চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রাম । মধ্যবিত্ত এক পরিবারে ১৯১১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন রাণী। মায়ের দেয়া ডাক নাম।পিতা ছিলেন পেশায় একজন কেরানী। শান্ত স্বভাবের রাণী পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে মাকে ঘরের যাবতীয় কাজেই সাহায্য করতেন। তার আরও একটা ছদ্মনাম ছিলো ।ফুলতার ।
১৯১৮ সালে তিনি ডাঃখাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।একেবারে তৃতীয় শ্রেণীতে। প্রাথমিকের পড়াশোনা শুরু হয়। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করে ১৯২৭ সালে এই স্কুল থেকেই বেশ কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এ সময় বিয়ের প্রস্তাব আসায় তিনি প্রবল আপত্তি জানান। তারপর তাঁর ইচ্ছাতেই ইডেন কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন পিতা। ১৯২৯ সালে উচ্চমাধ্যমিকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ষ্ট্যাণ্ড করেন ও বোর্ডে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। কৃতিত্বের এই ফলাফলের জন্য তাঁকে মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি প্রদান করা হয়। তিনি পড়াশুনা করতে যান কলকাতার বেথুন কলেজে।সেখান থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। স্নাতকের ফল স্থগিত থাকায় চট্টগ্রামের নন্দন কানন অর্পণাচরণ ইংরেজী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন ।কেননা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় তাঁর এবং বীণাদাশ গুপ্তের ফলাফল স্থগিত রাখে ব্রিটিশ সরকার। ২০১২ সালের ২২ শে মার্চ বেথুন কলেজের সমাবর্তনে তাঁকে মরণোত্তর স্নাতক হিসেবে সম্মান দেয়া হয়।
.
শিল্প – সাহিত্য এবং দর্শনের প্রতি ছিলো তাঁর প্রবল আগ্রহ। সাংস্কৃতিক নানান কর্মকাণ্ডে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। সেই সাথে ব্যাডমিন্টন খেলায় ছিলেন পারদর্শী। আরও একটা গুণ ছিলো , দারুণ বাঁশি বাজাতেন। এই মেধাবী শিক্ষক মহলে তো বটেই , সহপাঠীদের কাছেও ছিলেন জনপ্রিয়।স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা উষাদি , তাঁকে শুনাতেন ইতিহাসের ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ এর বীরত্বের কথা।মূলত সেই সময় থেকেই বিপ্লবের বীজ রোপিত হয় অন্তরে। তারই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কল্পনা দত্ত (পরবর্তীতে বিপ্লবী) বলেন ,
“কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম। ”
বলছিলাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার – এর প্রাতিষ্ঠানিক নানান কৃতিত্বের কথা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম একজন বিপ্লবী ।
ইডেন কলেজের ছাত্রী নিবাসে থাকাকালীন সময়ে তিনি বিপ্লবী লীলা নাগের সংস্পর্শে আসেন ।লীলা নাগ ছিলেন দিপালী সংঘের প্রধান বিপ্লবী।দিপালী সংঘ ছিলো শ্রীসংঘের নারী শাখা। তারপর প্রীতিলতাও সদস্য হন এই সংঘের। দেশের জন্য কাজ শুরু করেন।
এর আগে দিপালী সংঘের সদস্য ফর্মটি প্রীতিলতা তাঁর দাদাকে দেখিয়ে নিজের ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেন। দাদা পূর্ণেন্দু ছিলেন কংগ্রেস নেতা মাস্টার দ্য সূর্যসেনের
অনুগত। তিনি এই ফর্মটি বিপ্লবী সূর্যসেনকে দেখালে তিনি প্রীতিলতাকে বিপ্লবী দলের সদস্য করে নেন। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন প্রীতিলতা বিপ্লবী সূর্যসেনের সাথে দেখা করতে যান ধলঘাটের বিপ্লবীদের আস্তানায়। এসময় বিপ্লবী নির্মল সেনও উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের এই গোপন বৈঠকের কথা জেনে যায় ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী। এর আগে মে মাসেই সূর্যসেন ও নির্মল সেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ বিভাগ । ঐদিন সূর্যদেন ও প্রীতিলতা পালিয়ে যেতে পারলেও পুলিশের গুলিতে নিহত হন নির্মল সেন।
বিপ্লবী সূর্যসেন একবার প্রীতিলতাকে দায়িত্ব দেন চট্টগ্রাম অস্রাগার লুণ্ঠনের জন্য বোমা তৈরীর সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়ার। তিনি সেই দায়িত্ব ভালো ভাবেই পালন করেন।
১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। ইংরেজদের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন চট্টগ্রামের বিপ্লবীগণ। সূর্যসেন আক্রমণের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন প্রীতিলতাকে। তিনি সফলভাবে সেই অভিযান শেষ করে ফেরার সময় এক ইংরেজ তরুণের গুলিতে আহত হন। জীবিত অবস্থায় ধরা পড়বার চে’ মৃত্যুকে বরণ করাই শ্রেয় মনে করে খেয়ে নিলেন পটাশিয়াম সানাইড।জীবন দিয়ে অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কথা এভাবেই ইতিহাসের পাতায় লিখে যান বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ।
গত ২৪ শে সেপ্টেম্বর ছিলো মহান এই বিপ্লবীর আত্মাহুতি দিবস । বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের
১৫টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে জানাই লাল সালাম।ইতিহাসের পাতায় অনেক যোদ্ধাই আছেন যারা শহীদ হয়েছেন কিন্তু মৃত্যুটি ছিল স্বইচ্ছায় দেশপ্রেমের টানে বিপ্লোবিদের বাচাতে আত্ম হত্যা করেন এই হচ্ছে প্রকৃত বিপ্লবী।সুন্দর একটি বিষয় জানালেন যা আমার অজানা ছিল।ধন্যবাদ।ইতিহাসে সম্মৃদ্ধ হউক সোনেলা।
রুম্পা রুমানা
ঠিক বলেছেন। আহত অবস্থায় ধরা পড়লে অনেক অথ্যই জানাতে হতো প্রীতিলতাকে। সেজন্যই আত্মাহুতি দিলেন । আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু খায়ের আনিছ
ধন্যবাদ, ইতিহাস জানতে পারলাম।
রুম্পা রুমানা
আপনাকেও ধন্যবাদ।
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রীতিলতা আর মাষ্টারদাকে নিয়ে প্রথম গল্প শুনি মামনির মুখে অনেক ছোটবেলায়। আমার রূপকথার গল্প ভালো লাগতো না। মামনি এসব কাহিনী যখন বলতো, মন দিয়ে শুনতাম। মনে আছে একদিন মামনিকে বলেছিলাম আমি প্রীতিলতা হবো।
রুম্পা রুমানা আপনি লিখলেন সেই ইতিহাস, আর আমারও মনে পড়ে গেলো সেইসব দিন।
ধন্যবাদ আপনাকে।
রুম্পা রুমানা
তবে আমরা আরেকজন বিপ্লবী পেতাম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ,আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
বিপ্লবী হওয়া কি অতো সহজ? তাইতো আমার জন্ম স্বাধীন দেশে।
রুম্পা রুমানা
বিপ্লবী হওয়া অনেক কঠিন। ঠিক।
ইঞ্জা
বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি এই মৃত্যুঞ্জয়ি বিপ্লবী যোদ্ধার প্রতি।
রুম্পা রুমানা
হুম। বিনম্র শ্রদ্ধা। ধন্যবাদ আপনাকে।
ইঞ্জা
আপনাকেও ধন্যবাদ
মোঃ মজিবর রহমান
স্বশ্রধ্ব লাল সালাম।
রুম্পা রুমানা
আপনাকে ধন্যবাদ ।
মৌনতা রিতু
এই বীরদের নিয়ে পড়েছিলাম ঠিক কবে তা মনে নেই। তবে একটা গান মাঝে মাঝেই গুন গুনাতাম আর তা হলঃ একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
অসাধারন সব বীরত্বের কাহিনী পড়তাম। আমার বড় দুর্বলতা ইতিহাস। পরিবার থেকে থেকে চাপের কারনে সাবজেক্ট হিসেবে না নিলেও পড়তে ছাড়িনি ইতিহাসের বই। এখনো আমার সংগ্রহে আছে এসব বই।
খুব সুন্দর করে উপস্থথাপন করলেন আপু। ধন্যবাদ।
রুম্পা রুমানা
হুম। গানটা জনপ্রিয়কখুব। ইতিহাস পড়তে আমারও ভালো লাগে। কিন্তু মনে রাখাটাই কঠিন । ধন্যবাদ আপনাকে।