এলোমেলো কিছু কথা…**এগারো**

নীলাঞ্জনা নীলা ২৬ আগস্ট ২০১৫, বুধবার, ০৯:৫৫:৪৭পূর্বাহ্ন বিবিধ ২৭ মন্তব্য
আলো-আঁধার বিকেলবেলা
আলো-আঁধার বিকেলবেলা আমার জানালায়

হ্যামিল্টন শহরে রাত্রি নেমে এলো। বিকেলটা বেশ আলো-আঁধারে কেটে গেলো। আর সমস্তটি দিন নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রায়। বড়ো ভালো লাগে এমন তাপমাত্রা। আজকের দিনটাই ছিলো গানের দিন। “এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার।” কিন্তু গান করার মতো অবস্থায় আজ নেই আমি। গত রবিবার কাজে গিয়ে ব্যথা পাই, এক বন্ধু(যাকে আমি আঁতেল নামে ডাকি) মজা করে বললো রোগীর নার্স অসুস্থ। কাজ থেকে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই বুঝলাম ঘাড়ে্র ব্যথাটা বাড়ছে। পেইন কিলার খেলাম, হট প্যাক কাঁধে রেখে নাহ তাতেও কাজ হচ্ছেনা। সোমবার আমার অফ ডে থাকে। তাই রবিবার এলে খুব আনন্দে কাজ করি। সেদিন প্ল্যানও ছিলো আমাদের বান্ধবীদের রাতে আড্ডা বসবে রেষ্টুরেন্টে। এখন আমি না গেলে আসরটা ভেঙ্গে যাবে। আর সত্যি বলতে কি আমারও তো অনেক ইচ্ছে। তাই কোনোভাবে গেলাম রেষ্টুরেন্টে। বেশ খাওয়া-দাওয়া হলো, তারপর আড্ডা। ওদিকে ভালোই ব্যথা। বাসায় এলাম, সেই রাতে একফোঁটা ঘুমোতে পারিনি। যে আমি কাঁদিনা, তার চোখ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে জল। বালিশ ভিঁজে গিয়েছিলো। তবে আমার ছেলেটা বিরক্ত হলেও বারবার হটব্যাগ গরম করে এনে দিয়েছে। ভেবেছিলাম মামনির জন্মদিন ফোন দিয়ে কথা বলবো, কিন্তু ব্যথার জন্য পারলাম না। কিন্তু ঠিক সকাল সাড়ে আটটার সময় অফিস থেকে ফোন। গেলো ঘুম ভেঙ্গে। কি কষ্টে ভোর পাঁচটার সময় চোখটা লেগেছিলো। ফোন ধরতে পারিনি, তাই আবার চোখ বুজে রইলাম। হঠাৎ শুনি মামনির কন্ঠ। পুরো চমকে গেলাম। তীর্থ বলছে, “দিদিমনি এই দেখো মাম ঘুমোচ্ছে।” চশমা নেই, কিন্তু তখন বুঝলাম তীর্থ ওর আইপেডে স্কাইপ ওপেন করেছে। চশমা পড়ে চোখটা খুলে মামনি-বাপিকে দেখা। অনেক ব্যথা তবুও বোঝাতে দিইনি। দুপুরের দিকে আর পারছিলাম না, ডাক্তারে যেতেই হলো। যাবার পর এক্সারসাইজ আর ঔষধ দিলো। এও বললো কাজে যাওয়া চলবেনা। ছুটির জন্যে ডাক্তারের নোট নিলাম। ব্যথা বেড়েই চলছে। মনটাই খারাপ হচ্ছিলো, ২৫ আগষ্ট মামনির জন্মদিন কোথায় প্রাণখুলে হাসবো। হাসতে গেলেই গলাতেও ব্যথা। গলা-ঘাড় সব ফুলে উঠেছে। অফিসে ফোন দিলাম আগামীকাল (আজ) কাজে যেতে পারবো না।

আজকের দিনে
আজকের দিনে

কিন্তু আজকের দিনটা হাজার ব্যথাতেও দারুণ কেটেছে। কারণ আজ মামনির জন্মদিন। তীর্থ স্কাইপ অন করেছে, বাপিকে দেখলাম ওয়াকার ধরে ধরে হেঁটে আসছে। আহ কতোদিন পর বাপিকে হাঁটতে দেখলাম। মামনি বেশ সুন্দর সাজ-পোষাক। আমায় বলছে, “এই দেখ মৌ আমায় শাড়ী দিয়েছে আর তোর দেয়া গলার সেটটা পড়েছি।” কি সুন্দর লাগছিলো। এখন কিছু কথোপকথন।
আমি – কি করলে আজ?
মামনি – আর বলিস না, অপু এই মাত্র এসেই কেক নিয়ে আসতে গেলো।
আমি – ভালোই তো।
(এরই মধ্যে বান্ধবীর ফোন। বললাম মামনির সাথে কথা বল। মামনিকে উইশ করলো। ঊর্মী তখন জিজ্ঞাসা করলো,
“জেঠীমনি বয়স কতো হলো?” মামনির উত্তর, “এইতো রে মা ষোলো।” ঊর্মী তখন বললো, “বাহ সুইট সিক্সটিন!”)

যাক তারপর মামনিকে বললাম জানো ব্লগে তোমায় সবাই শুভেচ্ছা জানিয়েছে? বললো কারা কারা? হায়রে কপাল সবার নাম বলতে হলো। ওহ এখন মামনি সবার নাম জানে। তবে আরেকটি কথা বলে নেই, মামনি একসময় কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখতো। সেজন্য এসবের প্রতি একটা টান এখনও থেকে গেছে। অনেক গল্প হয় তো। মামনির জন্মদিন নিয়ে লেখাটা দিতে এসে দেখি কবি ছাইরাছ হেলাল সমগ্র মা জাতিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছেন। অবাক হয়ে গেলাম। এ কি করে সম্ভব! মামনির জন্মদিন আজ, আর সেটা ব্লগে একজনই জানে। সে হলো আমার নানা জিসান শা ইকরাম।কারণ নানা মামনিকে মেয়ে বলে ডেকেছে যে! এছাড়া নানা মামনিকে শুভেচ্ছা এবং আশীর্বাদও জানিয়েছে। মামনি জিজ্ঞাসা করলো, “বাবা ভালো আছে?” বললাম হুম খুব ভালো। আমি আছি না তোমার বুড়া বাবার নাত্নী? মামনি বললো, “তুই বড়ো দুষ্টু এভাবে গুরুজনদের বলতে হয়না।” বললাম, গুরুজন কে? নানা? মামনি শোনো, নানা আমার উপর রাগ করতেই পারেনা। বরং আমাকেই ভয় পায়। মামনি বললো, “ভয় না, ওটাকে বলে স্নেহ। তোকে খুব ভালোবাসে। দেখেই বোঝা যায়।” এরপর মামনিকে বললাম তোমার বাবার কথা রাখো। তুমি শোনো। জানো একজন কবি উনার নাম ছাইরাছ হেলাল মা কে নিয়ে কবিতা লিখেছে? মামনি বললো, “ওহ তাই? উনি নিশ্চয়ই মা-ভক্ত?” বললাম তা জানিনা। কিন্তু অবাক হয়েছি আজ তোমায় নিয়ে লিখে ব্লগে দিতে গিয়ে উনার কবিতা দেখে অবাক হলাম। মামনি বললো, “শোনা তোর লেখাটা।” পড়ে শোনালাম। এরপর বলে, “ওই যে কবি নাম বললি হেলাল উনার কবিতাটাও পড়ে শোনা।” জিজ্ঞাসা করলাম ঘটনা কি? বললো, “আজকাল মায়েদের নিয়ে লেখা হয়, কেমন লেখে সবাই সেটাই শুনতে চাই।” আবৃত্তি করার চেষ্টা করলাম। মামনি এতো মিষ্টি করে হাসিটুকু দিলো।

যাক আবার ফিরে আসি কথোপকথনে।
আমি – মামনি তুমি তো বিশ্বপরিচিত হয়ে গেছো।
মামনি – কি করে রে?
আমি – এই যে ব্লগে, ফেসবুকে। আজ তো উপচে পড়ছে শুভেচ্ছাবার্তায়। দেখো আমার মা হয়েছো বলেই এতো উইশ পাচ্ছো।
মামনি – সবাইকে আমার ভালোবাসা জানাস। সবাই দীর্ঘজীবি হোক। একহাজার বছর বেঁচে থাক তোরা সবাই।
আমি – মামনি প্লিজ আমায় দীর্ঘজীবির আশীর্বাদ দিওনা। তাহলে খবর হয়ে যাবে।
মামনি – না রে আমিও বাঁচবো।
আমি – বললাম দীর্ঘজীবি হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিছানায় শুয়ে মা আর মেয়ে?
মামনি – না, না। এর আগেই যাবো।
আমি – ঠিক আছে গিয়েই আমাকে টেনে নিও। স্বর্গে গেলে আমায় নিও টেনে।
মামনি – না রে আমি নরকে যাবো। তোর বাপি যাবে স্বর্গে।
আমি – মামনি বাপি স্বর্গে গেলে ভগবানের অবস্থা শেষ। ভগবানকে পাগল করে দেবে।
মামনি – হুম সেটা ঠিক। আমার নীলাটা কই? আনো তারে আগে। কি হইলো তারে আনবায়নি(আনবে কি?)? নাইলে আমারে পাঠাও।
**বলেই মামনি আর আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। ওদিকে ব্যথা হাসলেই। তাও হেসেই যাচ্ছি। বাপি পাশে বসা, বাপিও হাসছে। বললাম বাপিকে আরে হাসো জোরে। শুধু যেনো মশা-মাছি না ঢোকে। তীর্থ কানে আঙুল দিয়ে বসে ছিলো পাশে। কারণ হাসির মাত্রা…বললাম না।
আমি – ও মামনি ভগবান তখন নিশ্চিত বাপিকে আমাদের নরকেই পাঠাবে?
মামনি – এসেই তো বলবে আমার নীলারে এইভাবে শাস্তি দিরায়(দিচ্ছো) তুমি যম? তুমার একদিন কিতা আমার একদিন। যমের অবস্থা বারোটা বাজবে।
আমি – যম যাবে ভগবানের কাছে। গিয়ে বলবে হে ভগবান করুণাবাবুর হাত থেকে মুক্তি দাও। তোমার কাছে নিয়ে এসো। নরকে আমায় দৌঁড়িয়ে মারছে। ভগবান তো বলবে না না যম একটা কাজ করো, আবার পাঠিয়ে দাও পৃথিবীতে।
মামনি – ঘুরে-ফিরে আবার পৃথিবীতে আসবো।
আমি – মামনি বেশ মজায় আছো। জন্মদিনে এতোকিছু পেয়েছো। পারফিউমটাও কাল পেয়ে যাবে। কপাল তোমার।

এরই মধ্যে অপু (ছোট বোনের বর) কেক নিয়ে এলো। মোগলাই পরোটা, মিষ্টি, আম। ভালোই খাবার-দাবার টেবিলে। কেক কাটা হলো। গান গাইলাম আমরা সবাই। আমি ভিডিও করলাম (কিন্তু জানিনা কিভাবে এখানে দিতে হয়)। সবশেষে পারিবারিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মামনিকে বললাম গান গাও(মামনি এখন গাইতে পারেনা, গলায় অনেক বছর থেকে সমস্যা)। বললো, “কষ্ট হয় রে গাইতে। তুই কর।” ওপাশ থেকে বাপি মামনিকে তার অস্পষ্ট কন্ঠে বলছে, “নীলারে কও গান গাইতো।” মামনি আমায় বললো। আমি বললাম না আগে তোমরা দুজন। আমরা হেল্প করবো। শুরু করো। জানতে চাইলো কোনটা। বললাম তোমাদের ডুয়েট সেই গানটা। “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।” মামনি আসলে সব ভুলে গেছে। মামনি-বাপির ডুয়েট আহা অনেকগুলো গান। বাপির যেমন কন্ঠ, তেমনি মামনির। এদের রোমান্টিকতা এখনও দেখি। যাক শুরু করলো, কিন্তু জোরে গাইতে পারছিলো না। তাই সেভাবে শোনা যাচ্ছিলো না। “সেদিন দুজনে” গানটির দু’ লাইন গেয়েই বলে মামনি, আর নাকি মনে নেই। বললাম তাহলে “আমার মল্লিকাবনে” করো। মামনি বলে, “তুই কর।” বললাম আসো তুমি-আমি করি। শুরু করতেই ওদিকে বাপি হাত দিয়ে তাল রাখছে। বাপি অসাধারণ তবলা বাজাতো। আমি অনেক গর্ব করে বলতে পারি, গান খারাপ হতে পারে, তাল-লয়ে আমি জীবনেও মার খাইনি। কারণ বাপির তবলা। বিভিন্নভাবে তাল শিখিয়েছে আমায়। কি যে ভালো লাগছিলো বাপির ওভাবে তাল রাখাটা দেখে। ঠোঁটও নাড়ছিলো। কিন্তু আসলে এখন পারেনা দুজনের কেউই। মামনি আবার বললো, “পারছিনা রে।” বললাম ঠিক আছে ওটা করো, “মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে, কৃষ্ণচূড়ার বন্যায় চৈতালী ভেসে গেছে।” বাপি-মামনি-আমি-মৌ চারজনে মিলে গাইলাম। অনুষ্ঠান শেষ হলো। অনেক অনেক দিন পর এমন আড্ডা-আনন্দ-মজা। ভাগ্য ভালো ব্যথা পেয়ে বাসায় ছিলাম, তা নইলে কি এভাবে আসর বসতো?

সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে
সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে

আজ একটি মন ভালো করা দিন
হাতটা দাও, কি পেলে?
–স্পর্শ।
কিসের স্পর্শ?
–উষ্ণতার।
আজ অনেক উচ্ছ্বলতর ক্ষণ, জানো?
–হুম জানি।
কেন বলো তো?
–হু—–ম বলবো না।
জানলে তো বলবে!
আজ আমার মন অনেক ভালো। তাই সমস্ত পৃথিবী দেখো আনন্দে নাচছে!
–তাই বুঝি? কেন মন ভালো, আমি এসেছি বলে?
ধ্যৎ তুমি তো যাওনি কোথাও, আসবে কি করে?
–বাহ! আমি ছিলাম? কি যে বলো না !!
হাত ছুঁয়ে আছো, চোখের দিকে চাও। কিছু দেখতে পেলে?
–হুম! ওখানে আমি। আমার মুখ।
নাহ ভুল। এখানে এই চোখের ভেতর একটা নদী।
–নদী?
হ্যা নদী। অনেক যন্ত্রণা জমে জমে মেঘ হয়ে গিয়েছিলো।
–কিসের যন্ত্রণা?
চোখ তোমায় দেখতে পায়নি বলে। আজ তোমায় দেখে বৃষ্টি হলো, জন্ম হলো এই নদীটির।

হ্যামিল্টন, কানাডা
২৫ আগষ্ট, ২০১৫ ইং।

**লেখা-ছবি-কবিতা সব আজকের। আমার আনন্দ সবার জন্যে।

৫৮১জন ৫৮১জন
0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ