যদি তিনি তোমার লেখাগুলো পড়তেন তাহলে নিশ্চয়ই গর্বিত হতেন।
গালের চামড়া কপালে উঠে ক্যামনে বন্যা!! 😀
বন্যা লিপি
সঠিক বলেছো।অনুপ্রেরণা যদি যোগ্য কাঙ্খিত মানুষের কাছ থেকে পাওয়া, তবে আর এগিয়ে চলার সাহসের অভাব হয়না।আব্বাও একেকটা লেখা লিখে আমাকে এগিয়ে দিতেন ডায়রীটা নিরবে। পড়ে দেখার জন্য! আমি কুন্ঠিত হতাম জানো!!
আব্বা আমাকে দিচ্ছেন লেখা পড়ে দেখার জন্য? আমার বাবার সামনে তো সহজে বসতেও সাহস পেতাম না। মুড বুঝে তবেই সামনে যেতাম।
সেই বাবার সাথে সাথেই যতটুকু পথচলা আমার।
গালের চামড়া কপালে কেমনে ওঠে? আমার আব্বাকে না দেখে তোমাকে কেমনে বোঝাই বলোতো? একবার ভাবোতো! কতটা কপালের চামড়া কুঁচাকনো সম্ভব? পারলে আরো কতটা ধার উদ্ধার করা যায়😄😄
ছাইরাছ হেলাল
সব ই যেন চোখে দেখতে পাচ্ছি।
লেখা চলুক।
বন্যা লিপি
অনুপ্রাণিত!! কৃতজ্ঞতা রইলো।
এস.জেড বাবু
যথারিতী কুঁচকানো চোখ আর কপালের অবস্থা বজায় রেখেই খাতাটা টেনে নিলেন, নিজের লেখা রেখে। স্বস্তি পেলাম মনে মনে। “পরে দেখবো, এখন রেখে যা,এসব দেখার সময় না এখন…… ইত্যাদি ইত্যাদি কোনো বাক্য উচ্চারন করেননি।
খুবই আশ্চর্যের সাথে প্রশ্ন করে বসলন -“তুই লেকছো? লজ্জাবনত হলাম! কোনো জবাব দেইনি। আব্বাকে তখনই সব বলে ফেললাম কাকুর কথা। আব্বা কিছুই বললেন না। লক্ষ করলাম ধীরে ধীরে কপালের চামরা স্বাভাবিক হয়ে গেলো আব্বার।
এইতো সার্টিফিকেট
এর পর আর কিছু লাগে নাহ্
বন্যা লিপি
আপনার মন্তব্য করার ধরনটা আমার ভালো লেগেছে। ঠিক তাই! এরচেয়ে বেশিকিছু আর আমার জন্য লাগেনি। এরপর বাবার সাথে সাথেই, হাঁটার হেঁটেছি এ অঙ্গনে।তাও খুবই অল্প সময়ের জন্য।আসবে – সেসবই আসবে সামনের পর্বগুলোতে।
ধন্যবাদ আপনাকে। শুভ কামনা।
জিসান শা ইকরাম
স্মৃতি কথা এমন ভাবে লিখছ যেন মনে হচ্ছে ঘটনাটি সামনে দেখছি।
এখন তো মনে হচ্ছে, ছয় নাম্বার কাকা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে ” স্মৃতি কথা লেকতে পারো? ” 🙂
শুভ কামনা।
বন্যা লিপি
আমার ছয় নম্বর কাক্কুরে নিয়া কিছু বইলেন না 😑 তাঁর ওই এক প্রশ্নের কারনেই(কবিতা লেকতে পারো?) আমার কলম চলছে নতুন করে আজো।
সেই প্রশ্ন আজো মাথায় গেঁথে আছে বলেই তো এই লেখার জন্ম।
আমার ছয় নম্বর কাক্কুটা তো ভুলোমনা!
কতকিছু ভুলে যায়! এখন আমার প্রশ্ন হলো, কাকুটা কি এখনো মনে করতে পারবে? একথা সে আসলেই আমাকে বলেছিলো কিনা? দেখা হলে জিজ্ঞেস করতে হবে😊😊
আরজু মুক্তা
সেই অনুপ্রেরণায় আপনি ভালো লিখছেন। আমরাও জানতেছি।
বন্যা লিপি
বাবা কখনো আমার লেখালিখিতে আপত্তি করেননি,আবার বলেও দেননি, এটা লেখ এভাবে লিখবিনা।একটা লেখা লিখে নিয়ে দেখাতাম শুধু, উপরের লাইন নিচে,নিচের লাইন উপরে, কিছু শব্দ আগে পরে করে দেখিয়ে দিতেন শুধু।
আর আমার প্রেরণা আকাশ সমান বিশালতা পেত। আজ আর কেউ নেই সেটুকু দেখিয়ে দেবার মতো। আজ আর জানিনা কি লিখছি? কেন লিখছি?
আপনার প্রতি ভালবাসা❤💚
নিতাই বাবু
আগের চারটে পর্ব পড়া হয়নি, দিদি। এর আগেরটা আর এই পর্বটা পড়ে খুবই ভালো লেগেছে। চলুক জানতে থাকি, পড়তে থাকি।
বন্যা লিপি
দাদা,এর আগের পর্বে লিঙ্ক দেয়া আছে। আপনার পড়ার ইচ্ছে হলে,পড়তে পারেন। অনেক কৃতজ্ঞতা আপনার জন্য।
সুরাইয়া পারভিন
ব্যস্ততার কারণে আগের পর্ব পড়তে পারিনি।
পরে পড়ে মন্তব্য জানাবো ইনশাআল্লাহ
বন্যা লিপি
আচ্ছা আপু।পড়বেন।
রেহানা বীথি
নির্ভরযোগ্য কারও কাছে স্বীকৃতি লাভ পরম প্রাপ্তি। ভালো লাগলো আপনার স্মৃতিকথা।
বন্যা লিপি
নির্ভরতার জায়গাটা যদি হয় বাবা, তাহলে তো আর ভাবনার থাকেনা কিছুই।
কৃতজ্ঞতা জানবেন অজস্র।