আমার প্রথম সন্তান যখন গর্ভে চার মাস বয়স, তখন আমাদের স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে কিছু কাউন্সেলিং করা হল। বলা হল রক্ত পরীক্ষায় জানা গেছে আমার সন্তান সুস্থ স্বাভাবিক না হবার সম্ভাবনা। আবার সুস্থ, স্বাভাবিক হলে হতেও পারে। এ জন্য আমাকে আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ফাইনালি সবরকম টেস্ট শেষে যদি নিশ্চিত হয় যে, সন্তান অটিস্টিক হবে, তবে আমি যেন ভেঙে না পড়ি। সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখা না রাখা নিয়ে যেন বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারি, এজন্য আরও কয়েকবার কাউন্সেলিং এ আসতে হবে। আমি সত্যিই ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়লাম। কেমন যেন খালি খালি চারিপাশ। কিন্তু আমার স্বামীর এক কথা__ তিনি এসব পরীক্ষা, নিরিক্ষা কিংবা কাউন্সেলিং এর মধ্য দিয়ে যেতে চান না। তাঁর প্রথম সন্তান সৃষ্টিকর্তা চাইলে পৃথিবীতে আসবে, পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে উঠবে। সে যেমনই হোক।
অতঃপর রিয়াসাত জন্মালো সুস্থ ভাবেই। সবই স্বাভাবিকভাবে চলছিলো।
বছর চারেক পরের কথা। স্কুল থেকে ফোন আসে। আমাদের জানানো হয়, রিয়াসাত স্কুলে কারো কথা বুঝতে পারে না। এমন কি কাউকে কিছু বুঝিয়েও বলতে পারে না। আমরা যেন দেরি না করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করি। আমি আবারো মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। শুরু হয় ডাক্তারের কাছে ছুটোছুটি। সব রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে জানলাম, অন্য কোন সমস্যা নয়, কেবল বিভিন্ন ভাষাভাষীর কারনে সে নির্দিষ্ট কোন ভাষাই শিখতে পারছিলো না। বাসায় বাংলা, প্রতিবেশী খেলার সাথীরা চায়নিজ, স্কুলে কিংবা টিভিতে ইংরেজি… সবমিলে রিয়াসাত কনফিউজড।
এর থেকে উত্তরণের উপায় বাতলে দিলেন ডাক্তার। একটি মাত্র ভাষায় কথা বলতে হবে, অন্য বাচ্চাদের সাথে বেশি বেশি মিশাতে হবে, পার্কে নিয়ে যেতে হবে। সেই থেকে এক কঠিন যুদ্ধের সুচনা। তখন আমি ড্রাইভ করি না। বাস ট্রেন ধরে দূরের পার্কে নিয়ে যাই রোজ বিকেলে।কাছের অনেক পার্ক পেরিয়ে দূরে যাবার একটাই কারন__ সেখানে রিয়াসাত এর চেনা বন্ধুরা খেলা করে। সেই পার্কটিই তাঁর জন্যে ভাল। সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়ি ফিরবার সময় পথিমধ্যে ঘুমিয়ে থাকা রিয়াসাতকে রোজ কোলে করে বাসে উঠে, ট্রেনে চড়ে বাড়ি ফেরা ভীষণ কঠিন ছিল আমার জন্যে। অজানা আশংকায় দিনরাত প্রতিটি মুহূর্ত যত্ন আত্তি করা, ভালোবেসে আগলে রাখা, প্রতিনিয়ত এটা ওটা শেখানো, গায়ে গায়ে লেগে থাকা __ কয়েক বছর চলে এ যুদ্ধ। স্কুলে প্রথম তিনটি বছর তাঁর রেজাল্ট আমায় ভীষণ মন খারাপ করাতো।
মায়েদের কোন চেষ্টাই, কোন কষ্টই বৃথা যেতে পারে না। এখন রিয়াসাত সেভেন গ্রেডে পড়ছে। আসছে অক্টোবরে নিউইয়র্ক সিটির স্পেশেলাইজড হাইস্কুলে ভর্তি পরীক্ষার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করছে। এ পর্যন্ত পাওয়া তাঁর মেডেল গুলো, এ্যাওয়ার্ড গুলো মাঝে মাঝে বের করি। নেড়ে চেড়ে দেখি। অনারেবল প্রিন্সিপ্যাল এ্যাওয়ার্ড, স্কলারশিপ এ্যাওয়ার্ড, গোল্ড এ্যাওয়ার্ড সহ প্রতিবার স্টুডেন্ট অব দ্যা মান্থ হওয়া __ আমার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। শ্বাস নেই। দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস। এসবের পিছনের গল্প ভীষণ কষ্টের, আত্মবিশ্বাসের, ধৈর্যের।
আমার প্রিয় “সোনেলা ব্লগ” এর অরুনি মায়া আপু’র লেখায় কমেন্ট করতে গিয়ে এটি লেখা। যদি কারো উপকারে আসে, যদি কোন হতাশ মায়ের আত্মবিশ্বাস বাড়ে তবেই লেখাটির সার্থকতা।
ভাল থাকুক আমাদের শিশুরা, ভাল থাকুক তাঁদের বাবা-মা’য়েরা।
শুভকামনা সকলকে…
৩৪টি মন্তব্য
সিকদার
আসলেই আত্মবিশ্বাসের সাথে ধৈর্য ধরে পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই ।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন, নিরাপদ থাকবেন।
খসড়া
ধন্যবাদ।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা…
ছাইরাছ হেলাল
আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করেছে,
আল্লাহ না করুণ অন্য কিছু হলে খবর ছিল সবার জীবনের।
এখানাকার বাস্তবতা অনেক অনেক গুন কঠিন।
রিমি রুম্মান
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ শিশুদের জন্যে সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। এ দেশের সুযোগ সুবিধা গুলো দেখে খুব ভাবতে ইচ্ছে করে, একদিন আমার দেশেও এমনটি হবে।
সৃষ্টিকর্তার প্রতি সকল বিশেষ শিশুদের জন্যে প্রার্থনা…
ভাল থাকুক আমাদের শিশুরা।
জিসান শা ইকরাম
সন্তান পালনে যথেষ্ঠ ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়
সন্তানের সাফল্যে আমরা যতটা গর্বিত হই, নিজের সাফল্যেও তেমনটি হইনা।
ভাল থাকুক আমাদের শিশুরা, ভাল থাকুক তাঁদের বাবা-মা’য়েরা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক শিশুরা…
ভাল থাকুক বাবা-মা’য়েরা …
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু তোমার পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে।
অনেকগুলো ভাষার মধ্যে বড়ো হয়েছে আমার ছেলেটাও। চিন্তা ছিলো আমারও। তবে এখন সেটা কাটিয়ে উঠেছি।
রিয়াসাত মানুষের মতো মানুষ হোক। -{@
রিমি রুম্মান
প্রথম সন্তান… ভিনদেশ… ৪/৫ বছরেও কথা না বলা __ সবমিলে অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া এক সময় কেটেছে তখন। সেই সময়গুলো কিভাবে পার করে এসেছি, সে গল্প লিখেছি মাত্র… যদি কারো উপকারে আসে।
ভাল থেকো নীলা দি।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু জীবন থেকে নেয়া গল্পগুলোই তো কাজে আসে। তুমি ঠিক কাজটিই করেছো।
তুমিও ভালো থেকো। -{@
নাজমুস সাকিব রহমান
সুন্দর লেখা। রিয়াসাত অনেক বড় হোক।
শুভকামনা।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা আপনাকেও।
ইলিয়াস মাসুদ
আমি আপু ছোট মেয়ে টাকে নিয়ে এই ভয়েই আছি,নানা ভাষার চাপে কোন ভাষায় সম্পুর্ন করে বলতে পারছে না…..
রিমি রুম্মান
এমনটি বিদেশ বিভূঁইয়ে প্রতিনিয়ত হচ্ছে। সেই ভাবনা থেকেই লেখাটি লেখা। যদি কারো কাজে আসে। ভাল থাকবেন সবাইকে নিয়ে।
আবু খায়ের আনিছ
রিয়াসাত অনেক বড় হোক।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা নিরন্তর। -{@
খসড়া
এই যদি অসম্ভব ধৈর্যের গল্প হয় তবে আর কিছুই বলবার নেই।
অরুনি মায়ার সাথে নিজেকে তুলনা না করলেই পারতেন। দুঃখিত আপনার খারাপ লাগছে এই মন্তব্য। কিন্তু আমি তবুও লিখছি। এই পোস্টের সবই ভাল ছিল অরুনি মায়ার নামটা উচ্চারণ না করা পর্যন্ত।
দুঃখিত।
আমরা কখনই কারও দয়া করুনার প্রার্থী না। এ দায় আমাদের এ আমাদেরই বহন করতে হবে। উহু শব্দটি আপনাদের অভিধানেই থাক। আমরা শুনতে চাই না।
আমাদের শ্লোগান।
আমরা করবো জয় আমরা করব জয় একদিন। এক মাকেই এই সংগ্রাম জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চালাতে হবে।
রিমি রুম্মান
আপু, আমি “অসম্ভব ধৈর্যের গল্প বলিনি”। সন্তানের মঙ্গলের জন্যে করা মায়েদের কোন কাজই অসম্ভব নয়। কিংবা অরুনি মায়া আপুর সাথেও তুলনা করিনি। উনার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন, সে থেকে আমরা অনেকেই অনেক কিছু শিখতে পারি। এভাবে একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আরেকটি ঘটনা বলি, কিংবা নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করি। এমনি করেই আমরা প্রতিনিয়ত শিখছি, জানছি।
আমার লেখা যদি কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকে তবে আমি ক্ষমা প্রার্থী। কিংবা “সোনেলা” যদি মনে করে থাকে যে, লেখাটিতে কাউকে আঘাত করা হয়েছে তবে লেখাটি নামিয়ে ফেললেও আমি বিন্দুমাত্র কিছু মনে করবো না। আমি খুবই পজেটিভ মনের মানুষ। এবং “সোনেলা” আমার ভালোবাসার জায়গা। শুভকামনা আপনার জন্যে।
অরুনি মায়া
রিমি আপু আমাদের প্রাণের সোনেলা বোধহয় বদলে যাচ্ছে | এখানে একটি প্রেমের পোস্টে অনেকে আনন্দ নিয়ে মন্তব্য করেন কিন্তু সমাজ ও পরিবারের এমন সংকট নিয়ে দেওয়া পোস্ট কোন গুরুত্ব রাখেনা | আমার পোস্ট স্টিকি করেও নামিয়ে দিয়ে প্রমাণ করা হল এইসব শিশুরা সমাজের বোঝা বই আর কিছু নয় |
আমার এই পোস্ট দেবার মানে এই নয় যে আমি করুণা প্রার্থী | আপনার বেলায়ও ঠিক তাই |আপনি খুব মহৎ একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এটি লিখেছেন | মানুষের উপকার করা দোষের কিছু নয় আপু | দয়া করে পোস্ট মুছতে বলবেন না | যাদের ভাল লাগেনি এই পোস্ট তারা এখানে না এলেই পারত | আমার ভাল লেগেছে আপু | আপনার সব পোস্টই গুরত্বপূর্ণ আমার দৃষ্টিতে |
ধন্যবাদ আপু -{@
রিমি রুম্মান
অরুনি মায়া আপু, অনেক ভাল লাগলো এখানে তোমার মন্তব্য দেখে। স্বস্তি পেলাম মনে। কষ্ট হচ্ছিল, নিজের অজান্তেই কি কারো মনে কষ্ট দিয়ে ফেললাম, এই ভেবে ! তবে পোষ্ট স্টিকি দেয়ায় যতোটা খুশি হয়েছিলাম, স্টিকি নামিয়ে নেয়ায় ঠিক ততোটাই মর্মাহত হয়েছি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না। ভাল থেকো। -{@
লীলাবতী
অরুনি মায়াপু, সোনেলার জন্মলগ্ন থেকে আছি, এভাবে কখনো কেউ বলেনি, “এখানে একটি প্রেমের পোস্টে অনেকে আনন্দ নিয়ে মন্তব্য করেন কিন্তু সমাজ ও পরিবারের এমন সংকট নিয়ে দেওয়া পোস্ট কোন গুরুত্ব রাখেনা | আমার পোস্ট স্টিকি করেও নামিয়ে দিয়ে প্রমাণ করা হল এইসব শিশুরা সমাজের বোঝা বই আর কিছু নয়” একটা ঘটনা দিয়ে সামগ্রিক সবকিছু বিচার করা কিন্তু আমাদের সাজেনা। মডারেটর যদি পোস্ট স্টিকি করে থাকে, নিশ্চয়ই তার গুরুত্ব বুঝেই করেছিল, তুমি নিশ্চয়ই সুপারিশ করোনি? কেন নামিয়েছিল, তার কারন না জেনেই আমরা পজিটিভ টাকে ভুলে যাচ্ছি। এবং আমরা আমাদের নেগেটিভিটি শো করছি, এটা সোনেলার উপর সারির ব্লগারদের মানায় না। ভালো থেকো আপু।
লীলাবতী
আপু, এমন পোস্ট উজ্জীবিত করে তুলবে সবাইকে। বাবা-মা’র কতটা ধৈর্য্য আর সহনশীলতা প্রয়োজন, তাই ভাবছি আপু। আপনাকে অনেক অনেক শ্রদ্ধা জানাই আপু।
এমন পোস্টে এমন মন্তব্য, প্রতি মন্তব্য আমাকে আঘাত দিলো। তাই হয়তো তেমন করে কিছু বলতে পারলাম না। দুঃখিত আপু। 🙁
রিমি রুম্মান
আপু, ভাল থাকবেন, অনেক ভাল সবাইকে নিয়ে।
শুভকামনা। -{@
মৌনতা রিতু
পড়লাম। হুমমম, এটা ঠিক আমরা সন্তানদের ব্যাপারে সবাই কম বেশি ধৈর্য্যের পরিচয় দেই। একেক সন্তান একেক রকম। তাকে সেইভাবে মানুষ করতে হয়। সবাই সবার অনুভুতি সুন্দরভাবে প্রকাশ করুন। এই টা আমাদের পরিবার। আমি তো বলি, সোনেলা আমার বাপের বাড়ি। ওখানে যেমন ঝগড়া, খুনসুটি অভিমান হয়, এখানেও তাই। কিন্তু পরে ঠিকই আমরা গলায় গলা মিলাই।
রিমি রুম্মান
আমরা আমাদের অনুভূতিগুলো, সমস্যাগুলো, আনন্দগুলো সবার সাথে শেয়ার করি বলে অনেক কিছুই জানতে পারি। সোনেলায় আসি ফিরে ফিরে, অনেক ব্যস্ততার মাঝেও ভালোলাগা থেকে। দিনশেষে ভালোবাসার জায়গায় ফিরে আসবার মতোই অনেকটা।
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
রাইসুল জজ্
আপনার সন্তান উত্তরোত্তর আরও উন্নতি করুক, উজ্জ্বল করুক আপনার মুখ। শুভ কামনা রইল এক জন মায়ের জন্য
রিমি রুম্মান
শুভকামনা সকল সন্তানের মায়ের জন্যে…
শুভকামনা সকল শিশুদের জন্যে…
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আত্মবিস্বাস অনেক বড় মছিবত থেকেও রক্ষা করে।ছেলের জন্য দোয়া রইল আপু -{@
রিমি রুম্মান
শুভকামনা জানবেন। ভাল থাকুক আমাদের শিশুরা। ভাল থাকুক সকল শিশুর বাবা-মায়েরা …
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
প্রতিটি মায়ের কাছেই তার সন্তান অনেক প্রিয়।
সন্তানের কোন অস্বাভাবিকতা দেখলে সকল মা’রই চিন্তিত হওয়ার কথা। যেমনটা আপনার ক্ষেত্রে ও ঘটেছে। আপনার তাও কঠোর পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।
অনেকেরই ভাগ্য তাও জুটে না। এই দিক থেকে আপনি সৌভাগ্যবান ও বটে।
সুস্থ থাকুক আপনার ছেলে, অনেক বড় হউক।দোয়া রইলো।
রিমি রুম্মান
মায়েদের কোন কষ্টই বৃথা যায় না। শুধু প্রয়োজন আশেপাশের মানুষগুলোর সহযোগিতাপরায়ন মনোভাব।
ভাল থাকুন সবসময়।
ব্লগার সজীব
অত্যন্ত গুছিয়ে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করলেন আপু। আল্লাহ্র কাছে অসীম শুকরিয়া যে আপনার সন্তান আপনার যত্নে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এমন মা আমাদের আদর্শ।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন আপ্নিও।
শুভকামনা রইল।