
আমি আর একমাসের মাঝে অন্ধ হয়ে যাবো। কথাটা যতোটা সহজে বলা যাচ্ছে, তারচেয়ে হাজার কোটি গুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে মানতে।ডাক্তার যখন আমাকে বললেন,আমি আর মাত্র কিছুদিন এই পৃথিবীর আলো দেখতে পারব তখন হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল আমার সমস্ত পৃথিবী!আমি ডাক্তারের মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলাম।কি জানি এই অল্পসময়ে এই লোকটার সাথে আর যদি দেখা না হয়।আমি হাসপাতাল থেকে ধীরপায়ে বের হচ্ছিলাম।চোখ ঝাপসা হয়ে আসতেই হোঁচট খেলাম।আমার মা পেছন থেকে এসে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন।আমি আমার মার হাতের দিকে তাকালাম।আমার মার হাত এতো সুন্দর!আগে কখনো খেয়াল করিনি কেন?আমার মা বললেন,’সাবধানে হাঁট বাবা।পড়ে যাবি তো।’আম্মাকে তখন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিত্কার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো আমার।কিন্তু আমি কাঁদলাম না।হাসিমুখে বললাম,’আরেহ্ আম্মা,রাস্তাই খারাপ।’আম্মা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,’তো খারাপ রাস্তা দেখে হাঁটবি না?আল্লাহ চোখ দিছেন কেন?’আমি এবার থেমে গেলাম।আর হাঁটতে পারলাম নাহ্।আম্মাকে বললাম,’আম্মা তোমার হাতটা ধরে একটু হাঁটি?আম্মা হাসলেন।বললেন,’এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়নাকি রে পাগল। ধর হাত।আচ্ছা,ডাক্তার কি বললো,সেটা তো বললি না।’আমি অন্যদিক তাকিয়ে বললাম,’তেমন কিছু না আম্মা।চশমাটা নিয়মিত পড়তে বললো,এই আর কি!’বলতেই গলার স্বর আটকে গেলো।আমি চুপচাপ আম্মার হাত ধরে হাঁটতে লাগলাম।সেদিন আমি সারাদিন কাঁদলাম,সারারাত কাঁদলাম।ঘুম থেকে উঠার পর দেখতে কষ্ট হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম।এই ত্রিশদিন আমি শত কষ্টেও একটি বারের জন্যও কাঁদবোনা।আমি আরো একটা সিদ্ধান্ত নিলাম।আমার অন্ধ হয়ে যাবার ব্যাপারটা কিছুদিন চেপে রাখবো।নইলে আশেপাশের সবার স্বাভাবিক চেহারা দেখার সুযোগটাও মিস হবে।যেদিন থেকে জানতে পেরেছি আমি অন্ধ হবো,সেদিন থেকেই আমার কেবল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।ঘুমালেই মনে হয় সময়গুলো নষ্ট হলো।অথচ ডাক্তারের কথামতো নিয়ম করে ঘুমাতে হচ্ছে। নইলে আরো তাড়াতাড়ি অন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা।আমার কাছে ইদানীং পৃথিবীটা খুব সুন্দর মনে হয়।হারানোর নিয়মটাই হয়তো এমন।যেদিন থেকে আমরা জেনে যাই যে, হারাতে হবে।সেদিন থেকেই সেটা আরো বেশি আপন করে পেতে ইচ্ছে করে।আরো কাছে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে।
আমি এই কয়দিনে যা যা দেখা যায় সবই দেখার চেষ্টা করছি। কয়েক লাখ মেগাবাইট কিনে গুগল,ইউটিউবে সার্চ দিয়ে পৃথিবীর সব সুন্দর জায়গাগুলো দেখে নিচ্ছি।ইদানীং মেসেজিং করতে গেলেই মনে হচ্ছে,আরেহ্! কি সুন্দর এ অক্ষরগুলো।কুরআনের হরফগুলো হাত বুলিয়ে দেখি।আজকাল সময় পেলেই আকাশ দেখি।কয়েক সেকেন্ডে আকাশের এমন রূপ বদলানোর বিষয়টা দেখে আগে এতোটা মজা পায়নি।কয়েকদিন হলো, আমার খুব বৃষ্টি দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিল।আজ বিকালে বৃষ্টি হলো।বৃষ্টি দেখতে এতো চমত্কার?অথচ আর কিছুদিন পর আমি কেবল এর শব্দটা শুনতে পারবো।দেখা হবেনা কখনোই। আমি গাছ দেখি,গাছের সবুজ পাতা দেখি,উড়ে যাওয়া বক দেখি,পাখির নীড় দেখি,ফুল দেখি,শিশির দেখি,কুয়াশা দেখি।প্রতিদিন নিয়ম করে খুব ভোরে উঠে সূর্যোদয় দেখি।আম্মা আমার এতোসব কান্ড দেখে কখনো অবাক হোন,কখনো খুশি হোন,কখনো চিন্তিত হোন আবার কখনো বা বিষণ্ণ হোন।কিন্তু কিছুই বুঝে উঠেন না ঠিকভাবে।আমাকে জিজ্ঞেস করলে,আমি হাসি।তবু মায়ের মন,সব বুঝে যায় একসময়।বলতে হয় সবকথা।আমি আজকাল আম্মার সাথে ছাদে বসে জোছনা দেখি।আম্মা মুখ লুকিয়ে কাঁদেন।আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন।আমি আম্মার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকি।আব্বা জানতে পেরে,প্রথম কিছুদিন একদম চুপ মেরে গিয়েছিলেন।এখন হাসিমুখে আমার সামনে হাঁটাহাঁটি করেন।কোথা হতে কিসব শিকড় বাকড় নিয়ে আসেন।চোখে লাগাতে বলেন।আব্বা আজকাল অফিস থেকে ফেরার পথে নানা ধরণের ফুলের তোড়া দিয়ে আমার ঘর সাজিয়ে রাখছেন।আজকে হঠাৎ ছোটভাইটা তার সব গুপ্তধন আমার সামনে নিয়ে হাজির।সেখানে আমার হারিয়ে যাওয়া ঘড়িটাও পেলাম।আমার বন্ধু বান্ধবরাও কিভাবে কিভাবে জানি জেনে গেছে সব।তারা প্রতিদিন কত যে অদ্ভুত সব জিনিস জোগাড় করে আনছে তার ইয়ত্তা নেই। আমি কেবল আশ্চর্য হই। আর একটা গভীর আফসোস বুকের গভীরে জমাট বাঁধে।হায়,কতকিছু দেখার বাকি থাকলো!বন্ধুরা সব কলেজ ভার্সিটি বাদ দিয়ে সাতদিনে বাংলাদেশ ভ্রমণের আয়োজন করেছে।তারা আমাকে নিয়ে দেশ ঘুরবে।সব অদেখা দেখাবে।আমি তাদের সামনে মুচকি হাসি আর ভেতরে ভেতরে ডুকরে কাঁদি।এ সুযোগে আমার বহুবছরের ইচ্ছাপূরণ হতে যাচ্ছে।মধ্যবিত্তদের সাগর দেখার শখ আহ্লাদ খুব কমই পূরণ হয়।আমি সেদিক থেকে ভাগ্যবান।ইদানীং আমি মশাটাকেও খুব খুঁটিয়ে দেখি।দুধের উপর পিঁপড়া পড়লেও আর বিরক্ত হইনা।অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি।তেলাপোকা দেখে আর ঘেন্না লাগেনা।দেয়াল ঘড়িতে বসবাসরত টিকটিকিটা দেখার জন্য অনেকক্ষণ ঘড়ির দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকি।ঘড়ির কাটাগুলোর ঘোরাফেরা দেখি।ডায়রির পাতাগুলো খুলেখুলে দেখি।হঠাৎ একটা পাতায় কয়েকটা লাইনে আটকে যায় চোখ,
“চেনা অচেনার ভীড়ে
এ মায়া মমতার ডোরে
অকূল পাথারে
কখনো খুঁজেছিলে আমারে?”
পড়তেই চোখ ভিজে উঠে।কাকে খুঁজতে বলেছি আমাকে?কে সে?হায়,এ জীবনে আর কখনো দেখা হলোনা তাকে।সে কেমন হবে?গোলমুখী নাকি খানিক লম্বাটে?কি রং এর পোশাকে তাকে সবচেয়ে বেশি মানাবে?চোখে কাজল দিলে কেমন দেখাবে?জানা হলোনা।আমি আজকাল ঐশ্বরিয়ার একটা ছবি নিয়ে ঘুমাতে যাই।ঘুম থেকে উঠেও ছবিটা দেখি।আমি যা যা খেতে পছন্দ করি,আম্মা সব রেঁধে আমাকে দেখান।আমি তাকিয়ে থাকি।সময় পেলে পুরনো ছবিগুলো দেখি।টেলিভিশন দেখি।সিনেমা দেখি।শাবানার কান্না দেখে আমিও কাঁদি।চিত্কার করে কাঁদি।আমির খানের থ্রি ইডিয়ট্স আর দেখা হবেনা,ভাবতেই অসহ্য লাগে।এই বাঁকা চাঁদটা গোল কি করে হয়,জানা হবেনা আর।আমি আর কিছুই দেখতে পারবোনা।
বাবার হাসি,মার কান্না,ছোটভাইয়ের অভিমান।আমার বিছানা,পড়ার টেবিল,সব অন্ধকার হবে।আমি আর পড়তে পারবোনা।শেক্সপিয়র,শার্লক হোমস,হিমুসমগ্র,দ্য লস্ট সিম্বল সব ওভাবেই পড়ে রইবে।ফেসবুকে ঢোকা হবেনা,ইচ্ছামতো লাইক দেওয়া হবেনা,কমেন্টে বন্ধুদেরকে পঁচানো যাবেনা।একা রাস্তা পার হওয়া হবেনা।আমার সর্বক্ষণের সংগী হবে একটা স্টিক।আমি এখন প্রায়ই আয়না দেখি।নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি।হেসে দেখি,কেঁদে দেখি,ভেংচি কাটলে কেমন দেখায়,তা দেখি।চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি।আমার চুলগুলো কালো থেকে সাদা হলে আমাকে কেমন দেখাবে আমি জানবো না।আমার সন্তানের মুখটা কেমন হবে আমি জানবো না।তবে তাদের কণ্ঠ শুনতে পাবো।আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরলে বুঝতে পারবো।গালে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে পারবো।আমার বাবা হাসলে জেনে যাবো।ভালোবাসার মানুষটাকে অনুভব করতে পারবো।আজকাল মনে হয়,তবু তো বেঁচে আছি।মারা গেলে এই পৃথিবীর বুকে নিশ্বাস নেওয়ার আনন্দটাই বা কোথায় পেতাম?বেঁচে আছি,এটাই বা কম কিসে?
২২টি মন্তব্য
নাজমুল হুদা
হারানোর ভয় মানুষ আরো আকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে শিখায়। সুন্দর ভাবনার গল্পটি।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
হারানোর ভয়ই পাওয়াকে মূল্যবান বানায়।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা।
ছাইরাছ হেলাল
খুব সুন্দর করেই ক্রম অন্ধত্বের বর্ণনা দিয়েছেন।
হারিয়ে না গেলে আমরা বুঝতে পারি না কী হারিয়েছি।
এর পর ও আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, ভীষণ কষ্ট চেপে।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
খুব সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
হারানোর কষ্ট যার, সেই বুঝে, কষ্ট কেমন!
ভালো থাকবেন।
আরজু মুক্তা
হারালেই বোঝা যায় তার মর্ম।
আপনার নায়িকার জন্য ‘থ্রি ইডিয়টস ‘ এর আমারএকটা মুভি রিভিও আছে। পড়ে দেখতে বলবেন।
আর চোখ খুব দামী। সবাই ভিটামিন এ বেশি খান। চোখ ভালো রাখুন
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
আচ্ছা। পড়তে বলবো।
চোখ অমূল্য সম্পদ।
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
গল্পটি পড়তে পড়তে খুব কান্না পাচ্ছিল। আমার মতে অন্ধরাই দুঃখী বেশী। এ পৃথিবীর কোন কিছু দেখতে পায়না, পুরো জগৎটা অন্ধকারে ডুবে থাকে, শুধু অনুভবে কি সুখ পাওয়া যায়? ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
হৃদয় দিয়ে অনুভব করার জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা।
ভালো থাকবেন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
সুন্দর লেখা, দুঃখেরও উপস্থিতি।
শুভ কামনা ।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা আপনার জন্যও। এভাবেই অনুপ্রেরণা দিলে ভালো লাগবে খুব।
ফয়জুল মহী
চরম বাস্তবতার যথার্থ প্রকাশ ।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
অনেক ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগলো সুন্দর একটি মন্তব্য পেয়ে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বাস্তবতার নিরিখে লেখনী।
চোখ হারিয়ে গেলে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য আর কারো হয় না। যার নেই সে বুঝে।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
চোখ অমূল্য সম্পদ।
শুভকামনা রইলো।
সুরাইয়া নার্গিস
লেখাটা পড়তে গিয়ে কেন জানি চোখে পানি চলে আসলো অসম্ভব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে লিখেছেন।
পৃথিবীতে সবচেয়ে দূর্ভাগ্যব্যক্তিটি হলো অন্ধ মানুষ। কারন যে কানে শোনতে পারে না দেও দেখতে পারে, যে মুখে কথা বলতে পারে না সেও দেখতে পারে, কিন্তু যে অন্ধ সে পৃথিবীর কিছুই দেখতে পারে পৃথিবীতে তার কষ্টই সবচেয়ে বেশি।
লেখাটা অনেক ভালো লাগছে আপু।
শুভ কামনা রইল।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
আপনার ভালো লেগেছে জানতে পেরে খুশি হয়েছি অনেক।
যার চোখ নাই, তার পৃথিবীর রঙ রূপ অনুভবের অধিকারও নেই৷ কি দুঃসহ্ একটা ব্যাপার!
আপনার জন্যও শুভকামনা রইল।
তৌহিদ
অভিভূত হলাম লেখা পড়ে। নিজেকে একজন অন্ধ হতে যাওয়া মানুষের জায়গায় কল্পনা করে সেই ভাবনা থেকে লেখা এটি সত্যি অভাবনীয় বিষয়।
অন্যদের লেখাও পড়ুন, সেখানে আপনার গঠনমূলক মন্তব্যে উৎসাহ দিন। ভালো থাকুন সবসময়।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
অসংখ্য ধন্যবাদ।
চেষ্টা থাকবে আপ্রাণ।
শুভকামনা রইল।
জিসান শা ইকরাম
আপনার এমন বর্ননায় ভিতরটে কেঁপে উঠলো।
আগে থেকে জেনে যাওয়া অন্ধত্বের দিনক্ষন। আমরা বুঝতে পারিনা যেহেতু আমরা অন্ধ নয়, কিন্তু যদি জানতে পারি একমাস পরেই আর দেখতে পাবোনা, তাহলে হয়ত বেঁচে থাকাই কঠিন হবে।
এমন অনুভুতি আনলেন কিভাবে বর্ননায় তাই ভাবছি।
আপনি খুবই ভালো লেখেন।
শুভ কামনা।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি একটি চমৎকার মন্তব্যের জন্য। আপনাদের উৎসাহই আমার প্রেরণা। ভালো থাকবেন অনেক।
হালিম নজরুল
চমৎকার। অন্ধ মানুষের অনুভূতি নিয়ে লেখা সহজ নয়। কিন্তু ভাল লিখেছেন।
আতকিয়া ফাইরুজ রিসা
অনেক ধন্যবাদ। ভালো লাগলো জেনে।